সিয়েরা স্পেসের তৈরি এই গোলক চাঁদের অনুরূপ তাপমাত্রা ও চাপ তৈরি করতে পারেছবি: সিয়েরা স্পেসের ওয়েবসাইট থেকে
এম.জে.এফ নিউজ- ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
বিশাল একটি গোলকের মতো কোটরে ঢুকে সরঞ্জামগুলো খুঁটিয়ে পরখ করলেন প্রকৌশলীরা। তাঁদের সামনে রঙিন তারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো বিদঘুটে চেহারার রুপালি এক ধাতব যন্ত্র। কলকবজার এই বাক্সটিই একদিন চাঁদে অক্সিজেন তৈরি করবে বলে তাঁরা আশা করছেন।
প্রকৌশলীদের দলটি গোলক থেকে বেরোনোর পর পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হলো। বাক্সের মতো দেখতে যন্ত্রটি অল্প অল্প করে গিলে নিতে থাকল এক পরত ধুলায় ধূসর মাটি-পাথরকণা, ইংরেজিতে যাকে বলে রেগোলিথ। ধুলা ও ধারালো কণাময় এই আস্তরণের রাসায়নিক মিশ্রণ চাঁদের আসল মাটির মতোই।
কিছুক্ষণের মধ্যে এই আস্তরণ গলে থকথকে এক দ্রবণে পরিণত হলো। এর একটি স্তরের তাপমাত্রা ১ হাজার ৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেল। দ্রবণটির সঙ্গে কিছু বিক্রিয়াকারী পদার্থ বা বিক্রিয়ক যোগ করার পর অক্সিজেনযুক্ত অণুগুলো বুদ্বুদ করে বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
বেসরকারি কোম্পানি সিয়েরা স্পেসের একজন প্রোগ্রাম ম্যানেজার ব্র্যান্ট হোয়াইট বললেন, ‘পৃথিবীতে করা যায়, এমন সবকিছু আমরা পরীক্ষা করে সেরেছি। আমাদের পরের কাজটি হচ্ছে চাঁদে যাওয়া।’
সিয়েরা স্পেসের এই পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল চলতি গ্রীষ্মে, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে। কেবল এটি নয়, ভবিষ্যতে চাঁদে একটি ঘাঁটি গড়া হলে সেখানে থাকা নভোচারীদের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে গবেষকেরা এই ধারার আরও অনেক প্রযুক্তি নিয়েই কাজ করছেন।
ভবিষ্যতের সেই নভোচারীদের শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন লাগবে। চাঁদ থেকে মঙ্গল গ্রহসহ অন্যান্য দূরের গন্তব্যে নভোযান পাঠাতে চাইলে তাঁদের রকেটের জ্বালানি তৈরি করতে হবে। অক্সিজেন সে জন্যও লাগবে।
চাঁদের ঘাঁটিতে বসবাসকারী নভোচারীদের ধাতুরও প্রয়োজন হতে পারে। এই ধাতু তাঁরা চন্দ্রপৃষ্ঠে ছড়িয়ে থাকা ধুলায় ধূসর মাটি-পাথরকণা থেকে আহরণ করতে পারবেন। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে এই সম্পদগুলো কার্যকরভাবে আহরণের উপযোগী পারমাণবিক চুল্লিগুলো তৈরি করার ওপর।
ব্র্যান্ট হোয়াইট বলেন, ‘এটা অভিযানের খরচ থেকে কোটি কোটি ডলার বাঁচাতে পারবে।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এটা না করা গেলে পৃথিবী থেকে চাঁদে বাড়তি ধাতু ও বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন নিয়ে যেতে হবে, সেটা হবে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল।
সৌভাগ্যের বিষয় হলো, চাঁদের ধুলামাটি-পাথরকণা বা রেগোলিথ ধাতব অক্সাইডে পরিপূর্ণ। কিন্তু ধাতব অক্সাইড থেকে অক্সিজেন আহরণের বিজ্ঞান পৃথিবীতে যেমনটা ভালোভাবে জানা-বোঝার আয়ত্তে এসেছে, চাঁদে সেটা কার্যকর করা বেশ কঠিন।
গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে সিয়েরা স্পেসের পরীক্ষা–নিরীক্ষাগুলো যে বিশাল গোলক আকৃতির কোটরে চালানো হয়েছিল, এ বছর সেখানে মহাশূন্যের আদলে বায়ুশূন্য (ভ্যাক্যুয়াম) একটি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া সেখানে চাঁদের মতো তাপমাত্রা ও চাপ তৈরি করা হয়।
সিয়েরা স্পেস জানিয়েছে, চাঁদের অত্যন্ত কর্কশ ও এবড়োখেবড়ো ধুলামাটি-পাথরকণা নিয়ে কাজ করার জন্য তাদের যন্ত্রটিকে পর্যায়ক্রমে উন্নত করতে হয়েছে। ব্র্যান্ট হোয়াইট বলেন, এই ধুলা-পাথরকণা সবকিছুর মধ্যে ঢুকে পড়ে।
এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে পৃথিবীতে বা এমনকি তার আশপাশের কক্ষপথেও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। সেটি হচ্ছে, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণশক্তি। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণশক্তি বা মহাকর্ষ বল মোটাদাগে পৃথিবীরটির প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ।
সরেজমিনে চাঁদে কম মাধ্যাকর্ষণশক্তির আওতায় উপগ্রহটির নিজস্ব ধুলামাটি-পাথরকণা দিয়ে তাদের যন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে সিয়েরা স্পেসের আরও কয়েক বছর লেগে যাবে। হয়তো ২০২৮ সালের আগে এটা সম্ভব হবে না। আরও দেরি হতে পারে।
জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের পল বার্ক বলছেন, প্রকৌশলীরা মোকাবিলার লাগসই ব্যবস্থা না রাখলে অক্সিজেন আহরণের কিছু প্রযুক্তির জন্য চাঁদের মাধ্যাকর্ষণশক্তি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সূত্র: বিবিসি