: ওই হারামজাদা! তাড়াতাড়ি কর মাইনষে দেইখা ফালাইবো।
: ভাই, ডর করে তো !
: কিয়ের ডর। ডরাইলে ডরাবি জেতা মাইনষেরে। মরা ডরাইয়া লাভ আছে?
: ভাই আমি আর এই কাম করুম না।
: বান্দির বাচ্চা, কি কইলি? কাম করবি না মানে!
বেবাকেরে কইয়া দিমু । পরে বুঝবি ঠেলা।
এলাকার মাইনষে তরে গেরাম ছাড়া করব। নাইলে এক ঘরে করব।
পরে বুঝবি কত ধানে কত চাল। চুপচাপ কাম কর। কেডা জানি আইতাছে।
ঐদিনের মতো নাকে চাপা দিয়ে কোনরকম কাজ শেষ করে জয়নাল । তারপর বাড়িতে এসে গোসল করে চারটা খেয়ে বিছানায় যায় ; কিন্তু সারারাত এপাশ-ওপাশ করেও তার ঘুম আসে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনো কাফন চুরির পয়সা পেটে ঢুকাবে না সে।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়, কোন উপায় নেই।
ওস্তাদের ডাক আসলেই তাকে যেতে হবে। না গেলে তার ক্ষতি আছে। নাহ, যে করেই হোক কালাচানকে এবার সে মানা করেই দিবে।
সে অন্য কাউকে দিয়ে এই কাজ করাক। জয়নাল তার কাজ আর করবে না। তার ওপর কালাচান তাকে সব সময় কবরে নামায়।
পচা গলা লাশ হাতড়ে কাফন খুলে আনতে নাড়ি ভুরি উল্টে যায় জয়নালের। টাকা ভাগের সময় তার সাথে বেইমানি করে কালাচান। অল্প কিছু টাকা জয়নালকে ধরিয়ে দিয়ে পুরো টাকাই পকেটে ভরে। এভাবেই সাত পাঁচ চিন্তা করে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে সে।
২
কাফন চুরি করে এভাবেই দিন চলে জয়নাল ও তার ওস্তাদ কালাচানের। সোনাকান্দা গ্রামের গোরস্থানে কোন ব্যক্তিকে দাফন করলেই তারা সংবাদ পেয়ে যায় ।
সেই সংবাদ মত নিশানাকৃত কবর খুঁড়ে তারা একজন বাইরে লোক পাহারা দেয় , আর দ্বিতীয়জন কবরে নেমে লাশের শরীর থেকে কাপড় খুলে আনে। আর সেটা ধুয়ে পরিষ্কার করে বিক্রি করে দেয়। এভাবে তাদের সংসার চালায়।
জগতে লক্ষ কোটি কাজ থাকলেও এই বিচিত্র পেশাটিকে তারা বেছে নিয়েছে । এই কাজে চালান নেই এবং খাটা-খাটনির ব্যাপার নেই। রাতের বেলা সময় বুঝে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সেরে ফেলা যায়। আর দিনে মিশে যায় ভালো মানুষের ভিড়ে । কেউ দেখতে পায় না তাদের পিশাচের মতো কান্ড।
কিছুদিন পর জয়নালের স্ত্রী গর্ভবতী হয়। এবার সে পাকা নিয়ত করে আর হারাম টাকা ঘরে তুলবে না; কিন্তু পাপের কি আর নিস্তার আছে?
কালাচান এক বিকেলে এসে খবর দেয়– জয়নাল আইজকা রাইতে কামে যাইতে হইবো।
সময় মতো আইয়া পরিস।
: ভাই, আমার বউ পোয়াতি হইছে । আমি আর এই কাম করুম না। আমারে মাফ করেন।
আচ্ছা যা, আইজকা শেষ। আর তোরে কামে ডাকুম না। আইজকার মতো কামে ল।
ঠিক আছে ভাই, আইজকা শেষবারের মতো আমি এই কামডা করমু।
নিয়তির কী নির্মম পরিহাস । ওই রাতেই তারা গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়ে যায়।
মাতবর বাড়ির গাছের সাথে সারারাত বেধে রাখা হয় । সকালে শালিশ বসে ।
মুরুব্বীরা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয়, উভয়কে ন্যাড়া করে মাথায় আলকাতরা দিয়ে ঘুরিয়ে গ্রাম ছাড়া করা হোক।
নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলে জয়নাল । মাদবর সাব! আপনে যা কইবেন মাইন্যা লমু । তয় আমার একখান কথা আছে। আপনারা জানেন আমার পরিবারের অবস্থা। কোনদিন একবেলা আধপেট খাইয়া আবার মাঝেমধ্যে না খাইয়া আমার সংসার চলে। কোনদিন গ্রামের মানুষ আমারে কোন কামে নেয় নাই। কোন সাহায্য করে নাই ।
গেল ভাদ্র মাসে আমার বাপে অসুস্থ হইয়া চিকিৎসার অভাবে মইরা গেল। তখন আপনার পায়ে পইরা অনেক কাঁনছি। আমারে কিছু টাকা ধার দেন । বাপেরে ঔষধ কিনা দিমু ।
আপনে আমারে লাথি দিয়া খেদাইয়া দিছেন । আমার বাপেরে একটা কাফন দেওনের মত দুইটা পয়সা হাতে ছিল না। বাড়িতে না গিয়া অসহায়ের মতো রাস্তায় পইড়া আছিলাম। গেলেই বিপদ। বাপের অসহায় লাশ দেখতে হইবো এর লেইগা ।
ওই সময় দেখি একটা লাশ কবর দিতে নিয়া যাইতাছে। কুবুদ্ধি হোক বা সুবুদ্ধি– চিন্তা করলাম, গেরামের কেউ তো আমার বাপের কাফনের ব্যবস্থা কইরা দিল না । আমি অহন এই মরা মাইনষের কাপড় খুইলা আমার বাপেরে কাফন দিমু । হেয় তো মাটির তলে পইড়া থাকবো। হ্যাঁরে তো আর কেউ দেখবো না। এরপর থেইকা আমি কাফন চুরি কইরা আমার পেট চালাই। অহন আপনেরাই কন।
এই কামের লেইগা কি আমি একলাই দোষী?
উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো মুখে কোন কথা নেই । তারপর বোবা মানুষগুলো ধীরে ধীরে মাতবর বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়।