বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে এসেছি প্রায় দশ বারো দিন হলো। খুব একটা কাজের চাপ না থাকায় গাড়ি নিয়ে এদিক-সেদিক পরিযায়ী পাখির ন্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছি।
নামাজ পড়েই বেড়িয়ে পড়ি। কখনো পাহাড়ে কিংবা কখনো ওয়াদি (শুকনো খাল) আবার উঠে যাই যেখানে তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেখানেও। এভাবেই চলছে জীবন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কুদরত দেখে সেজদাবনত হই।
একদিন পড়ন্ত বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফিট উচ্চতার এক পাহাড়ের উপর উঠেছি।
বসে আছি আর মনে মনে আমার ছোট ৬ মাস বয়সের মেয়েটার কথা ভাবছি। সে আমার কাছে থাকলে ওর সাথে খেলা করে সময়টা দারুনভাবে কাটানো যেতো। একা একা মনটা বিষাদে ভরে ওঠে।
তাপমাত্রা অনেক ঠান্ডা। বিকেলের শেষ প্রান্তে প্রায় দূর পাহাড়ে মেঘ খন্ড ভাসছে। বিশাল বিশাল খাড়া পাহাড়। চারপাশ কবরের মত নীরব, নিস্তব্ধ।
আমার বাঙালি চোখ তন্ন তন্ন করে পাখি খোঁজে। চোখে পড়ার মত তেমন বড়সড় গাছ পালা না থাকায় পাখিদের আনাগোনা একদম নেই বললেই চলে।
পাহাড়ি অঞ্চলে পাখিদের টিকে থাকা মুশকিল। এখানে খাদ্য পাওয়া বেশ কঠিন। একে তো পাথরের পাহাড়। তার উপর গাছ-পালা নেই। যাই আছে সেগুলো পাথরে শেওলা জমে। সেই শেওলা থেকেই গাছ জন্মায়, যেটা খুব একটা বড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ছোট ছোট কিছু গাছ হয় । এগুলোতে খুব একটা পাখি থাকে না। কালেভদ্রে যা কিছু পাখি আসে — এখানকার স্থানীয়দের উপদ্রবে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি’ অবস্থা।
স্থানীয়রা পাখি শিকার করায় মহা পন্ডিত। প্রায় সবার কাছেই পাখি শিকারের পিস্তল মওজুদ। এরা নতুন নতুন মডেলের রাইফেল আর পাওয়ারফুল আগ্নেয়াস্ত্র সাথে নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। প্রায় অধিকাংশের কোমড়েই বেল্ট থাকে যেটার মধ্যে পিস্তল, মোবাইল আর একটা ছুড়ি রাখার আলাদা আলাদা যায়গা থাকে।
তাদের সামনে পাখি পড়লেই নিস্তার নেই। একেবারে কেল্লাফতে।
২
এই এলাকাটিতে একসময় আফ্রিকান নিগ্রুদের জয় জয়কার ছিল। মানে ইথুপিয়া, ইরেত্রিয়া, সোমালিয়ান ইত্যাদি। সাথে ইয়ামেনের লোকজন ত আছেই। তবে এই আফ্রিকান জাতিগুলোর চাইতে ইয়ামেনীদের ব্যবহার তুলনামূলক ভাল। কারন এই জিঝান শহর ইয়ামান ঘেষা। এখানে ইয়ামেনিরা সৌদিদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। তাই ইয়ামেনিদের সাথে তেমন ঝামেলা হতোনা।
কিন্তু বাকি যারা আছে তারা তো কাগজপত্রহীন। জীবিকার তাগিদে আফ্রিকান জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা ইয়ামান হয়ে সৌদিতে প্রবেশ করে। তারা খুব হিংস্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার্থে এগুলো ব্যবহার করতো।
এখন তো পুলিশের ক্যাম্প ই আছে এই এলাকা গুলোতে।
আমি যেখানে থাকি– আল দায়ের, একটা সময় এখানে ইথুপিয়া, ইরেত্রিয়া, সোমালিয়ান, এদের সাথে প্রায় সময় পুলিশের গুলাগুলি হতো। উপর থেকে আদেশ ছিলো এদেরকে জানে মেরে ফেলার।
৩
পাহাড় ভ্রমণ শেষে কর্মস্থলে ফেরার সময় এক ইথুপিয়ানকে রাস্তায় পেলাম। ওর বৈধ কাগজ পত্র আছে। গল্প শুরু করলাম।
গল্পের বিষয় — সে কিভাবে এখানে আসল, জার্নিটা কেমন ছিল ইত্যাদি।
সে জানাল, এখানে প্রায় ২০ বছর যাবত আছে। প্রথমে বিনা ভিসায় ইয়ামান হয়ে ঢুকেছিল। প্রায় ৭/৮ বছর সে লুকিয়ে এখানে কাজ করত। তারপর সে আবার দেশে ফিরে পরবর্তীতে ভিসা নিয়ে এই এলাকায় প্রবেশ করেছে।
তার মুখেই লোমহর্ষক কিছু ঘটনা শোনা গেল। আফ্রিকান এই বন্ধুটি জানাল, এক সময় এই ফিফা পাহাড়ের পরতে পরতে মানুষের লাশ পড়ে থাকতো। এবং সেটা নাকি খুব স্বাভাবিক একটি বিষয় ছিল।
পাহাড়ে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ ছিল। সৌদি, ইয়ামেনি , ইরেত্রি ও ইথুপিয়ান– সবার আলাদা আলাদা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করত। কখনো নিজেরা নিজেরাই গুলাগুলি করত। আবার কখনো পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে লিপ্ত হত।
অনেকের পরিণতি ঘটত লাশ হওয়ার দুঃসহ যাত্রার মধ্য দিয়ে।
জিগ্যেস করলাম, অবৈধ পথে কিভাবে প্রবেশ করে এখানে? সে জানালো ইরেত্রি ইথুপি আর সুমালি সাথে ডিজিবিউটি হয়ে সমুদ্র পাড় হতে হয়। সেখান থেকে ইয়ামানের সানয়া শহর। পায়ে হেটে প্রায় ৪০/৫০ দিনে পার হয়ে বর্ডারের কাছাকাছি আসে। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে পাহাড় বেয়ে সৌদিতে ঢুকে যায়।
অনেকেই সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে পাথুরে পাহাড় থেকে পড়ে মারা যায়।
কেউবা, না খেয়ে, দিনের পর দিন এরকম নিস্তব্ধ যায়গায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এবং আস্তে আস্তে তাদের সমস্ত শক্তি হারিয়ে সেখানেই তাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটায়।
৪
মানুষের সংগ্রামের গল্পগুলো চোখ ঝাপসা করে দেয়। বড়ই অদ্ভুত জীবন তাদের। জীবনের মায়া ত্যাগ করে এক মুঠো খাবারের খোঁজে পরিবার পরিজন ছেড়ে এই পথ পাড়ি দেয়।
আমার আফ্রিকান বন্ধুটি গল্প বলেই যেতে থাকে।
সৌদিতে প্রবেশের পর তাদের আশ্রয় ছিল বিভিন্ন পাহাড়ের উপত্যকা কিম্বা বড় কোনো পাথরের নিচে। কিছু শুকনো খাবার আর পানি– এগুলো জোগাড় করা অনেক কঠিন কাজ।
আফ্রিকান বন্ধুটি এবার একটু দম নেয়।
সত্যি বলতে কী , এদের জীবন আসলেই কল্পনার চাইতেও কঠিন। তবে ওদের হার না মানা মানসিকতা আমাকে বেশ মুগ্ধ করে। এদের শরীরে যেমন শক্তি, তেমন সাহস। আফ্রিকানরা পরিশ্রমকে যেন পোষাক বানিয়ে নিয়েছে। কাজকে কখনো ছোট করে দেখেনা।
ওদের ভাষা হচ্ছে রোমো। ওরাও আমাদের বাঙ্গালিদের মত ভাংগা ভাংগা অস্পষ্ট আরবী বলে; কিন্তু যখন ওরা আরবী শিখে যায়, আমাদের বাঙ্গালিদের চেয়ে অনেক ভালো আরবী বলে।
অনেকটা আঞ্চলিক আরবীটাই তারা শিখে ফেলে, গাড়ি চালানোর সুবাদে ওদের সাথে আমার চলাফেরা অনেক বেশি। ইদানীং তাদের খাবার -দাবার আমি ই অর্ডার নিয়ে থাকি।
জীবন কত বিচিত্রময়। প্রবাস জীবন আমার চোখ কান খুলে দিয়েছে।