Home শিল্প সাহিত্যস্মৃতি-গদ্য / গাজা : আগুন নিভেছে, হৃদয়ের ক্ষত এখনও জলছে

স্মৃতি-গদ্য / গাজা : আগুন নিভেছে, হৃদয়ের ক্ষত এখনও জলছে

by MD JUNAYED SHEIKH
গাজা : আগুন নিভেছে, হৃদয়ের ক্ষত এখনও জলছে

শব্দ থেমে গেছে, তবু এখনো বাজে আমার ভেতরে—
ক্ষেপণাস্ত্রের গর্জন, বিস্ফোরণের তাণ্ডব,
ড্রোনের নিরলস গুঞ্জন, আর্তনাদে ফেটে পড়া বাতাস।
“শহীদ! শহীদ!” বলে ছুটে আসা চিৎকার,
কাচ ভাঙার শব্দ, দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করা,
ভবন ধসে পড়ার মুহূর্ত, আগুনের লেলিহান শিখা।
বজ্রপাত, বৃষ্টি, উন্মত্ত বাতাস,
মৃত্যুর ভারী নিঃশ্বাস, অন্ধকারের দহন,
সব মিশে আছে আমার স্মৃতির ধুলোয়।

প্রায় এক বছর হলো গাজা ছেড়েছি,
কিন্তু যুদ্ধ আমাকে ছাড়েনি।
আমার একান্নবর্তী পরিবার ফেলে এসেছি,
বাড়ি আর শৈশবের উঠোন ছেড়েছি,
বন্ধুদের হাসিমুখ, চেনা রাস্তা, কোলাহল ফেলে এসেছি।
কিন্তু স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ,
শোকের অনুরণন,
এখনো আমার ভেতরে ধ্বনিত হয়।

যুদ্ধের ছায়া শুধু ভূমিতে পড়ে না,
সে মনেও থেকে যায়,
অতীতের ধ্বংসস্তূপ হয়ে,
প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফিরে আসে।

এখানে, কায়রোতে, গাজার সেই প্রথম চার মাস—
যা দেখেছিলাম, যা শুনেছিলাম, যা অনুভব করেছিলাম—
সবকিছু এখনো আমাকে তাড়া করে।
যুদ্ধের ক্ষত শুধু শরীরে নয়,
মনের ভেতরেও গভীর দাগ কেটে গেছে।
প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি শোক—
সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য ভার বয়ে চলেছি,
যা কায়রোর আকাশেও হালকা হয় না।

এখনও যখন উড়োজাহাজের শব্দ কানে আসে,
হৃদয় কেঁপে ওঠে— মনে হয় যুদ্ধবিমান উড়ছে।
আতশবাজির শব্দ শুনলেই আতঙ্ক গ্রাস করে,
মনে হয়— আবার কোনো বিস্ফোরণ!

আমি ভেবেছিলাম নির্বাসন মানে নিরাপত্তা,
শান্তি ও আশ্রয়।
কিন্তু বুঝলাম, নির্বাসনও যুদ্ধেরই আরেকটি রূপ,
যেখানে গোলাবারুদের বদলে
স্মৃতি বিস্ফোরিত হয় প্রতিটি মুহূর্তে।

গাজার মৃত্যু আর ধ্বংস এখনো আমাদের জীবনের ওপর ছায়া ফেলছে।
সেই দুঃখ, যন্ত্রণা, আর বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই—
যা ভেবেছিলাম পেছনে ফেলে এসেছি,
তা আজও আমাদের পদে পদে অনুসরণ করে,
অতীত নয়, বরং বর্তমানেরই এক দীর্ঘ ছায়া হয়ে।

আমরা বৃষ্টিতে ভেজা তাঁবুর নিচে থাকি না,
ক্ষুধার্তও নই,
বোমার শব্দও বাস্তব নয়—
জানি, সবই আমাদের মনের গভীরে বাজতে থাকা স্মৃতির প্রতিধ্বনি।
তবু যন্ত্রণা আমাদের ছাড়েনি।

আমার বাবা— আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি,
মাসের পর মাস চাকরির সন্ধানে ঘুরেছেন,
যখন পেয়েছিলেন, সেই কাজের বেতন ছিল তুচ্ছ।
ঋণের ভার বেড়েছে,
আর মৌলিক চাহিদাগুলো ক্রমশই অধরা হয়ে থেকেছে।
যুদ্ধ হয়তো পেছনে ফেলে এসেছি,
কিন্তু তার ছায়া আজও আমাদের জীবনকে গ্রাস করে আছে।

এদিকে গাজার ভয়াবহতায় পুরোপুরি ডুবে আছি।
সেই বোমা হামলা, নির্বিচার গণহত্যা, ছিন্নভিন্ন তাঁবুর দুর্ভোগ—
এসব এক মুহূর্তের জন্যও দূরে থাকছে না।
মেসেজিং অ্যাপের পর্দায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে আসছে মৃত্যুর খবর,
ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া আর্তনাদ।
শরীর এখানে, কিন্তু মন যেন এখনো গাজার সেই ধ্বংসের মাঝে।

এখানে দেখি, আমার সব ফিলিস্তিনি বন্ধুরই একই অবস্থা—
যুদ্ধ তাদের ঘিরে রেখেছে, অবরুদ্ধ করেছে মন ও জীবন।
তারা বেঁচে আছে, কিন্তু যন্ত্রণার মাঝে;
স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু হতাশার অন্ধকারে।
যুদ্ধ শুধু ভূমি গ্রাস করেনি,
গ্রাস করেছে আশা, হাসি, শান্তি—
সবকিছু।

“আমি বেঁচে না থেকে তাদের সঙ্গে মরে যেতে চেয়েছিলাম।”
আমার বন্ধু দুআ সম্প্রতি আমাকে এই কথাগুলো বলেছিল,
তার পরিবার যখন জেনোসাইড শুরু হওয়ার পর তাকে কায়রোতে শান্তিতে পড়াশোনা শেষ করতে পাঠিয়েছিল।
কাঁদতে কাঁদতে সে আরও বলেছিল,
“যখন তাদের বিদায় জানালাম, আমার মনে হয়েছিল,
তাদের আমি আর কখনো দেখব না।”

এ ব্যথা ছিল অসহনীয়, তাই সে তার পড়াশোনায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়।
আজও সে তার অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে,
এবং আমাকে বলেছিল, তার বাড়িওয়ালা শিগগিরই তাকে উচ্ছেদ করবে,
কারণ ভাড়া দিতে পারছে না।
সে এখন একা, নির্বাসনে,
আর শিগগিরই হয়তো গৃহহীন হয়ে পড়বে।
তিনিও এখন আর সবকিছুর সাথেই যুদ্ধ করছেন—
তথ্যহীন, নিঃস্ব, নিঃশব্দ।

আমার আরেক বন্ধু রাওয়ান, যে একদিন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে মিসরে পড়াশোনা করতে এসেছিল,
২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর সব কিছু হারালো।
বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেল, পরিবার একে একে ছিনিয়ে নেওয়া হল,
শুধু তার মা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেন,
অথবা তার বোন, যিনি অন্য একটি বাড়িতে ছিলেন।

সে এখন স্মৃতির অবশিষ্টাংশ—
বাবার উৎসাহজনক বার্তা, ভাইদের সাহস,
আর বোনের নিষ্পাপ হাসি মনে পড়ে।
পড়াশোনা কখনো শেষ হয়নি,
এখন সে যেন নিজেকেই খুঁজে পায় না।
একটি ছায়ার মতো বেঁচে থাকা,
একটি নিঃশব্দ যন্ত্রণার জীবন্ত সাক্ষী।

নাদা, আরেক বন্ধু, তার বোনের সঙ্গে কায়রোতে থাকে,
গাজা ছেড়ে এসেছে, কিন্তু কিছুই তাদের কাছে নেই।
বাবা-মা, ভাই, সব কিছুই পেছনে পড়ে গেছে,
কারণ রাফা ক্রসিংয়ে যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
এখন তারা নির্বাসিত, শূন্যতায় ভরা,
বাড়ির স্মৃতির ভারে চাপা পড়া,
নতুন পৃথিবীতে একা, হারানো আত্মা হয়ে।

আত্মীয়দের কোনো সহায়তা ছাড়া নাদা আর তার বোন একা,
অন্ধকারে একটুকু আলো খুঁজে চলেছে।
মানসিক চাপ, যন্ত্রণা, সব কিছুই তাদের ওপর জেঁকে বসেছে।
সে এখন অনেকটা ওজন হারিয়ে ফেলেছে,
এবং নিজের ভাষায়, তাকে কঙ্কালের মতো দেখায়।

“আমরা আমাদের ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত ফিরে পেতে চাই,”
সে বলেছে, যেন অতীতের সুখী দিনগুলো ফিরে পাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে,
বর্তমানের শূন্যতায় ভেসে চলা।
এখন তারা যেন একটি একক জীবন,
অতীতের সুখ, বর্তমানের অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যাওয়া।

আমরাও চাই, তবে জানি,
আমাদের ফেলে আসা জীবনের সব কিছুই হারিয়ে গেছে,
যুদ্ধের ধ্বংসে হারিয়ে গেছে সুখের স্মৃতি,
এমনকি যুদ্ধ শেষ হলেও কিছুই আগের মতো হবে না।
আমাদের অপূরণীয় ক্ষতির জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ আসবে না।

যুদ্ধবিরতি আজ কার্যকর হয়েছে,
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হবে কিনা,
তা স্পষ্ট নয়।
বুধবার ঘোষণার পর থেকে,
১২০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
আমরা জানি, আরও প্রাণ যাবে,
কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
কারণ গাজা এখন আর বসবাসের উপযোগী নয়।

যুদ্ধবিরতির পর, যদি শান্তি স্থাপন হয়ও,
তবুও ইসরায়েলি সরকার তাদের শর্তে অবরোধ চালিয়ে যাবে,
আর জনগণের উপর অত্যাচার অব্যাহত থাকবে।
পুনর্গঠন—যদি কখনো শুরু হয়—
তবে তা বহু বছর ধরে চলবে।

এজন্যই আমরা, একটি পরিবার হিসেবে,
নির্বাসনে নতুন জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,
একমত হয়ে, যতই সমস্যা আসুক সামনে,
আমাদের চলতে হবে।

রিম স্লিম, মিশরে আশ্রিত একজন ফিলিস্তিনি কবি, যার কবিতা জীবনের বেদনা, সংগ্রাম এবং আশা-নিরাশার গভীরে প্রবাহিত। গাজার ভয়াবহতা থেকে পালিয়ে এসে, তিনি মিশরে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু তার হৃদয় এখনো সেই বিপর্যয়ের শিখায় পোড়া। তার লেখা জীবনের নানা দিক, বিশেষত যুদ্ধ, নির্বাসন এবং গৃহহীনতার অনুভূতির একটি অবিচ্ছেদ্য চিত্র।

রিমের কবিতায় সবার জন্য একটি মর্মস্পর্শী বার্তা রয়েছে—
একটি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, একটি জীবনের আশা, যা কেবল কষ্টের মধ্য দিয়েই জীবিত থাকে।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment