শিশুদের মধ্যেও ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছর বিশ্বে ৪ লাখ শিশু ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, যার ২৫ শতাংশই ব্লাড ক্যানসারে ভুগছে। শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সিদের ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ সময় ধরা হয়। এর কারণ হিসেবে খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতিরিক্ত ফাস্টফুড গ্রহণ ও কোমল পানীয় পান শিশুদের ক্ষতি ডেকে আনছে। এর সঙ্গে আছে—শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, অতিরিক্ত নগরায়ণ, বিভিন্ন প্রযুক্তি ও ডিভাইসে আসক্তি। ব্লাড ক্যানসার প্রতিরোধে এসব দূষণ কমাতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় ডিভাইস থেকে শিশুদের দূরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা
গত বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডি-ব্লকের তিন তলায় শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগে গিয়ে কথা হলো চিকিত্সাধীন শিশু মুয়াজের মায়ের সঙ্গে। রংপুর জলঢাকা থেকে আসা মুয়াজের মা সুমাইয়া আক্তার বলেন, পাঁচ বছর বয়সি মুয়াজের এক মাস ধরে জ্বর ছিল, সঙ্গে ছিল পায়ে ব্যথা, রংপুরে ডাক্তার দেখালে জানতে পারেন তার শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিন চারে নেমে গেছে। চিকিত্সক অতিসত্ত্বর মুয়াজকে ঢাকা আনার পরামর্শ দেন। সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে এখানেই ভর্তি আছি। চিকিত্সা চলছে। ডাক্তার বলেছেন চিকিত্সা করলে মুয়াজ সুস্থ হয়ে যাবে।’
আর এক রোগী ৮ম শ্রেণির ছাত্রী সায়মার শরীরে কেমো চলছিল। কিশোরী মেয়েটিকে বয়সের চেয়ে ছোট দেখাচ্ছিল। সায়মা বলে, ‘আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খুব দুর্বল লাগছে।’ সায়মার মা বলেন, মেয়ের সারা শরীর জ্বালাপোড়া করছে, বুকটা ব্যথা করছে। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বাসিন্দা।
বিএসএমএমইউ-এর শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিশুদের ক্যানসারের ক্ষেত্রে লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি। তবে শিশুদের ব্লাড ক্যানসার ছাড়াও ব্রেইন টিউমার, নিউরোব্লাস্টোমা, চোখের টিউমার বা রেটিনোব্লাস্টোমা, যকৃতের টিউমার বা হেপাটোব্লাস্টোমা, কিডনির টিউমার বা নেফ্রোব্লাস্টোমা, হাড়ের টিউমার বা অস্টিওসারকোমা, মাংসপেশির টিউমারসহ আরো বিভিন্ন রকম ক্যানসার প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিত্সা নেওয়া ৪ হাজার ৫২৬ জন শিশু রোগীর ওপর জরিপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগ। এতে দেখা যায়, শনাক্তের ৩ হাজার ৬৫০ জন, অর্থাত্ ৮০ শতাংশ রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত। টিউমারজনিত ক্যানসারে আক্রান্ত ছিল ৩৫৩ জন বা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যানসারে ৫২৩ জন বা ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ; অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকোমিয়ায় ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নন-হজকিন্স লিম্ফোমায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আক্রান্ত ছিল। এরপর আর এই হাসপাতালে চিকিত্সা নেওয়া ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের বিষয়ে কোনো জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়নি।
বিএসএমএমইউ-এর শিশু হেমাটোলোজি ও অনকোলজি বিভাগে জরিপ বলছে, তাদের কাছে চিকিত্সা নিতে আসা ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের ৮০ শতাংশই ব্লাড ক্যানসারের রোগী। এসব শিশু রোগীর বেশির ভাগের ক্যানসার জন্মগত হলেও, পারিপার্শ্বিক পরিবেশও এর জন্যে দায়ী। বিভিন্ন দূষণ, ভেজাল খাদ্য, জাঙ্কফুড, খাদ্যপণ্য উত্পাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার, এমনকি রোগ শনাক্তের বিভিন্ন বিকিরণও শিশুদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। রক্তে সেলগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ায় শিশুরা বেশি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার ইপিডেমিওলোজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ও গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ক্যানসার হাসপাতালের প্রকল্প সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার ইত্তেফাককে বলেন, শিশুদের ক্ষেত্রে এক নম্বর ক্যানসার হচ্ছে লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসার, এর আবার অনেকগুলো ধরন আছে। এরপর আছে নাসিকাগ্রন্থির ক্যানসার, ব্রেন, নার্ভ বা স্নায়ুর ক্যানসার, ব্রেন টিউমার, কিডনির ক্যানসার, রেটিনোব্লাস্টোমা, হাড়ের ক্যানসার। তিনি বলেন, ‘শিশুদের ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জেনিটিক্যাল কারণে হয়, অস্বাভাবিক মিউটেশনের কারণে হয়, এছাড়া পরিবেশগত কারণে হয়—বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, পরিবেশদূষণ, ভাইরাস। আরো আছে খাবারে টক্সিনের উপস্থিতি। এই দূষণের বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। দূষণমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে, পর্যাপ্ত খেলাধুলার জায়গা থাকতে হবে এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
বিএসএমএমইউ এর শিশু হেপাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ টি এম আতিকুর রহমান ইত্তেফাকে বলেন, শিশুদের যত ক্যানসার হয়, তার শতকরা ২৫ ভাগই ব্লাড ক্যানসার। এছাড়া শিশুদের ব্রেন, লিভার, কিডনি, মাংসপেশীর ক্যানসার আছে। তবে এককভাবে ব্লাড ক্যানসারটাই সর্বাধিক।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক ক্যানসার হওয়ার কারণ হিসেবে দূষণকে দায়ী করে বলেন, আমাদের দেশে খাদ্য দূষণ, পরিবেশ দূষণ, এছাড়া বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন ভাইরাসের কারণেও ক্যানসার হয়। যারা রেডুয়েসনের কাছাকাছি কাজ করেন, তারাও ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকেন, অথবা দূষিত বাতাস ও দূষিত পরিবেশের কারণেও ক্যানসার হয়।
