সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার জন্য যিনি আমাদেরকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।
আজকে আলোচনার মূল বিষয়– পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কিভাবে করবো।
উম্মত হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ মানার পরে আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে,পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একবার এক সাহাবী এসে জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পিতা-মাতা বেঁচে আছে ?
সাহাবী বললেন, জ্বি আছে।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, فجاهدبهما অর্থাৎ বাবা-মা’র খেদমত করো।
আল্লাহ তা’আলা এতেই তোমার জন্য জিহাদের মর্যাদা রেখেছেন।
সুতরাং যদি কারো পিতা-মাতা অসুস্থ হন আর তাঁদের খেদমত করার মত কোন লোক না থাকে, আর জিহাদ ফরজে আইন না হয়, তবে তাদের খেদমত করা উত্তম।
আরো এক সাহাবী নবীজির কাছে এসে বললেন,
اي الاسلام خير قال بر الوالدين
অর্থাৎ ইসলামের ভিতরে উত্তম কি ?
পেয়ারা নবী বললেন, পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার।
দুনিয়ার সবকিছুর বিকল্প আছে কিন্তু মাতা- পিতার মত কল্যানের কোন বিকল্প নাই।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وقضى ربك الا تعبدوا الا اياه وبالوالدين احسانا
তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছে যে তার এবাদত কর এবং পিতা মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর ।
সদ্ব্যবহার কিভাবে করব ?
এটা একটা দারুণ প্রশ্ন। উত্তরে বলা যায়,যখন যেটা প্রয়োজন।
কথা দিয়ে, কাজ দিয়ে, টাকা- পয়সা, ঔষধ যখন যেটা প্রয়োজন সবকিছু দিয়ে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
اما يبلغن عندك الكبر احدهما او كلاهما
পিতা-মাতা উভাই বা একজন বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের কথায় তুমি উফ শব্দ বলিও না।
মনে রাখতে হবে, মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন তার মেজাজ একটু শক্ত হয়ে যায়।
প্রবাদ আছে,বুড়ো আর গুড়ো সমান।
অর্থাৎ মানুষের যখন বেশি বয়স হয়ে যায় তখন সে তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে।
এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,
ومن نعمره ننكسه في الخلق
আমি যাদেরকে বয়স বাড়ায় দেই তার মায়ের পেট থেকে যেমন এনেছি তার থেকে কমিয়ে দেই। যেমনঃ
শরীরের গঠন ঠিক থাকে না,
শ্রবণ শক্তি ঠিক থাকে না,
দৃষ্টি শক্তি ঠিক থাকে না ,
চাহিদা থাকে না।
আল্লাহ তায়ালা এসব কমিয়ে দেন। কমতে কমতে এক সময় নিস্তেজ হয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
এরকম অবস্থা যখন হবে, তখন তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করো, নরম কথা বল, হাসিমুখে থাকো,কোমল ব্যবহার কর, কর্কশ ব্যবহার করিও না, রাগ করিও না।
যে সন্তান পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করবে আগামীতে সে যখন এমন বিরক্ত হবে তখন তার সাথে তার ছেলে মেয়ে তার পরবর্তী তার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।
হাদিসে এসেছে,
যদি তুমি চাও যে, তোমার বার্ধক্যে মানুষ তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করুক, তাহলে তুমি তোমার যৌবনে তোমার মুরুব্বীকে সম্মান করো।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, فلا تقل لهما اف
“তাদেরকে উফ বলিও না” অর্থাৎ তাদের কথায় রাগান্বিত হয়ে বা তাদের কথায় বিরক্ত হয়ে উফ শব্দটাও উচ্চারণ করিও ন।
পিতা-মাতার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হবে ?
আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন বলে দিয়েছেন وقل لهما قولا كريما নরম সুরে কথা বল ভদ্রভাবে কথা বল আস্তে কথা বল ।
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন,
وَ اخۡفِضۡ لهما جناح الذل من الرحمه
তাদের জন্য তোমার শফকাত অর্থাৎ দয়ার দানা বিছিয়ে দাও এবং তাদের জন্য দোয়া করো।
যদি তারা মারা গিয়ে থাকে আল্লাহ বলেন তোমরা তাদের জন্য এই দোয়াটা করো
وقل ربي ارحمهما كما ربياني صغيرا
অর্থঃ হে আল্লাহ, তুমি তাদের উপর রহম করো যেভাবে তারা আমাকে ছোটবেলায় দয়া করেছে আদর করেছে সোহাগ করেছে মমতা দেখিয়েছে আপনি তাদের ওপর তেমনি দয়া করেন রহম করেন।
মনে রাখবেন,তাঁরা বেঁচে থাকলে তাদের খেদমত করলে যেমন সওয়াব বরকত পাওয়া যেত, মৃত্যুবরণ করার পর এই দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা ঐরকম বরকত দেবেন।
নবীজীর শিক্ষা
আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, একবার আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর কাছে ছিলাম। বনু সালামা গোত্রের এক লোক এসে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহ রাসূল, আমার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর এমন কোন কাজ আছে কি যে এখন তাদের সাথে করতে পারি ?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তুমি তাদের জন্য দোয়া কর। তাদের জন্য ইস্তেগফার কর।
হাদীসে এসেছে, মানুষ কবরে এমন ভাবে থাকে যেমন একজন ডুবন্ত মানুষ পানির মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে। বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করে।
তাকে কেউ হাত ধরে খুঁজে নিয়ে আসলে সে যদি বেঁচে থাকে, এবং ওই উদ্ধারকারী ব্যক্তির প্রতি যেরকম খুশি হয়, মৃত ব্যক্তি এর থেকে আরও বেশি আনন্দ পায়, যখন তার আত্মীয়-স্বজন তার জন্য দোয়া করে সওয়াব পাঠায়।
মৃত ব্যক্তিদের প্রতি করনীয়
দোয়া করতে হবে যেমনঃ
১)কোরআন তেলাওয়াত করবেন
২)নামাজ পড়বেন
৩) সালাম দেবেন
এসব কিছুর স্বভাব আছে আপনি মনে মনে নিয়ত করতে পারেন বা মুখে বলতে পারেন যে,
হে আল্লাহ, আমার এই সওয়াবটুকু আমার আত্মীয়-স্বজনদের কবরে পাঠিয়ে দিন।
এটাকে বলে اهداء الثواب للميت
বিখ্যাত ফতোয়ায়ে শামি কিতাবে লিখেছে, তিনবার সূরা এখলাস পাঠ করলে এক খতম কোরআনের সওয়াব, একবার সূরা ফাতিহা পাঠ করলে অর্ধেক কুরআনের সওয়াব
এবং একবার সুরা ইয়াসিন পাঠ করলে দশ খতম কুরআনের সওয়াব অর্জিত হয়।
একবার এসব পড়ে পড়ে তাদের জন্য সওয়াব পাঠাতে হয়।
মৃত ব্যক্তির জন্য যা কিছু পাঠানো হয় তন্মধ্যে সব থেকে বেশি লাভবান হয় ইস্তেগফার দ্বারা।
৪) انفاض عهد অর্থাৎ তাদের চেয়ে ওসিয়াত থাকে তা আদায় করা।
সামাজিক কিছু ভুল রীতি
আমাদের সমাজে যে রীতি চালু আছে শরিয়াতে এর কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু আমরা সবাই ভুলের মাঝে আছি। সাধারণ লোক যেমন ভুলের ভিতর আছে , কুরআন হাদিস জানা লোকেরাও এই ভুলের মধ্যে আছে। তিন দিন, দশ দিন, সাত দিন চল্লিশা ভোজ যে আমরা পালন করি– শরিয়তে এর কোন ভিত্তি নেই, এটা অনর্থক জিনিস।
অবশ্য মানুষকে খাওয়ানো অনেক সওয়াবের কাজ। তবে সেটা হতে হবে সঠিক পদ্ধতিতে। যেমনঃ ধান আর চিটার উদাহরণ। দেখতে একই রকম; কিন্তু একটা মানুষ রাস্তার পাশে ফেলে আর একটাকে যত্ন করে গোলায় তুলে রাখে। তেমনি ভাবে যেই আমলটার সাথে শরীয়তের কোন সম্পর্ক নেই, সে আমলটা গ্রহণযোগ্য হবে না। যে আমল শরীয়াত সম্মত হবে সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
পিতা-মাতার কবরে সওয়াব পাঠানোর পদ্ধতি
একটি উপায় হল,
মানুষকে খাওয়াবেন,টাকা দিবেন, বাজার করে দিবেন, কারো কল না থাকলে কল দিয়ে দেবেন, ঘর না থাকলে ঘর বানিয়ে দেবেন। পরিপূর্ণ না পারলে আংশিক দেবেন।
যে পরিমাণ দিবেন এইগুলো হল সঠিক পদ্ধতি কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে খাওয়ানো এর কোন ভিত্তি নেই। যেটা আমরা আমাদের সমাজে করে থাকি ।
এক সাহাবী রসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্ত্রী উম্মে সাদ মারা গিয়েছে। আমি তার জন্য কি কিছু করতে পারি ?
নবীজি বললেন, হ্যাঁ সদকা করো।
তাই মৃত্যু ব্যক্তির জন্য সদকা করা অনেক বড় একটি কল্যাণময় কাজ।
মৃত ব্যক্তির অসিয়ত
আমাদের দেশে স্বাভাবিকভাবে দুই ধরনের অসিয়ত আছে। একটা হল সে মারা যাওয়ার আগে বলে যায় , আমার জানাজার নামাজটা অমুকে পড়াবে বা আমাকে অমুক জায়গায় কবর দেবে। এগুলোর বিধান হলো, মুস্তাহাব।
আর দ্বিতীয় প্রকার ওসিয়াত, যেটা হল ওয়াজিব। যেমন কারো যদি হজ্ব ফরজ হয় আর সে যদি হজ্ব না করে, তো মৃত্যুবরণ করার সময় ওয়াজিব হলো সে তার আত্মীয়-স্বজনকে ওসিয়ত করে যাবে যে, আমার মাল-সম্পদ থেকে তোমরা আমার পক্ষ থেকে হজ্ব করিও।
এরকমভাবে নামাজ, রোজা যাকাত;এ সমস্ত ইবাদত, যেগুলো কাযা হয়েছে, আমার পক্ষ থেকে তোমরা এগুলোর কাফফারা আদায় করে দিও।
দুঃখজনক হলেও সত্যি,
আমরা এই অসিয়তের ধার ধারিনা । আমাদের মধ্যে এই ওয়াজিব ওসিয়ত আদায়ের ব্যাপারে খুবই শীতলতা দেখা যায় ।
উচিত হল, ঠিকমত সবকিছু আদায় করা। যদি কোন কিছু বাদ থেকে যায় মৃত্যুবরণ করার আগে এ সমস্ত ওসিয়ত করে যাওয়া।
পিতা-মাতার কবর জিয়ারতের গুরুত্ব
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেন, যে নাকি তার পিতা-মাতার কবর প্রতি শুক্রবারে জিয়ারত করে আল্লাহ তা’আলা তাঁর পিতা মাতাকে মাফ করে দেন।
এবং ভালো মানুষের মধ্যে তার নাম রেখে দেন।
তাই আমাদের উচিত হল, যাদের পিতা-মাতা মারা গেছেন, তাদের কবর জিয়ারত করা। আর যাদের বাবা-মা বেঁচে আছে, তাদের মা বাপের খেদমত করে জান্নাত কামাই করা।
আখেরি নসিহত
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
আত্মীয়তার সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখ অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করা। বাবা-মা’র সঙ্গীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা। পিতা মারা যাওয়ার পরে চাচার সাথে যদি ভালো ব্যবহার করে তাহলে বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করলে যে সওয়াব পাওয়া যেত , যে বরকত পাওয়া যেত, চাচার সাথে সদ্ব্যবহার করার কারণে সেই সব বরকত সে লাভ করবে।
মায়ের সাথে ব্যবহার করলে যে রকম বরকত পাওয়া যেত, মায়ের বোন বা মায়ের সহপাঠীর সাথে ভালো ব্যবহার করলে সেরকম বরকত পাওয়া যায়।
তাই আমাদের উচিত হল, আমাদের মা-বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করা।
মা-বাবা বেঁচে না থাকলে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন যারা আছে তাদের তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা।
আজ আমি যদি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি, আগামীতে আমার ছেলে মেয়ে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করবে।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে উক্ত কথাগুলো বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
অনুলিখনঃ মুফতি রাইহানউদ্দিন
শিক্ষকঃ জামিআ আবু বকর সিদ্দিক রা মাদ্রাসা, বলাকইড়, গোপালগঞ্জ