Home শিল্প সাহিত্যকড়া শাসনের অন্তরালের গল্প

কড়া শাসনের অন্তরালের গল্প

by MD JUNAYED SHEIKH
স্মৃতিগদ্য



এক শীতের দিনের কথা। টিপটিপ করে সন্ধ্যা নেমে এসেছে আমাদের আঙ্গিনায়। মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সান্ধ্যকালিন কাজে। রুটিন মাফিক কাজগুলো এক হাতেই করে যাচ্ছেন নির্ভুল ভাবে– এক মুহূর্ত ফুরসৎ নেই। হারিকেনের চিমনি পরিস্কার করে টেবিলের উপর রেখে কুপিটা ধরালেন। মুরগিগুলোকে খোপে তুলে দিলেন তাড়া দিয়ে। এবার যাবেন কলপারে ওযু সারতে।


মায়ের দৈনন্দিন কাজগুলো যথারীতি সম্পন্ন হয় তবে কখনো এতটা গভীরভাবে নিরক্ষনের সুযোগ হয়নি। আজকে সব দেখছি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। এর পিছনে একটি নিগূঢ় রহস্য আছে। রহস্যটি সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সম্পর্কিত।


বলেই ফেলি, পাশের বাড়িতে নতুন বউ আসবে। আমাদের সমাজে নতুন বউ কেন্দ্রিক কিছু ফরম্যালিটি পালিত হয়। পরিচিত পরিসর ছেড়ে নতুনত্বে মানিয়ে নিতে বরের মা চাচিরা উৎসব কওে থাকেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এ ক্ষেত্রে পর্দা পুশিদার কোন বালাই থাকে না। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে হিন্দুয়ানী প্রথা পুরোদমে উপস্থিত। ধার্মিক লোকদের দৃষ্টিতে এর নাম ‘তামাশা’।


বউ দেখা অনুষ্ঠানের জন্য দাদা অর্থাৎ বড়ভাই উন্মুখ হয়ে আছেন সকাল থেকে। বয়স, গাম্ভীর্যতা সহ বেশ কিছু কারণে দাদার সাথে অলঙ্ঘনীয় একটা দূরত্ব আছে, তবুও কেন জানি তিনি তার গোপন দুরভিসন্ধি মূলক কর্মকান্ডে আমাকে সঙ্গী করলেন।


আমার তখন সবে মুসলমানি হয়েছে। হাঁটাচলায় সীমাবদ্ধতা আছে, ইচ্ছে করলেই কোথাও যেতে পারছি না। আমার বিপুল বিস্তৃত পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। মুসলমানি পরবর্তী হাজামের দেয়া নির্দেশনাগুলো মা পালন করছেন অক্ষরে অক্ষরে। এর মধ্যে অন্যতম, ক্ষত জায়গায় নিয়ম করে তেল দেয়া। মাগরিবের আযান আসন্ন। ঘরের সান্ধ্যকালিন কাজগুলো গুছিয়ে এনে আমার সেবা-শুশ্রূষায় মনযোগী হবেন।


আব্বা মাদ্রাসার ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। মাগরিবের পরে সাধারণত বাড়ি আসেন না, এশার নামায আদায় করে তারপর বাড়িমুখী হন। দাদা এটিকে দারুণ সুযোগ হিসেবে লুফে নিয়েছেন। তার সহপাঠীরা মাদ্রাসায় খুব অনুশাসনের মধ্যে পড়াশোনা করলেও বাড়িতে ঠিক উল্টো পরিবেশ; কিন্তু আমাদের বাড়ির পরিবেশ ঠিক মাদ্রাসার মতই। দাদার জন্য যা ছিল বেশ কষ্টদায়ক। তবে প্রতিবাদ আন্দোলনের কোন স্পর্ধা ছিল না চরিত্রে। মাগরিব বাদ দাদা কুরআন তেলাওয়াতে বসেছেন বটে কিন্তু মনটাকে রেখেছেন বহুমুখি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ। আড় চোখে মাকে দেখছেন, উৎকীর্ণ কানটাকে রেখেছেন রাস্তায়। বাজারের পাশেই আমাদের বাড়ি। খবরাখবর স্পষ্ট টের পাওয়া যায়।


এশার আযানের আগ মুহূর্তে নতুন বউ গাড়ি থেকে নামতেই কিছুটা কোলাহল শোনা গেল। দাদা আমাকে চোখ টিপ দিয়ে বের হয়ে গেলেন পায়খানার চাপের কথা বলে। রাতের খাবারের আয়োজনে মার মনোযোগ কিছুটা শিথিল। মুহূর্তে চম্পট দিলাম। পাশের বাড়ির উঠোনে পৌঁছতেই দেখি নতুন বউকে কেন্দ্র করে তামাশা আরম্ভ হয়ে গেছে।


হ্যাজাক বাতির রোশনিতে দারুণ লাগছে চারপাশ। পুরো বাড়িতে উৎসবের রং লেগেছে। আমার বসার জায়গা হয়েছে একেবারে বর-কনের সামনে। তিন চার হাতের দূরত্ব। একটু পরেই নাচ শুরু হবে। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের আবশ্যিক অনুষঙ্গ। পুরো বাড়ির আকাশে-বাতাসে আনন্দেরা দলবেঁধে ঘুরছে। কিন্তু আমি পুরোপুরি একাত্ম হতে পারছি না। হাঁটু গেড়ে বসে আছি। দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ছেয়ে আছে হৃদয় জুড়ে। দাদার মনে কী খেলা করছে কে জানে।


জনাকীর্ণ বাড়িতে হঠাৎ আমার বড় ফুফুকে আবিস্কার করলাম। আত্মারাম খাঁচা হওয়ার যোগাড়। কেরোসিনের কুপি হাতে ব্যাকুল হয়ে আমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সম্মুখ সারিতে থাকায় ফুফুকে আমি দেখতে পেয়েছি কিন্তু তার ব্যাকুলতায় সাড়া না দিয়ে বরং নিজেকে লুকাতে ব্য¯ত্ম হয়ে পড়লাম। ফুফুকে কোনদিন ভয় পাই নি, কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আপাদম¯ত্ম ক তীব্র ভয় জাপটে ধরেছে। তার চেহারায় আব্বা-মার ছাপ দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট, তাদের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন। ভয়টা মূলত এখানে।


২.


চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সুনসান রা¯ত্মা ভুতুড়ে একটা অনুভূতি জাগিয়ে গেল। কুপির আলোয় সতর্কতার সাথে পথ চলছি। বিয়ে বাড়ি থেকে আমাদের দুই বাড়ির দূরত্ব মাত্র কয়েক মিনিটের। সারা পথ একটাই প্রার্থনা করলাম, দুই মিনিটের রাস্তাটি যেন অনন্তকালের হয়ে যায়। ফুফু অভয় দিচ্ছিলেন। কিন্তু আব্বার মেজাজ প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা ভাই-বোনেরা ওয়াকিফহাল– ফুফুর নরম কোমল সান্ত্বনা না মন ভরাতে পারছে না।


শীতের রাত তবুও ঘেমেনেয়ে একাকার। বাড়ি যত নিকটবর্তী হচ্ছে, ঘামের পরিমাণ বাড়ছে শুধু। আমাদের প্রার্থনা সেদিন মঞ্জুর হয় নি।

পুরো বাড়ি অন্ধকার। আমাদের গ্রামে তখনো ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি। দরজার আবডালে আব্বা আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। হাতে ছিল কাঠের এবড়োখেবড়ো চলা। ঘরে ঢুকতেই পিঠের উপর ধমাধম ঘুষি। দাদা ছিলেন আমার খানিকটা পিছে। আমাকে ছেড়ে দাদার পিঠে একটা ঘুষি পড়েছে। ধপাশ করে পতনের আওয়াজ। চোখের পলকে দাদা গায়েব। আব্বা রাগে ক্ষোভে ফুঁসছেন। ‘বড়ডা কই গেল, ওরে আজকে দিয়ে দেবো ঢক মত’ ইত্যাদি বলে হাতের লাঠি ঘুরুচ্ছেন। বড়বোন ভীত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঝড়ের গতিবেগ কমে যাওয়ায় তার মুখে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বোনেরা চিরকালই ভাইদের প্রতি স্নেহপরায়ণ। দাদার অন্তর্ধানের খবর তিনি জানেন। তবুও নীরব , নির্বাক একেবারে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দাদা খাটের তলে চুপটি করে বসে আছেন। কোন মুহূর্তে গেল কে জানে!


ফুফু আর বড়বোনের প্রচেষ্টায় আব্বা কিছুটা শান্ত হলেন। রাগে ক্ষোভে তখনো ফুঁসছিলেন। ধীরে ধীরে বিছানায় গেলেন। মুসলমানির কারণে আমার উপর দিয়ে ঝড়ঝাপটা কম প্রবাহিত হলেও হৃদয়ের উপর ভয়ের ছাপ কার্যকর করে রেখে গেল আজীবন। হিন্দুয়ানি প্রথা পালনের উপর আব্বার সেই চপেটাঘাতের কথা হৃদয়ে আজও অমলিন। আজকে স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও অনুশাসন মনে আছে দারুণভাবে।


দীর্ঘদিন উলামায়ে কেরামে খেদমতে থাকার সুবাদে ছেলে-মেয়েদেরকে তালিম-তরবিয়াতের পদ্ধতিও শিখে নিয়েছেন হাতে কলমে। এর যথাযথ প্রয়োগ কিম্বা অনুশীলন ঘটিয়েছেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে। নিষ্কলুষ যৌবন উপহার দেয়ার লক্ষ্যে শৈশব থেকেই কঠোরতা আরোপ করেছেন, বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি। এবং তরবিয়তের ক্ষেত্রে নিজের পরিবারকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। শরিয়তের বিধি-বিধান লঙ্ঘন তার মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে সবসময়।


আব্বা তাঁর এই দীর্ঘ চলমান প্রচেষ্টায় কতটুকু সফল হয়েছেন জানি না, তবে নিবিড় চেষ্টা আন্তরিকতার কমতি ছিল না , নিঃসন্দেহে। তাঁর ছায়া আমাদের উপর দীর্ঘায়িত হোক প্রভুর কাছে নিরন্তর এই কামনা।

লেখাটি ”মাসিক নবধ্বনি, ২৪ ডিসেম্বর” সংখ্যায় পূর্ব প্রকাশিত

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment