আহমদ সিরাজি
আজকে প্রথম নিজে নিজে বের হলাম ডেলিভারি দেওয়ার জন্য। আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের দোকানে গেলাম– বাইক দুদিন যাবত উনার কাছে। অর্ডার নিয়ে চলে গেলাম। কী কপাল, একা একা দুইবার মোবাইলের স্টান্ট ভেঙ্গে পড়ে গেল। অর্ডার ক্যানসেল। অজানা দেশ, অজানা ভাষা। কী আর করা, মোবাইলে ট্রান্সলেটর দিয়ে যতটুক চালানো যায় কাজ। সীমাবদ্ধতা আছে। যাদের হোয়াটসঅ্যাপ নেই তারা তো সরাসরি কল দেয়। কথা তো আর ট্রান্সলেট করা যায় না টেক্সটের ক্ষেত্রে শুধু এই সুবিধা ।
নতুন রাস্তা, নতুন গন্তব্য কিছুই চিনি না। লোকেশন কোন জায়গা থেকে কোন জায়গা নিয়ে যাচ্ছে কে জানে ! গুগলের উপর ভরসা রাখতে হচ্ছে। মাগরিব নামাজের সময় হয়ে গেল। আসর নামাজ আব্দুর রাজ্জাক ভাইয়ের ওখান থেকে পড়ে এসেছি। মাগরিব নামাজের সময় চলে যাচ্ছে। নামাজের জন্য দিগ্বিদিক ছুটছি। কোথাও মসজিদ নেই। এক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। তার হাতের ইশারায় যা বুঝলাম, সেভাবেই হাঁটতে লাগলাম। একটা টিলার সামনে গিয়ে মোটরসাইকেল পার্ক করলাম। মাইক দেখে বুঝলাম এটাই মসজিদ। কয়েকটি বাচ্চা খেলাধুলা করছিল।
একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মসজিদে ঢুকব কীভাবে? ভদ্রলোক ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোনভাবেই বুঝাতে পারলাম না উদ্দিষ্ট কথাটি। অন্য এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসলেন, মুসাফা করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মসজিদে ঢুকবো কীভাবে? এ লোকও অসহায়। গুগল ট্রান্সলেটরের শরণাপন্ন হতে হল। অনেক চেষ্টা করলাম। ওই লোকটি আমাকে মসজিদে ঢোকার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চালালেন। হয়তো সবসময় এই মসজিদে নামাজ হয় না।
ওদিনের মাগরিবের নামাজের জন্য আমার খুবই আফসোস হলো। খুব পীড়া দিচ্ছিল। আল্লাহ মাফ করুন। দ্বিতীয় আরেকটি অর্ডার পেলাম। যেখানে অর্ডার ডেলিভারি দিয়েছি, সেখান থেকে দেখলাম ভিআইপি হোটেলের দূরত্ব বোঝার চেষ্টা করলাম। আইইউকে তে পড়ে আমাদের এক বড় ভাই। এবার ফাইনাল ইয়ারে। শুরু থেকে আমাকে যারপরনাই সাহায্য করে আসছে। প্রথম যেদিন আমি ডেলিভারির কাজ শুরু করলাম, সেদিন তিনি স্বয়ং নিজে গিয়ে আমার সাথে কাজ করেছেন। একবার আমার সাথে এই গলিতে যান তো আরেকবার অন্য গলিতে। এক তলা থেকে আরেক তলায় গিয়েছেন — এতটা আন্তরিক। অজানা-অচেনা লোককে সামান্য দিনের পরিচয়ে এত এত সাহায্য। সবাই আল্লাহর মেহেরবানী।
ভিআইপি হোটেল এখান থেকে দশ মিনিটের রাস্তা। জাকির ভাই আমার জন্য হেলমেট নিয়ে রেখেছেন, হেলমেট আনার জন্য সেখানে গেলাম। আজকে ৭০০ বা ৮০০ সওম ইনকাম হয়েছে। কিরগিজস্তানের মুদ্রাকে সওম বলে।
জাকির ভাইকে নিয়ে হোটেলে খাব বলে চলে গেলাম। বিশকেক শহরে এক মাস ২০ দিন বসবাস করছি। আজকেই প্রথম এক পাকিস্তানি হোটেলে ভরপেট বিরিয়ানি খেলাম– ২৭০ সওম করে। খাবার শেষে যার মোটরসাইকেল তাকে দিয়ে চলে আসলাম। তার কাছে আমার পাঁচ হাজার ডিপোজিট ছিল। যেহেতু দুই দিন দেখেছি– বললাম, ‘ভাই, তিন দিনের টাকা রেখে বাকি টাকাগুলো ব্যাক দেন। আমার জন্য অনেক কষ্ট হয়। কারণ এ দেশে আসলাম মেডিকেল পড়ার জন্য। যদি আমি আপনার বাইকের খরচ উঠাতে হয় তাহলে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে। অথচ যদি বাইক আমার নিজের হতো তাহলে এক হাজার সওম হলেই আমার এনাফ। কারন আমার প্রথম অগ্রাধিকার হল পড়াশোনা।’
ভিআইপি হোটেল চত্বর থেকে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম। রাত গড়িয়েছে অনেক। পিলারযোনিয়ার কোনো বাসে পেলাম না। হঠাৎ ১০ নম্বর একটা বাস আসলো। জিজ্ঞেস করলাম, বাস কি গুমছুম যাবে? হ্যা সূচক জবাব পেয়ে ভাল লাগল। বাসে উঠতেই স্থানীয় এক যুবক ডাকল। সন্দেহে নিপতিত হলাম। প্রথমে মন সায় দেয়নি। তবুও গেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি একা। এখন দেখছি, যুবকের সাথে আর তিন চারজন লোক আছে। সামান্য কথোপকথন হল। যুবক বলল, ‘এই বাসটা গুমছুয় হয়ে পিলারমনিয়ায় হয়ে যাবে। আপনি কই যাবেন?’
-পিলারমুনিয়া থেকেও আরো দূরে যাবো, ডেনজিয়াপিং এভিনিউতে।
-এখানে আপনি যে বাসে ওঠেন না কেন ২০ সওম করে দিতে হবে। পিলারমোনিয়া থেকে সোজা বরাবর আমার ঘর।
বাস পিরামুনিয়ার উল্টো সাইডে ব্রেক কষে। বাস থেকে নামলাম। সাথে পাকিস্তানের আরো চার ভাই। আমার তখন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিরগিজ যুবক ভাই বারবার বলছে, ‘এত রাত্রে কখনই বের হবেন না। আপনার ডেলিভারি ব্যাগটা এখানে নিয়ে আসেন।’ নিয়ে এলাম। ওরা সিট ছেড়ে আমাকে জায়গা করে দিল, বসে পড়লাম। এরপরও বিশ্বাস হলো না আর কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা?
‘এখানে লোকরা রাত হলে মদ খেয়ে মানুষকে অনেক মারে। আপনি বের হবেন না কখনোই।’ ওরা আমাকে উপদেশ দিতে লাগল। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না, এ কি আমার হিতাকাঙ্খী? তিনি আমার চাহনি দেখে হয়তো আন্দাজ করেছেন, আমি তাকে সন্দেহ করছি।
বাস থেকে নেমে হাটছিলাম। পিলারমনিয়ার পরিচিত জায়গা কেমন পরিচিত লাগছে। ভিতরে ভিতরে ঘাবড়ে যাচ্ছি। নীরবতা ভেঙ্গে বলে বসলাম, ‘আমি পিলারমোনিয়ায় যেতে চাই।’ ভদ্রলোক বললেন , ‘আমার বাসা পিছনের দিকে। আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে পিলারমনিয়াতে গাড়ি ধরিয়ে দিব। একা একা আপনাকে ছাড়তে চাচ্ছি না।’
ধীরে ধীরে তার প্রতি বিশ্বাস তৈরি হলো। রাত তখন বারোটার কাছাকাছি। নির্দেশনা অনুযায়ী সকল বাস সকালবেলায় আসবে। সাত নম্বর এবং নয় নম্বর বাস এলো বটে; কিন্তু ১৬৬ ও ৪২ নাম্বার বাসের কোনো দেখা নেই। আমার পকেট ও পর্যাপ্ত টাকা নেই যে ট্যাক্সি অর্ডার করবো। ভদ্রলোক বললেন, ‘ইয়েনডেক্স করে দিচ্ছি আপনাকে।’ চার যুবকের সম্মিলিত উদ্যোগে নিজেদের গাঁটের টাকা দিয়ে আমাকে ইয়েনডেক্স করে দিল। এখানেই শেষ নয়, আমাকে বারবার উপদেশ দিল,’ ড্রাইভার সাথে কোন রকম কথা বলবেন না।’ কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে এসেছে। বাসায় ফিরে আসলাম যথাসময়ে। স্বস্তি লাগছে খুব।
চিন্তা করলাম, কিসের টানে আমাকে তারা এতোটা সম্মান দেখাল? পরক্ষনে এ-ও ভাবি, ইসলামের বন্ধন বড়ই আশ্চর্য ধরনের। যেখানে মনুষ্যত্ব মানবতা আজও মাথা উঁকি দিয়ে ওঠে। তোমাদেরকে অনেক ভালোবাসি ভাই। দয়াময় তোমাদের মঙ্গল করুন।