আখতার-উল হাকিম
ঢাকা শহরে সবে পা রেখেছি । নতুন নাগরিক। যতটুকু না হলে নয়, এর বাইরে পথঘাট চিনি না। এই অজানা, অচেনা শহরে কোন পরিচিত মানুষজন নেই। দূর সম্পর্কের এক মামা নিয়ে এসেছেন এতটুকুই। আমার পৃথিবী ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হয়ে একটি ছোট চারকোণা ঘরের ভিতর সীমাবদ্ধ। পড়াশোনার পাঠ ভালোভাবে চুকাতে পারলে ঢাকা শহরে নামীদামী চাকরি পাওয়া যায়; হাজার হাজার লাখ লাখ টাকা বেতন। আমি লাখ টাকা কামানের স্বপ্নে বিভোর। পরিবারের সুখি জীবনের দায়বদ্ধতা থেকে পুরোদমে পড়াশোনায় লেগে গেলাম। আমার পাশের সিটে থাকতেন হাফিজ ভাই। তিন ক্লাস সিনিয়র। ফরিদপুরের মানুষ। একদম সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু না কিছু ব্যতিক্রমী গুণ থাকে। হাফিজ ভাইয়ের গুনাগুণ সম্পর্কে দুয়েকদিনে সম্যক ধারণা না হলেও পরিশ্রমী ত্রস্ততা চোখে পড়ে। মানুষের উপকার করার জন্য সারাক্ষণ ব্যাকুল, যেচে যেচে ভাল-মন্দ জিগ্যেস করেন — সবকিছু ছাপিয়ে পরার্থপরতার এই গুনটিই আমার নিকট বড় হয়ে ওঠে। মানুষের কল্যাণের প্রতি ভারি যত্নশীল । এ যেন তার ধ্যান-জ্ঞান।
আমাদের হোস্টেল রুমের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কাপড়-চোপড় ধৌত কড়া থেকে শুরু করে অভয় দেয়া , ঠিক টাইমে ওষুধ সেবন করানো ইত্যাদি সব। হাফিজ ভাইয়ের বি পজেটিভ রক্ত। ভালোমতো খাওয়া দাওয়া করতেন বিপদ্গ্রস্থকে ফ্রেশ ও ভাল রক্ত দিতে পারেন। আমরা খুব অবাক হতাম।
সেবা যত্নের পাশাপাশি পড়ালেখাও সমানতালে চলতো।
মাস্টার্স কমপ্লিট করে হন্য হয়ে চাকরি তালাশ করছেন, কোথাও চাকরি হয় না। বাপ-মায়ের তরফ থেকে হাফিজ ভাইয়ের নিকট টাকা পয়সার কোন আবদার নেই। বড় দুইভাই, নিপাট ভদ্রলোক, উভয়ে সংসার দেখভাল করেন। তারাও হাফিজ ভাইয়ের প্রতি সন্তুষ্ট। বিভিন্ন কারণ আছে। দূরে থেকেও অগ্রজদের তুলনায় বাড়ির খবরাখবর তুলনামূলক বেশি রাখতেন। ।
বাড়ি গেলে সমস্ত কাপড় চোপড় হাফিজ ভাই ধুয়ে দিতেন। ছোট তিনটি ভাতিজা, বাবা-মা এমনকি ভাবিদের জামা কাপড়ও । স্বার্থপর পৃথিবীতে হাসিখুশি বেঁচে থাকার কায়দা কানুন রপ্ত করেছিলেন। ভাবিদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে ভাইয়েরা থাকবে খুশি। যদিও এসবের কিছুই হাফিজ ভাইয়ের মধ্যে ছিলো না। নিঃস্বার্থ একজন মানুষ। যতদিন হাফিজ ভাই আমাদের মধ্যে ছিলেন— এমনটিই দেখেছি।
একদিন হাফিজ ভাইয়ের বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেল। যোগ্যতা, লবিং আর কিছু মালপানি (ঘুষ) — তিনের সমন্বয়ে। শেষোক্ত দুইটি বেছে নিয়েছিলেন তার এক শিক্ষকের পরামর্শে, এক প্রকার বাধ্য হয়ে। স্যার বড় দুঃখ নিয়ে বলতেন, ‘এই দেশ তার সন্তানের জন্য এই নিয়ম বলবত করে রেখেছে। কী আর করবে।’
এক বছর ঘুরাঘুরির পরে চাকরি। মালপানি ছাড়ার কথা উল্লেখপূর্বক বিলম্বিত চাকরির জন্য হাফিজ ভাইয়ের সাথে অনেক তর্ক হয়েছে। হাফিজ ভাই পিঠে হাত রেখে বলতেন, ‘মিয়া, আমার যোগ্যতা কি আল্লাহ পাক কম দিছেন? প্রত্যেকটা পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে এসেছি আজীবন, আমি ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে যাবো কেন?’
আমি লবিংয়ের কথা তুলেছিলাম, হাফিজ ভাই সেটাকেও জোরদার নাকচ করে দিয়েছিলেন। শেষমেষ লবিংয়ের মাধ্যমে হাফিজ ভাইয়ের চাকরিটা হল। সীমাবদ্ধ কিছু মানুষের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করলাম। হাফিজ ভাই যখন জয়েন লেটারটা দেখিয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম, দিনদিন বাংলাদেশ এমন একটা দেশ হয়ে যাচ্ছে যেখানে ছোটখাটো চাকরির জন্যও ঘুষ বাধ্যতামূলক । ডিগ্রি অমূল্যহীন— এ দিয়ে কাজ হয় না। দেশের মানুষ সৎ হবে কেমনে? অসততার উপর দাঁড়িয়ে আগামী প্রজন্ম কিভাবে মুখ তুলে দাঁড়াবে ? ক্ষুব্ধ হয়ে এ-ও বললাম, ঘুষের টাকায় স্মার্ট মানুষ হয়; কিন্তু গর্ব করার মতো নয়। কতগুলো ব্যর্থ মানুষ হয় নিজেদের ব্যর্থতা, অসারতা ঢাকতেই ব্যস্ত। আপামর জনগণকে সময় দেবে কখন?’
একদলা প্রশ্ন শুনে হাফিজ ভাই চোখ দুইটা বড়বড় করে তাকালেন। অবাক ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুই এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারিস? সত্যিই আমি জানতাম না। তোর ভাবনাগুলোও দারুণ।‘ দুই তিনজন মহানায়কের ব্যক্তিত্ব উল্লেখপূর্বক তাঁদের সাথে আমাকে অনায়াসে মিলিয়ে দিলেন। আমি হাফিজ ভাইয়ের কথা শুনে হা হা করে হাসলাম।
চাকরিটা পোক্ত হওয়ার পর হাফিজ ভাই আমাদের সাথে বেশিদিন থাকেননি। মতিঝিলে দুই রুমের একটি ছোটখাটো বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। বাসা থেকে অফিস নিকটে। বাবা-মাকে ঢাকা নিয়ে এসেছিলেন। এবার বিয়েশাদির কথা ভাবতে হয়। দুই ভাবি যুগ্ম হয়ে মেয়ে দেখা শুরু করলেন। দুনিয়ায় এত এত মেয়ে তবুও বিরাট অভাব। তিন মাসের মাথায় পাওয়া গেল বটে তবে সংসার দীর্ঘায়ীত হল মোটে পাঁচ মাস। হাফিজ ভাই সুখী হতে পারলেন না। মেয়ের ব্লাড ক্যান্সার ছিল। চিকিৎসা বাবদ কাড়ি কাড়ি টাকা খরচে রাজি ছিল না। রোগের বিষয়টি সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিল মেয়ের পরিবার। চেহারা সুরত ভালো ছিল। সমস্ত দিক বিবেচনা করলে এরকম মুক্তা তুল্য মেয়ে কালেভদ্রে দুয়েকটি মেলে। শ্বশুরবাড়ির পার্শ্ববর্তী লোকজন কানাঘুষা করেছিল। হাফিজ ভাই আগপিছ এতো কিছু ভাবার সময় নিলেন না।
হাফিজ ভাইয়ের স্ত্রী মারা গেলেন শান্ত স্নিগ্ধ এক সকাল ভোরে, দীর্ঘ বেদনাকে সঙ্গে করে। মেয়েদের পরিবারের মানসিকতা নিয়ে কথা উঠল। হাফিজ ভাইয়ের শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে ‘ছোটলোক,বাটপার’ হেন গালি নেই , বর্ষিত হয়নি। প্রয়াত মেয়ের চেহারাও দেখতে দেয়া হয়নি। কবরে নামানোর সময় শ্বশুর মশাই হাফিজ ভাইয়ের পা ধরো চিৎকার শুরু করেছিল, ‘বাজান, মাত্র একবার দেখবো, মাত্র একবার।‘ এলাকাবাসীর প্রবল অমত সত্ত্বেও হাফিজ ভাইয়ের করজোড়, সনির্বন্ধ অনুরোধে মেয়ের মুখ দেখানো হয়েছিল বটে, তবে হাফিজ ভাইকে পরবর্তীতে কটু কথা শুনে এর খেসারত দিতে হয়েছে।
আমি অবশ্য এতোকিছু জানতাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিলাম । হাফিজ ভাই বাইরের পৃথিবীর বাসিন্দা , তিনিও ঐ আওতায় পড়েন। হাউস টিউটরের কাছে আমার বাটন ফোনটা জমা দিলাম। স্যার অবাক হলেন। বিনীত ভঙ্গিতে জানালাম, ‘স্যার, ফোনটা শুধু বাড়ির সাথে যোগাযোগ করার জন্য। তাছাড়া মোবাইলের অবাধ ব্যবহার পড়ালেখায় ক্ষতি করে।‘ স্যার কি যে খুশি হয়েছিলেন, বলাই বাহুল্য।
সত্যি বলতে, ভার্সিটিতে আমার কোন বন্ধু নেই। দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট থাকার সুবিধার্তে ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত পাওয়ারফুল একজনকে ‘ধর্মের ভাই’ মানলাম । কৌশল কাজে দিল। তিনি সানন্দে ছোটভাইকে বরণ করে নিয়েছিলেন ভার্সিটির চৌহদ্দিতে।
মাস্টার্স কমপ্লিট করার পরে যখন চাকরিতে থিতু হলাম। কিছুদিন পরেই সেই বড়ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনি। চাঁদাবাজি কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা গিয়েছিলেন। সেদিন খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। কী এক অমোঘ আকর্ষণে পরেরদিন তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম– কবরে ফাতেহা পাঠ করার জন্য। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি। যাক, মূল গল্পে ফিরে যাই।
একদিন মধুর ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছি, কাকতালীয়ভাবে হাফিজ ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি আমার সামনের টেবিলে একজন মাওলানার সাহেবের সঙ্গে বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন। মাওলানা সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজে থেকেই সালাম দিলাম। জড়িয়ে ধরলেন পরম মমতায়।
মাওলানা সাহেবের প্রস্থানের পরে হাফিজ ভাই আমাকে নিয়ে বসলেন। এন্তার কথা হলো। চাকুরি জীবন, বিয়ে এবং বিয়ে পরবর্তী ট্রাজেডি নিয়েও।
-কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বললাম, আর বিয়ে করবেন না ?
হাফিজ ভাই অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালেন। পরিচিত হাসি মুখটি কেমন অচেনা লাগল। বিমর্ষ , বিষণ্ণ। অবনত ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন, ‘না, আর বিয়ে করবো না। তোর ভাবি যেদিন স্বপ্নে আরেকটা বিয়ে করতে বলবে এবং তার মতো একটা মেয়ের সন্ধান দিবে সেদিন বিয়ে করবো।‘
হাফিজ ভাইয়ের ছেলেমানুষি কথাবার্তা হাসি পায়। মনের অবস্থা গোপন রেখে পরবর্তী প্রশ্ন করি।
– তার পরিবার ধোঁকাবাজি করেছে, তবুও ভাবির কথা আগ্রহ উল্লেখ করছেন যে ?
ঈষৎ হেসে বললেন, তার পরিবার ধোঁকাবাজি করেছে বটে, সে তো করেনি।
আমার অবাক হওয়ার পালা।
হাফিজ ভাই বলে চলেন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে বসা কিছু তিক্ত সত্য কথা—’হনুফা বিয়েতে রাজি ছিল না। বলেছিল, যেদিন ব্লাড ক্যান্সার নিরাময় হবে, সেদিন বিয়ে করবে। অন্য একটা ছেলেকে কিম্বা তার পরিবারকে ঠগাতে পারবে না। তার পরিবার সরল সোজা কথা নিতে পারেনি। বড় সম্বন্ধি ভাই রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন, আর কতদিন আমাদের ঘাড়ে বসে খাবি। নিজে কামাই করলে বুঝতি। তোর পিছনে প্রতিদিন আমাদের কত টাকা খরচ হয় সেটা কি তুই জানিস?’ এখানেই শেষ নয়। চাপা ক্রুদ্ধ গলায় মেজো ভাবি বলেছিল, ‘বেশ্যা জানি কোনানকার। এতো বড় ডাঙ্গর হয়েছে, তবুও বিয়েতে মন নেই।‘
হনুফা সারারাত কেঁদেছিল। আত্নহত্যার কথাও উঁকি দিয়েছিল। ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’ এই বোধ তাকে সংবরণ করেছিল। পরেরদিনই আচমকা বিয়েতে রাজি হয়।‘
পরবর্তী কথাগুলোর ওজনের কথা ভেবে হাফিজ ভাই একটু পানি খেয়ে নেন। করতালে মাথা রেখে শুরু করেন-
‘বাসর রাতে যখন ঢুকলাম, দেখি, তোর ভাবি কাঁদছে। অচেনা অজানা পরিসর থেকে বেরিয়ে একজন শক্ত মানুষ থতমত খেয়ে যায় , একটি মেয়ে সে জায়গায় চিরকালের জন্য আপনজন ছেড়ে চলে এসেছে– মেয়েরা সাধারণত এ রাতে দিকভ্রান্ত হয়। খাতির জমানোর উদ্দেশ্যে কাছে গিয়ে বসলাম। এধার-ওধার বিভিন্ন কথা শেষে কান্নার হেতু জিগ্যেস করি। হনুফা আমাকে অপেক্ষায় রাখে। এক মিনিট, দুই মিনিট… আমি ওর চেহারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। এই নীরবতা ভাল লাগে খুব। আবার কান্নার হেতুও জানতে মনে চায়। হনুফা নীরবতা ভাঙ্গে, ‘আমি বেশিদিন বাঁচবো না। বড় ধরনের একটা অসুখ হয়েছে। অনেক খরচের ব্যাপার। এতো টাকা কি আপনার নিকট আছে ?‘
অজপারাগায়ের মেয়ে । সাজিয়ে গুছিয়ে, স্থান কাল বুঝে, কিভাবে ধীরে সুস্থে একটি কঠিন কথা বলতে হয় জানে না। হনুফা এমনই সরল সোজা। পরম মমতায় মুখ চেপে ধরলাম। চুমু খেলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরল।‘
হাফিজ ভাই থামলেন। দুঃখ যখন ভারাক্রান্ত করে, মানুষ একনাগাড়ে বেশিদূর যেতে পারে না। দৌড় প্রতিযোগিতা হোক কিম্বা বিতর্ক। মানুষকে থামতেই হয়। তিনি মাথা তুলে একনজর আমাকে দেখলেন। হয়তো ভাবছেন, অনুজের সম্মুখে বয়স্ক কথাবার্তা ?
আমি চোখ নামিয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে মাথা ডান-বাম করলাম। সত্যি বলতে, হাফিজ ভাই বর্ণনার ক্ষেত্রে এতোটা সিরিয়াস এবং আন্তরিক ছিলেন, আমি মোটেও শরম পাইনি। সরলতাও একটি ব্যাপার। এই বাস্তবতা না বুঝতে পারলে মানুষের দুঃখ মূল্যহীন।
দুয়েক মিনিটের বিরতির পর হাফিজ ভাই আবার শেষের থেকে শুরু করলেন-
ফিসফিসিয়ে হনুফাকে বললাম ‘ কি সব অলক্ষুনে কথা বলছো? জীবন মরন আল্লাহর হাতে। যিনি আমারে খাওয়ান পরান, তিনি কি তোমাকে খাওয়াতে পরাতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।‘ কথাগুলো বলতে পেরে স্বস্তি অনুভব করলাম। তোর ভাবি একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। তোর ভাবির এই চিরায়ত দুঃখ আমার জন্য সুবিধা হল। দুঃখবোধ মানুষকে কত নিকটে আনে, টের পেলাম। গত দুইতিন মাসের বিয়ে সম্পর্কিত আড়ষ্টতা কেটে গেল।
বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় , তোর ভাবিকে খুব সংগোপনে পিজিতে নিয়ে গেলাম। প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ভদ্রলোক একপাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।‘
আমি বিচলিত হলাম না। রোগ দেয়ার মালিক আল্লাহ, আবার তিনিই আরোগ্য দান করেন। আমাদের প্রচেষ্টা করতে হবে। বড় ভাবিকে সবকিছু খুলে বললাম। একলাখ টাকার ব্যবস্থা হল। আমার কাছে ছিল দুইলাখ। তিনলাখ টাকা তোর ভাবির হাতে দিয়ে বললাম, মন খারাপের কিছুই নেই। কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ।‘
ঘটনার ঘনঘটায় আমার আপাদমস্তক বিভোর হলেও হাফিজ ভাইয়ের ব্যালেন্স প্রশংসনীয়। তৃতীয়বারের মত চা শিঙ্গাড়ার অর্ডার দিলেন। বারণ সত্ত্বেও যত্নের কসুর করছেন না। সময়ের দিকেও নজর রাখছেন।
চায়ের কাপটি মুখের কাছে নিয়েও চুমুক নামিয়ে রাখলেন , পরের ঘটনা বলা শুরু করলেন-
প্রত্যেকদিন কোনমতে অফিস করে ছুটতে হয় হাসপাতালে। খুব ব্যস্ত জিন্দেগী। শ্বাশুড়ি মা একদিন চড়া গলায় কামান দাগালেন, ‘আমার মেয়ের চিকিৎসা কি ঠিকঠাক মত হচ্ছে?’ বিনয়ের সাথে বললাম, ‘জ্বী আম্মা। আপনাদের দোয়া আর আল্লাহ পাকের অশেষ রহমত…‘ আমি যতটা বিনয়ী হলাম তোর ভাবি ঠিক তার উল্টো। আমার অসমাপ্ত কথার রেশ টেনে নিয়ে রেগেমেগে যা তা বলল, ‘রোগের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এখন বেচারাকে ধমকাও না? শাসন করো? আল্লাহ পাক তোমাদের এই জুলুমের বিচার অবশ্যই দুনিয়াতে করবেন।‘
শ্বাশুড়ি মা সরল সোজা মানুষ। আন্তরিক। মায়ের সম্মুখে হনুফার কড়া কথায় ভারি বিব্রত হলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কেঁদে ফেললেন। তোর ভাবির হাত ধরে বললাম, ‘ছি, মাকে এসব বলতে নেই। বেয়াদবি আল্লাহ পাকের অপছন্দ। মাফ চাও, প্লিজ।‘
তোর ভাবির প্রচন্ড অসুস্থতার সময়েও আমাকে আনন্দিত করার ব্যবস্থা সে করে রাখতো। নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দিত। তার পরিবারের কর্মকাণ্ডে তার ভিতর প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করত। চোখের পানি ছেড়ে বলত, ‘আমারে নিয়ে এতো কষ্ট করেন ক্যা?’
ঈষৎ হেসে বলতাম, কই, কষ্ট হচ্ছে কে বলল? আল্লাহ পাক যথেষ্ট সুখে রেখেছেন।‘
একদিন সন্ধ্যাবেলা তোর ভাবিকে দেখতে পিজিতে গিয়েছি। আশপাশে কেউ নেই। এধার-ওধার অনেক কথার পর আচমকা শক্ত হাতটি তার কোমল দুখানা হাতের মাঝখানে দলাইমলাই করল। মুখে রহস্যময় হাসি। ডানে-বামে সতর্ক চোখ বুলিয়ে মোক্ষম সময়ের তালাশ করছে । কিছু একটা বলবে হয়তো-বাঁ। বলল, একটা কথা বলি, রাগ করবেন না কিন্তু? বলেন, রাগ করবেন না?
বেচারীকে আনন্দে রাখার জন্য ওয়াদা কাটতে হল, ‘না, রাগ করবো না, বলো।‘ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে, ‘সুন্দর দেখে একটা মেয়েকে খোঁজেন। আমি আপনাকে সন্তুষ্ট দেখে মরতে চাই।‘
বিয়ে, মৃত্যু শব্দ দুটি পূর্বেও কয়েকবার বলেছে। ভাল লাগেনি। বিব্রত হই। আজকে যে করেই হোক মুখ বন্ধ করতে হবে।
কপট রাগত স্বরে বললাম, বিয়ে করব, শর্ত আছে।
-কী শর্ত ?
-প্রথমত তোমাকে একটি দায়িত্ব নিতে হবে।
– কী দায়িত্ব। হনুফার ব্যগ্র কণ্ঠ।
– তোমার মতো হুবহু একটি মেয়ে খুঁজে দিতে হবে…।
– অ্যাঁহ, এ কি সম্ভব ? হনুফা হার মানে।
মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করলাম এবার।
-যদি এই অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তর করতে পারো তবেই বিয়ের কথা বলবা। দ্বিতীয়বার যদি শুনি, আমি ভীষণ মন খারাপ করব।
কথাগুলো বলে হাফিজ ভাই খানিক বিরতি নিলেন। বিমর্ষতার ছাপ চেহারা জুড়ে। পরিবেশ গুমোট হয়ে ওঠে হাফিজ ভাইয়ের দুঃখে। সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাই না। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে চায়ের কাপের দিকে ইশারা করি। ‘ভাই, চা জুড়িয়ে গেল।‘ হাফিজ ভাইয়ের বুক ফুঁড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। । কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আবার শুরু করেন—
দ্বিতীয় বিয়ে প্রসঙ্গে তোর ভাবির মুখ বন্ধ হলে বটে তবে আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ গেল না। সারাক্ষণ বিমর্ষ হয়ে থাকে। ওর সামনে যতক্ষণ থাকা হত, শুধু হাসতাম। আনন্দে রাখতে চাইতাম। নতুন সান্ত্বনার বাণী শুনাতাম শিওরে বসে— ‘শোন, আদম সন্তান মানসিকভাবে যখন বিপর্যস্ত থাকে, রোগ ব্যাধি বিস্তার লাভের সুযোগ পায়। শয়তানের আন্তরিক চাওয়া এমনই। এ-ও বললাম, ‘অযথা টেনশন আত্মহত্যার শামিল।‘ হায়, মেয়ে মানুষের বুদ্ধি কত কম।
এভাবে ছয়মাস গেল। শত বেদনার মধ্যেও প্রাণ ছিল উৎফুল্ল। আমার নিকট ওর একটুখানি সান্নিধ্য ছিল, দৈনন্দিন জীবনের চাপ মুক্তিরও একটি পথ। হনুফার সারা তল্ পেটে ক্যান্সার ছড়িয়ে ভয়াবহ অবস্থা। রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি সবকিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হল। তারপর নিয়তিকে মেনে নিলাম। সব কষ্টকে দাফন করে হনুফা চলে গেল অনন্ত অসীমের পানে। টাকা খরচে কৃপণতা করিনি, আনুমানিক লাখ বিশেক টাকা খরচ হয়েছিল তবুও কোথায় যেন অপূর্ণতা থেকে গেল। আমার পরিবারের তরফে টাকার অংক নিয়ে কথা উঠল। আমি অবশ্য জানি না, এমন পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়?
আমি কী করে বোঝাই— যে মেয়েটি ছয়মাস আমার হৃদয় সিক্ত করেছিল, তার নিরন্তর ভালোবাসার তুলনায় এ টাকা নিতান্তই … অবৈধ প্রেম ভালোবাসা সত্যিকার প্রেমিকরে ভুল্ভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। আমারে কেউ বোঝে না রে , কেউ বোঝে না।‘
হাফিজ ভাই কাঁদলেন। নীরব নিঃশব্দ বোবা কান্না। তার সাথে একাত্ন হয়ে কাঁদলাম। নীরব কান্নার শক্তি টের পেলাম। নিরন্তর রেশ থেকে যায়।
সেদিন নবতর একটি সংযোগ তৈরি হল। যে কোন বিষয়ে আমার মতামত নেন, পর্যবেক্ষণ জানতে উন্মুখ থাকেন। অবসর টাইমে দুজন ঘুরতে বের হই।
আমার মাস্টার্স সমাবর্তন অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ বাকি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকবেন,তিনি প্রধান অতিথি। আমার পাহাড়সম ব্যস্ততা। এরইমধ্যে হাফিজ ভাই আমার মোবাইলে কল দিলেন। বিকালবেলা হাউস টিউটর স্যার আমাকে ডাকলেন, ‘হাফিজ নামের একজন তোমাকে কল করেছিল। কি একটা ইমার্জেন্সি কথা বলতে চায়।‘ কী এক অজানা কারণে ছেদ পড়েছে আমাদের সংযোগে। দীর্ঘদিন যাবত পরস্পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। হঠাৎ কেন স্মরণ হল কে জানে।
প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে ফোন দিলাম। হাফিজ ভাই বললেন, ‘আগামী সপ্তাহে আমার একজন ক্লোজ বন্ধুর বোনের বিয়ে। ছেলেকে আমি খুঁজে বের করেছি। ভালো ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের ঘটকালির দায়িত্ব জোর করে দিয়েছে। আমি নিরুপায়। ওরা বলেছে, বিয়েতে আমার থাকা লাগবে। কোনদিন কারো বিয়েতে যাইনি। আমার সাথে তুই কি যাবি ? তোর পড়ালেখায় যাতে করে ক্ষতি না হয় এই কারণে তোকে জ্বালাতন করি নি। আগামী সপ্তাহে তোর মাস্টার্স সমাবর্তন অনুষ্ঠান। পড়াশোনার চাপ নেই। সেই কারণে তোকে ফোন দিলাম। আমি সমস্ত কিছুর খোঁজখবর রাখি। আমার সাথে যাবি ভাই?’
চিরায়ত সরলতার পরিচয় রেখে কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলেন।
এমনভাবে আবদার করলেন,প্রত্যাখ্যান করতে পারি নি। চোখ ভিজে উঠল। স্বভাববিরদ্ধ গলায় বললাম, কেন যাবো না, অবশ্যই যাবো।
বিয়েতে গিয়েছি হাফিজ ভাইয়ের সাথে। যার সাথেই দেখা হয় অধমের পরিচয় তুলে ধরেন।‘আমার ছোটভাই। তুখোড় ছাত্র।‘ লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে শুনতে ভাল। নিপাট ভদ্রলোক। মুখটি সলজ্জ, হাসিমাখা। আমার বেশ পছন্দ হলো। ছেলের সামনে তার বাবা বসা। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি। ছেলেকে একপ্রকার ঘিরে রেখেছেন। কেন জানি, পৌঢ় ভদ্রলোকটিকে শুরু থেকেই পছন্দ হয়নি। বিয়েতে দুই একজন বিচিত্র মানুষ থাকেই। এরা উৎপাত করতে পাকা। রেডি হয়েই আসে।
বিয়ে হবে ইসলামি রীতিমতো। ইমাম সাহেব ছেলের সম্মতি এবং মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়ের বাবার সম্মতি নিয়ে আরবীতে খুতবা দিলেন। খুতবা পড়া শেষ হতেই ছেলের সম্মুখে বসা তার বাবা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, ‘এই বিয়ে হয়নি।‘ বিয়েতে দুই ধরনের চিৎকার আছে। একটা হলো, তরকারিতে ঝালের মাত্রা সম্পর্কিত চিৎকার। দ্বিতীয় নাম্বার, বিয়ে ভেঙে দেওয়ার চিৎকার। ছেলের বাবার যুক্তি, মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়ের বাবার সম্মতিতে কোন কাজ হবে না। স্বয়ং মেয়ের সম্মতি জরুরি। হাফিজ ভাই বললেন, ‘এটা তো ইসলামি রীতিতে বিবাহ। মেয়ের পক্ষ থেকে মেয়ের বাবার সাক্ষীই যথেষ্ট। মেয়েকে লাগবে কেন? পর্দা বলে তো কিছু আছে, তাই না?’
আর যায় কোথায়। হাফিজ ভাইকে কেন্দ্র করে বিরাট হই-হুল্লোড় । যাচ্ছে তাই অপমান। একজন ভদ্রভাবে বলল, ‘বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য এসব উপদ্রব কোথা থেকে আসে? ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত।‘
মেয়ে পক্ষ অসহায়। হাফিজ ভাইয়ের পক্ষ নিতে যেয়েও বিরত থাকল। বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। হাফিজ ভাই আজীবন চুপচাপ স্বভাবের লোক। আজকেও তার ব্যত্যয় হলো না। অবনত মস্তকে আমাকে সঙ্গে করে বের হয়ে আসলেন।
আমরা হাঁটতে থাকি। উত্তরা, এয়ারর্পোট, কুড়িল, বসুন্ধরা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, রামপুরা— আমরা হাঁটতেই থাকি। হাফিজ ভাইয়ের চেহারার মলিন ভাব কেটে যেতে থাকে। বিমর্ষতা পরিপূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সঙ্গ দিতে মনস্থ করেছি। অনাবিল হাসি ফুটবে এই আশা নিয়ে আমি হাঁটতে থাকি একজন দুঃখী মানুষের সঙ্গে।