সংগৃহীত ছবি
ডেস্ক, এম.জে.এফ নিউজ
২৩ জানুয়ারি ২০২৫
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মিত্র বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মূলত একসময়ের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের উদ্যোগে পৃথক দুটি জোট গঠনের প্রক্রিয়া এখন স্পষ্ট।
দলগুলোর একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি তাদের আন্দোলনের জোটসঙ্গীর পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমর্থন চায়। জামায়াতে ইসলামী শুধু ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করার প্রক্রিয়ায় বেশি সক্রিয়। তবে তারা অন্য দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টায় আছে।
বিএনপির বাইরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ তাদের আন্দোলন ও ভোটের রাজনীতিতে পৃৃথক জোট নিয়ে মাঠে ছিল। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দলটি এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারছে না। ফলে তাদের আগের ১৪ দলীয় জোটও এখন সক্রিয় নয়। এর বাইরে বাম দলগুলোর সমন্বয়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
জামায়াতের বাইরে মোটাদাগে বড় ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, জাকের পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি ও তরিকত ফেডারেশন। জোটের সমীকরণে এই দলগুলো গুরুত্ব পেয়ে থাকে। অতীতে বড় দলগুলো ভোটের হিসাব মেলাতে এই দলগুলোকে জোটে ভিড়িয়েছিল।
অবশ্য বিএনপি নেতারা এখনই দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাকে জোট গঠনের প্রক্রিয়া বলতে রাজি নন। তবে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বলছে, তাদের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দলগুলো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে।
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বরিশালের চরমোনাইয়ে যান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি চরমোনাইয়ের পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে বৈঠক করেন। তার আগে সেখানে তাঁরা মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন।
দল দুটির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আদর্শিক কিছু বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। এর মধ্যেই জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতা প্রথমবারের মতো চরমোনাই পীরের বাড়িতে আতিথেয়তা নিলেন। এটিকে দল দুটির আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আগে সম্পর্কোন্নয়ন চায় বিএনপি, পরে জোট
বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, দলগুলোর সঙ্গে মতের মিল হলে তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোটও হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে সম্পর্কোন্নয়ন ও আস্থার সম্পর্ক তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এরই মধ্যে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন নেতা বলেন, আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে তাঁদের এক ধরনের বোঝাপড়া আছে। এখন ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে মতের মিল তৈরি করতে চাচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেক দলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়েছে। ওই যোগাযোগটা দৃশ্যমান করতে এখন আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু হয়েছে।
দলটির নেতারা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ধর্মভিত্তিক দলের বেশির ভাগ তাদের ২০ দলীয় জোটে ছিল। ফলে তাদের সঙ্গে মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য আগে থেকেই আছে। ২০ দলীয় জোটের বিলুপ্তি এবং কিছু দলের জোট ত্যাগের মাধ্যমে এক ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি বিবেচনায় অতীত ভুলে এক ছাতার নিচে আসার তাগিদ অনুভব করছেন তাঁরা।
দলীয় সূত্র জানায়, মিত্র বাড়ানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার একসময়ের জোটচ্যুত দল খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। ধারাবাহিকভাবে অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হবে। তবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি বৈঠক করবে কি না, তা নিয়ে দলে দুই ধরনের আলোচনা আছে।
অবশ্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের এই উদ্যোগ নিয়ে রাজনীতিতে নানা আলোচনা রয়েছে। বিএনপির একসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। বিএনপি এত দিন আলোচনা আন্দোলনের সঙ্গীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও এখন ধর্মভিত্তিক দলকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, রাজনৈতিক বোঝাপড়া সুদৃঢ় করতে বন্ধুপ্রতিম দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা নিয়মিতই তাঁরা করে আসছেন। এখন দেশে ভিন্ন পরিস্থিতি চলছে, ফ্যাসিবাদীদের নানা ষড়যন্ত্রও বিদ্যমান। এসব বিষয়ে সবার ঐকমত্যের তাগিদে সময়ে সময়ে নানা বিষয়ে আলোচনা চলছে।
ইসলামপন্থীদের এক ব্যালট চায় জামায়াত
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা না জোট হবে, বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বে ইসলামপন্থীদের ভোটের একটি ব্যালট চায় দলগুলো। এরই মধ্যে দলগুলোর এক ধরনের বোঝাপড়া হয়েছে দাবি করছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন।
ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে তাঁরা কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছেন। ইসলামী ধারার দলগুলো এক ছাতার নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। সেই চাওয়া থেকে একটি জোট বা নির্বাচনী সমঝোতা করার প্রক্রিয়া চলছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জামায়াত রাজনীতিতে খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের ধারাবাহিক বৈঠকে একটি ‘ইসলামী জোট’ গঠনের উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক ‘শত্রু’ হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গেও বৈঠক করে দলটি।
বৃহৎ জোট গঠনে গত ২০ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কওমি মাদরাসাভিত্তিক কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলধারার সাতটি ইসলামী দলের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। এর পাশাপাশি কয়েকটি অনিবন্ধিত ইসলামী দল এবং গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্যাতনের শিকার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে যৌথ মতবিনিময় করেছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান বলেন, এত দিন আদর্শভিত্তিক জোট করতে পারেননি তাঁরা। এটা তাঁদের ভুল হয়েছে। এখন তাঁরা ইসলাম কায়েমের লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়েছেন। এটি নির্বাচনী জোট না হয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা হতে পারে। যা-ই হোক, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একটি ব্যালট চায় মানুষ।
বিএনপি ও খেলাফতের বৈঠকে ৭ বিষয়ে ঐকমত্য
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একসময়ের ‘জোটচ্যুত’ দল খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠক করল বিএনপি।
গতকাল বুধবার দুপুরে গুলশানের কার্যালয়ে দলটির প্রধান দুই নেতাসহ ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তাঁরা প্রায় দুই ঘণ্টা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
দুই দলই দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করাসহ সাতটি বিষয়ে একমত হয়েছে।
খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিষয়টি জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতার বৈঠকের বিষয়টি সামনে আনেন সাংবাদিকরা। এ বিষয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাঁরা রাজনীতি আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাদের সঙ্গে মতের মিল হবে, তাদের সঙ্গে কাজ করার চিন্তা করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ নিয়ে কারো কোনো দুশ্চিন্তা থাকার তো কোনো কারণ নেই।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একসময় এক দল আরেক দলের বিরোধিতা করেছে, সমালোচনা করেছে, আবার আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা একমত হয়েছে, এতে অস্বাভাবিক কী আছে! আজকে যারা একমত, কালকে তারা একমত না-ও হতে পারে। এটাও ঘটেছে বাংলাদেশে বহু, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে! কাজেই এ বিষয়গুলো নিয়ে দুশ্চিন্তার বা মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তারা (জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন) তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে যা উচিত মনে করবে, নিশ্চয়ই তা করবে।’
তিনি বলেন, ‘যাঁরা দীর্ঘদিন আমাদের আন্দোলনের সাথি ছিলেন, একসঙ্গে জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছি, যুগপৎ আন্দোলন করেছি এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে যারা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল, তার মধ্যে খেলাফত মজলিস অন্যতম।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেছেন। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে কী করণীয়, এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একমত হয়েই আন্দোলন করেছি বহু বছর ধরে। এ আলোচনায় আমাদের মধ্যে তেমন কোনো দ্বিমত নেই, আমরা একমতই হয়েছি।’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, জাতির স্বার্থে ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য জরুরি। এ ব্যাপারে তাঁরা একমত হয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সাতটি বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, তা হলো জাতীয় ঐক্য সুসংহত করার জন্য আন্তর্দলীয় সংলাপ অব্যাহত রাখা; দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা; দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ; আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া; ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত ও ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখা; পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য জাতীয় ঐক্য অটুট রাখা; খুন, গুম, হত্যা, নির্যাতনে জড়িতদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা; আওয়ামী সরকারের সময় আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা।’
বৈঠকে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদের নেতৃত্বের দলের ৯ জন নেতা অংশ নেন।
খেলাফত মজলিস ২০২১ সালে জোট ছেড়ে যায়। এরপর এই প্রথম তারা বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করল। যদিও গত মাসে খেলাফত মজলিসের সম্মেলনে তারা বিএনপির মহাসচিবসহ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
সূত্র: news24bd.tv