আব্দুল্লাহ আল-হুরায়নী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একবার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুওয়াযযিন হযরত বিলাল রাযিআল্লাহু আনহুর সাথে হালব শহরে (আলেপ্পো নগরীতে) সাক্ষাৎ করলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, হে বিলাল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যয় (দান-ছাদাক্বা) সম্পর্কে আমাকে বলুন।
তিনি বললেন, তাঁর নবুওয়াত লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর (প্রায়) সব ব্যয় সংক্রান্ত দায়িত্বই তাঁর পক্ষ থেকে আমি পালন করতাম। তাঁর কাছে যখন কোন মুসলমান আসত আর তিনি তাকে অভাবী মনে করতেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিতেন। আমি বেরিয়ে পড়তাম এবং কারো থেকে ধার নিতাম, তারপর তা দিয়ে চাদর ও অন্য কিছু কিনে তাকে পরিধেয় ও আহার্য দান করতাম। অবশেষে একদিন এক মুশরিক আমার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, হে বিলাল! আমার যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ আছে। সুতরাং তুমি আমার নিকট থেকে ছাড়া অন্য কারো থেকে ধার নিও না। তখন আমি তাই করলাম।
এরপর কোন একদিন আমি ওযূ করে আযান দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছি এমন সময় ঐ মুশরিককে একদল ব্যবসায়ীর মাঝে দেখতে পেলাম। তারপর সে আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, হে হাবশী! বিলাল বলেন, আমি তাকে বললাম, বল। সে আমার উপর আক্রমণ করল এবং কঠোর বা গুরুতর অন্যায় কথা বলল। সে বলল, তুমি কি জান, একমাস পূর্ণ হ’তে আর কয়দিন বাকী ? আমি বললাম, সামান্য কয়েকদিন। তখন সে বলল, তোমার মেয়াদ পূর্ণ হতে আর চারদিন বাকী। এরপর আমার পাওনার বিনিময়ে আমি তোমাকে পাকড়াও করব। কেননা তোমাকে যে ঋণ আমি দিয়েছি তা তোমার বা তোমার নবীর সম্মানার্থে নয়। আমি তো এজন্য তোমাকে ঋণ দিয়েছি যে, তার মাধ্যমে তুমি আমার দাসে পরিণত হবে আর আমি তোমাকে মেষ চরাতে পাঠাব, যেমনটি তুমি পূর্বে করতে।
বিলাল রাযিআলস্নাহু আনহু বলেন, তখন আমার অন্য দশজনের মত মনকেও দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসল। আমি (সেখান থেকে) প্রস্থান করলাম এবং ছালাতের আযান দিলাম।
অবশেষে আমি যখন এশার ছালাত আদায় করলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সহধর্মিণীগণের কাছে ফিরে গেলেন তখন আমি তাঁর সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, ঐ মুশরিকটি, যার কথা আমি আপনার কাছে উল্লেখ করেছিলাম– আমি তার নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করতাম। সে আজ আমাকে এমন এমন কথা বলেছে (ঋণ পরিশোধের চাপ দিয়েছে)। অথচ আপনার বা আমার কারও কাছেই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা নেই। সুতরাং সে তো আমাকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বে।
নবীজি আমাকে ইসলাম গ্রহণকারী এই মহল্লাবাসীদের কারো কারো কাছে যেতে বললেন, যাতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে এমন কিছু দান করেন, যা দিয়ে আমি আমার দেনা পরিশোধ করবে। সেখান থেকে বের হয়ে আমার বাড়িতে আসলাম এবং আমার তরবারি, বল্লম, বর্শা ও পাদুকা আমার শিয়রের কাছে রাখলাম, আর আমার মুখমন্ডল দিগন্তমুখী করে রাখলাম। ফলে যখন আমার ঘুম আসছিল তখনই আমি জেগে উঠছিলাম। এরপর যখন রাত ঘনিয়ে এসেছে অনুভব করলাম তখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
অবশেষে ভোরের প্রথম আলো প্রকাশ পেল। আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি ডেকে বলছে, হে বিলাল! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ডাকে সাড়া দাও।
আমি নবীজির নিকট যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম। এমন সময় দেখতে পেলাম পিঠে বোঝাসহ চারটি উট। আমি নবীজির কাছে এসে তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করলাম। নবীজি আমাকে বললেন, বিলাল সুসংবাদ গ্রহণ কর। আল্লাহ তোমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছেন। আমি আল্লাহর হাম্দ ও শোকর আদায় করলাম।
নবীজি বললেন, তুমি কি বসিয়ে রাখা উট চারটি অতিক্রম করে আসো নি? আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি বললেন, এই উটগুলি ও এগুলোর পিঠের উপর যা কিছু রয়েছে, তুমি সবকিছুর মালিক। তখন আমি দেখতে পেলাম উটগুলোর পিঠে খাবার ও পোষাক সামগ্রী রয়েছে, যা ফাদাকের শাসক তাঁর কাছে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠিয়েছেন। নবীজি বললেন, এগুলি তুমি নিয়ে যাও এবং তোমার ঋণ পরিশোধ করে দাও।
বিলাল বলেন, আমি তাই করলাম। প্রথমে সেগুলোর পিঠের বোঝাগুলি নামিয়ে সেগুলোকে ঘাস খাওয়ালাম। তারপর ফজরের আযান দিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছালাত শেষ করলে আমি বাকীউল গারক্বাদের দিকে বের হয়ে গেলাম। আমি কানে আঙগুল ভরে উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলাম, যাদের নবীজির নিকট কোন পাওনা আছে তারা যেন উপস্থিত হয়।
এভাবে আমি পণ্যসামগ্রী বিক্রয় করে করে ঋণ পরিশোধ করতে থাকলাম। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট পৃথিবীর আর কারো কোন পাওনা অবশিষ্ট রইল না। পরিশেষে আমার কাছে দুই বা দেড় উকিয়া স্বর্ণ রয়ে গেল। আমি মসজিদে গেলাম, কিন্তু বেলা হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ লোক চলে গেছে।
এসময় আমি দেখতে পেলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাকী মসজিদে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম করলে তিনি বললেন, তোমার পূর্বের ঋণের কি অবস্থা? বললাম, আল্লাহর রাসূলের সকল ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, এখন কিছুই বাকী নেই। তিনি বললেন, কিছু বাড়তি রয়েছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ, দুই দীনার। তিনি বললেন, দেখ, সে দু’টি থেকে আমাকে স্বস্তি দিতে পার কি-না? সে দু’টি থেকে তুমি আমাকে রেহাই না দেওয়া পর্যন্ত আমি আমার পরিবারবর্গের কারো কাছে যাচ্ছি না।
কিন্তু আমাদের কাছে কোন প্রার্থী আসল না। তাই নবীজি মসজিদে রাত্রি যাপন করলেন। এমনকি দ্বিতীয় দিন সকাল ও দুপুর মসজিদেই অবস্থান করলেন। অবশেষে দিন শেষে দু’জন আরোহী আসল। তখন আমি তাদেরকে নিয়ে গিয়ে দীনার দু’টি দ্বারা তাদের জন্য খাদ্য ও পোষাকের সংস্থান করলাম।
অবশেষে যখন তিনি এশার ছালাত পড়লেন তখন আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছের দীনার দু’টির কি খবর? আমি বললাম, তা থেকে আল্লাহ আপনাকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। তখন তিনি তাঁর কাছে দীনার দু’টি থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হ’তে পারে এই আশঙ্কা থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহু আকবার ও আলহামদুলিল্লাহ বললেন। এরপর আমি তাঁর পিছু পিছু চললাম। অবশেষে তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছে এসে তাঁদেরকে একজন একজন করে সালাম করলেন এবং তিনি তাঁর রাত্রি যাপনস্থলে পৌঁছলেন।
বর্ণনাকারী আব্দুল্লাহ আল-হুরায়নীকে হযরত বেলাল রাযিআল্লাহু আনহু বললেন, আর এটাই ঐ বিষয়, যে সম্পর্কে তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে।
সূত্র (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৬/৫৫ ; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৬৩৫১,)