মা, মা কোথায় তুমি ? আমার শরীরটা কেমন যেন খারাপ লাগছে। রাতে কয়েকবার টয়লেটে যেতে হয়েছে। হুজুর বলেছিলেন, লবণ ভাত খেলে কমে যায় । আমার তো আজকে মাদ্রাসায় চলে যেতে হবে। ফাহাদ বলল।
ফাহাদ, পরিবারের একমাত্র ছেলে। রুকাইয়া নামে একটি বোন আছে, মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ওদের বাবা আব্দুর রহিম গত দুই বছর হল বক্ষব্যাধি রোগে ইন্তেকাল করেছেন। মা, জান্নাত আরা, স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলে মেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তাদের আয় রোজগার বলতে কিছুই নেই। শুধু বাড়ীর সামনে চাষের এক খণ্ড জমি। তাও আবার বড় মাপের নয়। সেই জমিটি স্বামীর মৃত্যুর পর বর্গা দিয়ে দেয় পাশের এক বৃহত্তর কাছে।
জান্নাত আরা সেলাইয়ের কাজ করেন। এ দুইটি থেকে যা আসে তা দিয়ে তিন সদস্যের সংসার কোনমতে চলে। এদিকে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়ার খরচ বহন করতে হয়।
ছেলের ডাকে সাড়া দিয়ে মা বললেন, তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খানা বাড়তেছি।
ফাহাদ খেতে খেতে বলল, মা, তুমি এত কষ্ট করে লেখা পড়ার খরচ যোগাচ্ছ। জানি, তোমার অনেক কষ্ট হয়। বলছিলাম কি, আমি আপাতত লেখা পড়া বাদ দিয়ে সংসারের হাল ধরি।
ছেলের কথা শুনে জান্নাত আরার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলের কথার জবাব কিভাবে দেবে তার কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। নিথর নিস্তব্ধ।
-কি মা, চুপ হয়ে আছো কেন? কোন কথা বলছো না যে?
-শোনো বাবা, তোমার বাবা গরিব হলেও অনেক সম্মানি ছিলেন। তাকে এলাকার মানুষ অনেক সম্মান করত। তার স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করি ভালো দ্বীনদার পরহেজগার করে গড়ে তোলে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। আমি তার স্বপ্নকে আমার বক্ষে ধারণ করে অনেক কষ্টে দিনরাত মেহনত করছি। অতএব: আমার যত কষ্টই হোক না কেন তোমাদের লেখাপড়া করতেই হবে। তোমার বাবার স্বপ্ন বৃথা যেতে দিতে পারি না।
মা জান্নাত আরা যখন এই কথা বললেন, স্বামী বিয়োগে আর সন্তানের ভালোবাসায় কেঁদে ফেললেন। সাথে ফাহাদও মায়ের চোখে দুখের পানি ও বিশাল স্বপ্ন লালনের আবেগ দেখে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে অশ্রু বরণ করল।
-আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যা বলবে তাই হবে।
ফাহাদ মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল– মা, আসি, দোয়া করো।
-আচ্ছা যাও বাবা। মনোযোগ সহকারে পড়াশোনা করো। চিন্তা-ভাবনা করবে না। আল্লাহর উপর ভরসা করো। এই নাও এই টাকাগুলি তোমার কাছে রাখো।
মাত্র একশত বিশ টাকা। ফাহাদ টাকাগুলো এক নজর দেখে।
-মা, আমার এত টাকা লাগবে না। ৫০ টাকা হলেই চলবে। বাকিগুলো তোমার কাছে রাখো।
২
ফাহাদ চলে গেল। দু:খিনী মা পথপানে যতদূর দৃষ্টিতে আসে ততক্ষণ চেয়েই রইলেন। অতীতের স্মৃতি, বর্তমান পরিস্থিতি এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ আর নানা কিছু চিন্তা করে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন।
ফাহাদ মাদ্রাসায় পৌঁছে গেল। পরের দিন থেকেই নিয়মতান্ত্রিক ক্লাশ। উস্তাদ ও সাথীদের সাথে কুশল বিনিময় করে নিজের মুতালাআয় মনোযোগ দিল।
ফাহাদ হেদায়াতুন্নাহু পড়ে। ক্লাসের এক নম্বর ছাত্র। সব সময় আশাবাদী থাকে, ভালো মার্ক পেয়ে উত্তীর্ণ হবে।
ছাত্র হিসেবে যেমন ভালো তেমনি খুবই খোদাভীরু, আদর্শবান ছেলে। মাদ্রাসার সকল উস্তাদ ছাত্ররা সবাই আদর করে। স্নেহ করে। তার সততা, উদারতা, নম্রতা-ভদ্রতা তাকে সকলের প্রিয় পাত্র করে তোলে।
তারপর ও অন্যান্যরা যেভাবে চলে সে সেভাবে চলতে পারে না। পিতৃহীন ও অভাবী সংসার বলে কথা। অন্য ছাত্রদের সাজ-সজ্জা শান- শওকত দেখে লোভ জাগে তবুও নিজেকে সংবরণ করে। অবশ্য দুখিনী মায়ের কথা মনে পড়লে এই ভাবনাটি অবান্তর হয়ে যায় ।
৩
গত পনেরো-বিশ দিন পূর্বে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে। এখন ফলাফল বের হওয়ার অপেক্ষা করছে সবাই। ফাহাদের অপেক্ষা একটু বেশিই।
নিয়মতান্ত্রিক ক্লাস চলছে। লেখাপড়া ছাড়া কোন ভাবনা নেই। জোহরের নামাজের পর ঘোষণা হল, আজ দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল প্রদান করা হবে।
নোটিশ বোর্ডে ফলাফল সেঁটে দেয়া হয়েছে। সবাই ভিড় করছে; কিন্তু ফাহাদ নেই। ভাল ছাত্ররা এই সময়টায় স্বাভাবিকভাবে দেরি করে।
কেন করে? এর মর্ম তারাই ভালো বোঝে।
সবাই সবার রেজাল্ট দেখছে। ফাহাদের ক্লাসের এক ছাত্র তার ফলাফল দেখে বলল, তুই এবারও প্রথম স্থান অর্জন করেছিস। সে মুচকি হাসে।
নোটিশ বোর্ড থেকে আস্তে আস্তে ভিড় কমে গেল। ফাহাদ খুব ধীরে সুস্থে নিজের ফলাফল দেখল। খুব সন্তোষজনক ফলাফল। দেরি না করে দফতরে গিয়ে মাকে ফোন করে জানালো।
মা জান্নাত ছেলের ফলাফল শুনে আবেগে কেঁদে ফেললেন। মনে মনে ভারি খুশি হন। বললেন, বাবা, তোমাকে কিছুই খরচ দিতে পারি না। তারপরও তুমি এত সুন্দর ফলাফল করো। এতে আমার প্রতি তোমার কোন অভক্তি আসেনা?
-মা, তুমি কী বলছো? তুমি দিতে পারো না তাতে কি হয়েছে? লেখাপড়া আমার। আমি ভালো না করলে আমারই ক্ষতি হবে। তুমি দোয়া করো , যেন ভালো করে করতে পারি।
-আচ্ছা বাবা। ভালো থেকো। দোয়া করিও।সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিল।
৪
রুকাইয়া মাদ্রাসায় যাচ্ছে। বাড়ির পাশে মহিলা মাদ্রাসা। সে ফাহাদের মতো ভালো মেধাবী না হলেও মধ্যম ধরনের। জন্মের পর থেকেই মেয়েটির সাড়া বছর একটির পর একটি রোগ লেগেই থাকে। মায়ের সাধ্য অনুযায়ী অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছে, কোন কাজ হয়নি। ওষুধ খেলে ভালো থাকে। না খেলে আবার যে সেই। কোন রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। কি একটা পেরেশানি!
সংসারের যে অবস্থা! এত ওষুধ কিনবে কিভাবে? সাধ্যে কুলোয় না। এই হেতু মায়ের মনটা থাকে ভীষণ খারাপ।
রুকাইয়া হঠাৎ একদিন মাদ্রাসায় মাথা ঘুরে পড়ে গেল। মাদ্রাসা থেকে তড়িঘড়ি সংবাদ এল।
জান্নাত গিয়ে দেখলেন , মেয়ের চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাশে নীল বর্ণ ধারণ করেছে। জান্নাত আরা চমকে গেলেন। কাঁদতে লাগলেন। উপস্থিত সকল ছাত্রী-শিক্ষিকারাও কাঁদছে।
এই অবস্থায় মাদ্রাসা পরিচালক উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার ডাক্তার বলেন, এই সিরিয়াস রোগী আমাদের সাধ্যের বাইরে। কিছুই করতে পারব না, ময়মনসিংহে নিয়ে যান।
জান্নাত আরা বিপাকে পড়ে গেলেন।ময়মনসিংহ যাওয়া মানে অনেক টাকার ব্যাপার। এখন এত টাকা পাবো কোথায়?কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে যা উপার্জন হয়েছিল, হিসাব করে দেখেন মোট এক হাজার টাকা।
মাদ্রাসার পরিচালক মহোদয় কিছু টাকা দিলেন। বললেন, এই নিয়ে যান। হাসপাতালে ভর্তি করেন।
পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে রোগ নির্ণয় হলো। ব্লাড ক্যান্সার।
ডাক্তার বলল, যদি সম্ভব হয় অতি দ্রুত ইন্ডিয়াতে নিয়ে যান। না হয় ভালো-মন্দ চাহিদা অনুযায়ী কিছু খাবার খাওয়ান।
ডাক্তারের একথা শুনে মা জান্নাতের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোনকমে বাড়ি গেল। ছেলেকে সংবাদ দিল, তোমার বোনের খুব অসুখ দেখতে এসো।
ফাহাদ ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসার উদ্যত হল। এখন আসবে কি করে? হাতে কোনো টাকা -পয়সা নেই।
জিম্মাদার ওস্তাদের কাছে গেল। সব খুলে বলল। উস্তাদ পথ খরচের জন্য ৫০ টাকা দিয়ে বললেন, যা্ দোয়া করি তোমার বোনের জন্য আল্লাহ তাআলা তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দিন।
এদিকে রুকাইয়া অবস্থা ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে বেড়েই চলছে। কখন জানি ধরাধাম ত্যগ করে কে জানে?
দুখিনী মা জান্নাতের বিলাপের শেষ নেই। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদেন। আল্লাহর কাছে মেয়ের সুস্থতার ভিক্ষা চাইছেন। পাশের বাড়ির লোকেরাও এসে দেখছে। কেহ বলে মেয়েটা বাঁচবে না। জান্নাত আরা কথাটি মানতে পারেন না। কেউ সান্তনা দেয়।
এমন করতে করতে সারা দিন গড়িয়ে যায়।
৫
সূর্য ক্রমশ ম্লান হতে চলছে। শিউরে বসে কাঁদছেন। সাকরাত শুরু হয়ে গেল। ছোট্ট রুকাইয়া দুই তিনবার হেঁচকি দিয়ে নিথর হয়ে গেল। মুখে পানি দিচ্ছেন। না, পানি পড়ে যায়। জান্নাত আরা বুঝতে পারলেন, কলিজার টুকরা মেয়ে আর নেই। গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছেন। মায়ের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিও কাঁদছে। উপস্থিত সবাই কাঁদছে।
পড়ন্ত বিকেল। ফাহাদ বাড়ির অদূরে এসে গেল। দেখতে পেল বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়। বুঝতে পারছি না কেন এত মানুষ। কিছু হলো না তো? মনে হাজারো কৌতুহল । নাকি রুকাইয়া…..! না না এ হতে পারে না।
মনে মনে বলে, সকালবেলায় সংবাদ পেলাম সে অসুস্থ। নাকি অন্য কিছু ঘটেছে? মনে হাজার প্রশ্ন নিয়ে সামনের দিকে এগোয়। হাজার কল্পনারা উঁকি মারছে। কোন কিছুই বুঝতে পারছিনা।
ফাহাদ ভিড় ঠেলে জটলার মধ্যে প্রবেশ করে। সবাইকে সালাম দিল। নিরুত্তাপহীন কণ্ঠে সবাই জবাব দিল বটে কিন্তু কেউ কথা বলছে না। বাড়ির ভেতরের ঘর থেকে মিহিন করুন কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। গিয়ে দেখল আপাদমস্তক রুকাইয়া কাপড় দিয়ে আবৃত। মা ছেলেকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরেন। বাবা, তোমার বোন আর বেঁচে নেই। তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তোমাদের জোড়া ভেঙে গেল।
ফাহাদ ভেঙ্গে পড়ে না। শক্ত হয়। ভীষণ শক্ত।
‘মা তুমি শান্ত হও। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করো। রুকাইয়া তো ছোট বাচ্চা ছিল। আমার বোনের কোন গোনাহ নেই, নেই কোনো পাপ পঙ্কিলতা।
ফাহাদ নিজের মনের ভেতর সকল দুঃখ বেদনা জমা করে এগিয়ে চলছে। শ্রাবণ মেঘের অশ্রুদল ভর করছে।