Home ভ্রমণকিরগিজস্তানের ডায়েরি -পর্ব:৪

কিরগিজস্তানের ডায়েরি -পর্ব:৪

by MD JUNAYED SHEIKH

আহমদ সিরাজী

এম.জে. এফ নিউজ-01 ফেব্রুয়ারী

বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য চেষ্টা করে আসছিলাম, পিটিএ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। মাদ্রাসার ক্লাস করিয়ে সোজা বাইক নিয়ে চলে যেতাম কোচিং সেন্টারে, বনানীতে ক্লাস ছিল। ব্যস্ত জীবনে সবকিছুর মাঝে কোচিং ক্লাস ঠিক রাখতাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ৫০ টাকার সবজি ভাত খেতাম।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হালকা শরীরে ছোটাছুটি করতাম।
রাত আসলে নেশার ঘুমে হারিয়ে যেতাম। সকাল হতে না হতে আবার মাদ্রাসায় ক্লাস করার জন্য চলে যেতাম।
দুটো মাদ্রাসায় ক্লাস করানোর পর শরীরে তেমন এনার্জি থাকতো না।
বনানীতে আমার এক বন্ধুর অফিস ছিল। দেখা করার মত এতটুকু সময় মিলতো না।
শেষমেষ পিটি‌এ বাদ দিয়ে কোরিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজে ভর্তি হ‌ই, কিংসেজন ইনস্টিটিউট।
কোরিয়ান সরকারের একমাত্র ভাষা ইনস্টিটিউট,বাংলাদেশে দুটো আছে।
এখানে সার্টিফিকেট আইইএলটিএসের চেয়েও বড্ড কঠিন। ‌
প্রথম যে দুইজন সার্টিফিকেট পায় তার মধ্যে আমি একজন।
তবুও দূতাবাস থেকে ভিসা মিলে নি। সবই আল্লাহর মেহেরবানী।
কিছুদিন পর রকমারি থেকে চাকরির অফার আসে।
আমার এক বন্ধু সেখানে চাকরি করে। তার কথামতো ইন্টারভিউ দিলাম।

কর্তৃপক্ষ আমাকে বেশ পছন্দ করল। আমার সে বন্ধু ২ বছর আগে ঢুকেছিল আমার মাধ্যমেই।
দীর্ঘ দুই বছর পর তাকে পার্মানেন্ট করা হয়। তবে আল্লাহর মেহেরবানি যে, শুরু থেকেই আমাকে রকমারি কতৃপক্ষ পার্মানেন্ট হিসেবে নিয়ে নেয়। আমি এক্সিকিউটিভ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করি।
অল্পতেই সবকিছু জয় করে নিচ্ছিলাম সেখানে।

ছোটকাল থেকে মানুষের মন জয় করতে আমার বেশি বেগ পেতে হয় না।
মানুষের চেহারা দেখে আমি বুঝে ফেলতে পারি সে কি বুঝাতে চায় বা কোন কিসিমের মানুষ।
আল্লাহ আমার ভিতর অদ্ভুত এক ধরনের প্রতিভা দিয়েছেন।
শুরু থেকে একটা মানুষ অত্যন্ত আন্তরিকতা ও হেল্পফুল হলেও পাঁচ বছর পরে কি হবে আল্লাহ তা’আলা আমাকে আগেভাগে দেখিয়ে দেন,আমি সুস্পষ্টভাবে আন্দাজ করতে পারি। ‌ আমার এই বিষয়টা আমার শায়খ আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাস‍ঊদ সাহেবের সোহবতে থেকে আরও পাকাপোক্ত হয়।
হুজুরের সাথে চলে আমি বিশ্বজয় করার স্বপ্ন দেখা শুরু করি।
এত বড় শক্তি আল্লাহতালা তাঁকে দান করেছেন তাঁর সংস্পর্শ না এসে কেউ বুঝতে পারবে না। তাঁর বিচক্ষণতা তাঁর অন্তরে দৃষ্টি, আকাবিরের সমঝ এতটাই লালন করেন তাঁকে না দেখলে কখনোই কল্পনা করতে পারতাম না।
২০১৩ সালে প্রথম তাঁর দেখা পাই জামিয়া শারইয়্যা মালিবাগে।
শাহবাগ আন্দোলনে তাঁর দেওয়া বক্তব্য নিয়ে বিতর্কে পুরো দেশ তখন তুঙ্গে।
জামাতে ইসলাম থেকে শুরু করে কওমি ঘরানার সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ।
শাহবাগে নাস্তিকদের সাথে কেন তিনি একাত্মতা পোষণ করলেন?

ওরা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে কটুক্তি করে বেড়াচ্ছিল, একজন আলেম তো দূরের কথা মুসলমান বলতে এটি সহ্য করার কথা না। অথচ তিনি সেখানে বক্তব্য রাখতে গেলেন কেন?
সবার মত আমারও একই প্রশ্ন ছিল।
মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাস‌ঊদ সাহেবের ব্যাপারে যারা ওয়াকবিহাল সকলেই তাঁর ইলেম ও আমলের ব্যাপারে জ্ঞাত।

ফেদায়ে মিল্লাত রহমাতুল্লাহ আলাইহি তাঁকে শুধু খেলাফতি দেননি বরং কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির ভাষায়, পুরো বিশ্বের খোলাফাদের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন ফরীদ সাহেব।
ফেদায়ে মিল্লাতের খলিফাদের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে ছিলো।
শুধু ভারত উপমহাদেশ নয়; বরং ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীজুড়ে রয়েছে।
তাঁদের সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি।
তাছাড়া কাজী সাহেব ফরীদ সাহেবের ব্যাপারে বলতেন, আমার ওস্তাদ তুল্য শাগরিদ।
এমনকি তাঁর ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনেও প্রতিটা পরতে পরতে উস্তাদতুল্য শাগরিদ থেকে পরামর্শ নিতেন।
আল কাউসারে কাজী সাহেব মরণোত্তর এক সংখ্যায় তাঁর স্ত্রীর এক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল।
একমাত্র আদরের দুলালী কে কোথায় পড়াবেন এ বিষয়ে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন।
পরে উস্তাদতুল্য শাগরিদের পরামর্শেই তিনি মেয়েকে ঘরে তালিমে ব্যবস্থা করেন। “বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সূরে” ফরীদ সাহেবকে নিয়ে কাজী সাহেব এক জায়গায় লিখেছেন, আমি পিদিম হয়ে সূর্যের প্রশংসা করে সূর্যকে খাটো করতে চাই না।
সত্যিকারে অর্থে ইলম এবং আমলে মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাস‌ঊদ হলেন তুলনাহীন।

আমি আর বন্ধু সাকফি হুজুরের শৈশব কৈশোর ও যৌবনে ফেলে আসা স্থানগুলো পরিদর্শনে গেলাম।
কিশোরগঞ্জের জামিয়া এমদাদিয়ার যে পাঠাগারে তিনি পড়েছিলেন সেখানে যাওয়ার তৌফিক হয় ।
সফর থেকে ঘুরে এসে হুজুরকে বললাম,
হুজুর, শহীদি মসজিদের সে পাঠাগারে গিয়েছি।
হুজুর তখন হেসে উঠে বললেন, এ পাঠাগারের এমন কোন বই নেই যেটা আমি পড়ি নাই।
এ পাঠাগার ঘিরে হুজুরের ব্যাপারে রূপকথার অনেক গল্প রয়েছে সবার মুখে মুখে।
কিশোরগঞ্জের সবার মুখে মুখে তৎকালে হুজুরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
আল্লামা আতহার আলী সাহেব একজন প্রথিতযশা আলেম ছিলেন।
আতহার আলী সাহেবের ব্যাপারে একটি উক্তি আমি বড় হুজুরের মুখে শুনেছি।
তাঁর একটি বড় গুণ ছিলো, যোগ্য লোক যেই মতাদর্শের হোক না কেন তিনি তাঁকে জামিয়া এমদাদিয়ায় উস্তাদ হিসেবে আহবান করতেন। এর‌ই ধারাবাহিকতায় আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহতুল্লাহি আলাইহিও এখানেই শাইখুল হাদিস ছিলেন।
যদিও আতহার আলি সাহেব ও কাজী সাহেব চিন্তাধারায় দুইজন দুই মেরুর।
পাকিস্তান ভাগের পক্ষে ছিলেন আতহার আলী সাহেব। আর তাঁর উল্টো কাজী সাহেব।
কাজী সাহেব আগাগোড়া পুরোটাই ছিলেন মাদানী চেতনাধারী।
হুসাইন আহমদ মাদানীর দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতাকে পুরোপুরি ধারণ করতেন।
স্বপ্নের রাজপুত্র বলে সম্বোধন করতেন হুসাইন আহমদ মাদানীকে।
মনে হয় কাজী সাহেব হুদুরদের ব্যাচ‌ই মাদানী সাহেবের শেষ ব্যাচ ছিলো।
কাজী সাহেব বলেন, আমি যেই বছর দেওবন্দে যাই তখন আমি নিচের জামাতে পড়তাম।
তবুও আমি স্বপ্নের রাজপুত্রের ক্লাস কখনোই মিস করতাম না।
পরের বছর হুজুর দাওরায় দাখেলা নেন। কিন্তু হুজুরের এক বন্ধু ভেবেছিলো আরেক জামাত পড়ে দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হবে।
কিন্তু হুজুরের পীড়াপীড়িতে তিনিও দাওরায় ভর্তি হয়।
তখন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির শাগরেদ হ‌ওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
ইন্ডিয়ার এই বন্ধু জীবনের শেষ পর্যন্ত কাজী সাহেবের কৃতজ্ঞতা আদায় করতেন,
বলতেন তোমার কারণে আজ আমার মাদানী সাহেবের শাগরেদ হ‌ওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে।
পরের বছরেই মাদানী সাহেব রাহমাতুল্লাহি ইন্তেকাল করেন জাদুটোনার রোগে।
কাজী সাহেব ছিলেন মাদানিয়্যাতের উপর ফিদা।
আমৃত্যু তিনি ছিলেন আশেকে মাদানী। আসলে মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ছোঁয়া যারা একবার পেয়েছেন তারা কখনোই তাকে ভুলতে পারেনি।
যদিও স্বজাতিরা দূর থেকে তাঁকে গালাগালি করতো। হিন্দু বলে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতো।
হায় আফসোস! যদি তখনকার আলেম ওলামারা মাদানী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে টেনে না ধরতো,তাঁর প্রতি যবানের জুলুম না করতো!
এই উপমহাদেশের ইসলাম ও মুসলমানদের এতো বড় ক্ষতি হতো না।
জানেশীনে মাদানী হযরত ফেদায়ে মিল্লাতকেও ইন্দিরা গান্ধীর আঁচলের গোলাম বলা হতো।
কাজী সাহেবকে আ‌ওয়ামী লীগের চামচা ট্যাগ লাগানো হতো।
এক‌ই ধারাবাহিকতায় আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাস‌ঊদ সাহেবকেও স‌ইতে হয়েছে স্বজাতির পক্ষ থেকে যবান আন্দাজীর নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচার।
কখনোই চিন্তা করতে বসেও নি। কী বলতে চাচ্ছেন এই মাওলানা? ফরীদ সাহেব একদিন অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, আমার জীবন যৌবন ক্ষয় করে দিয়েছি মাদ্রাসা মসজিদের অঙ্গনে অঙ্গনে।
উম্মতের ফিকিরে নিজেকে যেই সত্ত্বা তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন তাঁকে মেরে আমরা ইসলাম কায়েমের দিকে ছুটছি।
কখনোই কী ভেবেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের “ক্বালা ক্বালা”র বাগান যেই মালি বিনা পয়সায় বিনা পারিশ্রমিকে সারাজীবন বুকে আগলে রেখে সযত্নে সজীব সতেজ রেখেছেন আর আমি সে এই বাগানের ফল খেতেই আসি আর সেই মালির চেয়েও আমার দরদ বেশি? আহ, কতটা নির্বোধ আমি!
বাতিলরা দেওবন্দিদের নিয়ে খেলা করতে বেশি কসরত করতে হয় না।
কিন্তু যাদেরকে তারা জম মনে করে এরা যুগের সিপাহসালার হন।
এদেরকেই যুগে যুগে কোনঠাসা ও এক ঘরে করে রাখার চেষ্টা করা হয়।

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে শুরু করে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বাল, ইমাম বোখারীসহ সকলেই এক‌ই সুতোয় গাঁথা।
শরীক হতে চাই আকাবিরের সেই মিছিলে। আল্লামা মাস‌ঊদ নিজের উক্তির যথার্থতা নিজ জীবনে প্রতিফলিত করেছেন শতভাগ

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment