ইতালি এসেছি প্রায় বছর খানিক হতে চলল। প্রবাস জীবনের প্রথম রমজান শুরু হয়েছে গতকাল থেকে– বেশ উপভোগ করছি। ইতালির ভেনিস, পাদোভা শহরের একটি মফস্বল এলাকায় থাকি। আমাদের আশপাশে মুসলমানের সংখ্যা নগণ্য। এই পাদোভা শহরতলিতে ৩০ জনের মত মুসলিম বাস করি। সবাই বাংলাদেশি। সেহরি , ইফতার সবকিছু নিজেরা ইন্তিজাম করেছি।
ইতালি একটি খ্রিস্টান প্রধান দেশ হওয়ায় এখানে বাংলাদেশ বা অন্য মুসলিম দেশের মত সচরাচর মসজিদ পাওয়া যায় না। ইউরোপে বাসা ভাড়া ব্যয়বহুল হওয়ায় সবখানে মসজিদ স্থাপনেরও সুযোগ নেই।
ইতালিতে পরিসরের তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় শহরগুলো খুব ফাঁকা। আমাদের দেশের তুলনায় মনুষ্য বসতির সংখ্যা খুব কম।
যেখানে যেই দেশের মুসলিমরা সংখ্যায় বেশি হয়ে থাকে সেখানে সেই দেশের মসজিদ স্থাপন করে থাকে। আমরা যেখানে থাকি–পাদোভা শহর– এখানে বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা কম হওয়ায় আমাদের নিজস্ব মসজিদ নেই।
অদূরে একটি মরক্কিয়ান মসজিদ আছে , সেখানে আমরা ওয়াক্তিয়া এবং জুম্মার সালাত আদায় করে থাকি।
মরক্কিয়ানরা আরবি ভাষাভাষী হওয়ায় জুম্মার বয়ানসহ সকল কিছু আরবিতে হয়ে থাকে।
ভাষা হিসেবে আরবি অনেক সমৃদ্ধ। উচ্চারণও বেশ মধুর। শৈশবে মাদ্রাসায় পড়েছিলাম বিধায় দুয়েকটি শব্দ বুঝতে পারি। আরবি ভাষা পুরোপুরি না বোঝায় কিছুটা আফসোস হয়।
২
রমজানের নতুন চাঁদ দেখা গিয়েছে। ইতালির আকাশে কোন আনন্দ, উচ্ছ্বাস নেই । আমাদের শৈশবের চিরায়ত হই-হুল্লোড় খুব মিস করছি।
এশার নামাজের খানিক পূর্বে তারাবির সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মরোক্কান মসজিদে গেলাম।
চিরায়ত বিশ রাকাতের পরিবর্তে এদেরকে আট রাকাত তারাবি নামায আদায় করতে দেখে হতবাক হলাম। মসজিদের পার্শ্ববর্তী একটি রুমে মহিলারাও জামাতে শরিক হয়েছেন।
আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে, ছোটবেলায় কওমি মাদ্রাসায় পড়ার কারণে তারাবির রাকাত সংখ্যা নিয়ে কোন ঝামেলায় পড়তে হয় নি। অদ্যাবধি বিশ রাকাত তারাবিই পড়ে আসছি, আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের কিছু বাঙালি ভাই মরক্কানদের সাথে আট রাকাত তারাবিতে অংশগ্রহণ করলেন। তাদেরকে বলি যে, আমাদের মাযহাবের নিয়ম অনুযায়ী তারাবির সালাত ২০ রাকাতই আদায় করতে হবে। এটাই প্রকৃত সুন্নাত। আমার উক্ত কথা দুয়েকজন না শুনলেও অধিকাংশই ভাই-বন্ধু আমার কথায় সায় দিয়েছেন। তারাবির অবশিষ্ট বারো রাকাত বাসায় এসে জামাত সহকারে আদায় করেছি।
৩
এইখানে আমরা একটি ফ্লাটে ১০ জন স্বদেশী লোক ভাগাভাগি করে থাকি। দুইটি রুম ও একটি ওয়াশরুম রয়েছে।
মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন সাহারি খাওয়ার জন্য জাগি, তখন ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য একপ্রকার লাইন ধরতে হয়। এ নিয়ে পরস্পর খুনসুটি করি। একসাথে কয়েকজন বাঙালি থাকা মানে আনন্দের উপলক্ষ। একে একে ফ্রেশ হয়ে একসাথে টেবিলে খেতে বসি।
যদিও সবাই একসাথে টেবিলে বসে আহার করি; কিন্তু রান্না হয় আলাদা , তিনটি স্থানে। তিনটি ম্যাস রয়েছে। তিনটি ম্যাসে আলাদাভাবে, ভিন্ন রকম রান্না হয়। রান্না শেষে সবাই মিলে একসাথে ভাগ-বন্টন শেষে আহার করি।
খাওয়া শেষে কিছুক্ষণ গল্প করি। বেশিরভাগই গ্রামের অতীত গল্প। ইতালির বর্তমান নিরস গল্পও থাকে। গল্প করতে করতে যখন সাহরির সময় শেষ হয়ে যায় তখন ‘মুসলিম বাংলা অ্যাপে’র সময়সূচী অনুযায়ী আমাদের ফোনে আজান দিয়ে থাকে।
ইতালিতে মাইকে আযান একপ্রকার নিষিদ্ধ। সেই ক্ষেত্রে মুসলিম বাংলা অ্যাপস এবং এখানকার সিটি মসজিদের সময়সূচির একটি ক্যালেন্ডারের অনুসারে সবকিছু পালন করে থাকি ।
এই অ্যাপস এবং সিটি ক্যালেন্ডারটি আমাদের বিপদের বন্ধু।
আজান শেষে সুন্নত আদায় করি তারপর আমরা রুমে বসেই ফজরের সালাত জামাত সহকারে আদায় করে থাকি। ইমামতির দায়িত্ব অধিকাংশ সময় আমাকেই সামলাতে হয়। শৈশবে হিফজখানায় পাঁচ পারা মুখস্থ করেছিলাম।
৪
নামাজ শেষে বাঙ্গালিদের ঘুমের অভ্যাস। সেই চিরায়ত অভ্যাস বাঙালি ইতালিতেও বহন করে নিয়ে এসেছে। নামায শেষ হতেই সবাই ঘুমিয়ে যায়।
ডিউটির সময় অনুযায়ী একেকজনের ঘুম ভাঙ্গে। যখন যার কাজ, তখন সে ঘুম থেকে উঠে ডিউটিতে চলে যায়। কাজের ব্যস্ততার দরুন সেহরির মত ইফতার একসাথে করা হয় না। যার যার কর্মস্থলে ইফতার সেরে থাকেন।
আমরা যারা বাসায় থাকি, আসরের সালাত আদায় করে ইফতার এবং রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে যাই। সবাই মিলে একসাথে মজা করে ইফতার এবং রান্না সম্পূর্ণ শেষ করে একসাথে ইফতারি নিয়ে বসি। দেশ নিয়ে স্মৃতিচারণ করি। সবচেয়ে পীড়া দেয়, মাইকে আজান শুনতে না পারার বিষয়টি। এ নিয়ে বিস্তর আফসোস হয় সবার মধ্যে।
মুসলিম বাংলা অ্যাপসের আযান শুনে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই — এই আর-কি।
ইফতারি শেষ করে সালাত আদায়ের জন্য একজনকে মসজিদে খোঁজ নিতে পাঠাই– ওখানে জামাত হবে কি-না।
আমাদের দেশে সাধারণত মাগরিবের আযান থেকে নিয়ে দশ – পনেরো মিনিট পরে জামাত শুরু হয় কিন্তু এখানে উল্টো।
মরক্কিয়ানরা খেজুর এবং দুধ দিয়ে ইফতার সেরে তাড়াতাড়ি নামাযে দাঁড়িয়ে যায় । একদম
সাদামাটা স্বাস্থ্যসম্মত ইফতার।
এখানকার ম্যাক্সিমাম লোক ব্যস্ত থাকায় মসজিদে আমাদের দেশের মত ওরকম ভারি কোন ইফতারির আয়োজন হয় না।
আমাদের ইফতার সারতে বিলম্ব হয় বিধায় বাসায় জামাত সহকারে সালাত আদায় করি।
৫
পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মরক্কিয়ান — তিন জাতির ভাষা সংস্কৃতিতে অনেক তফাৎ থাকলেও আমরা একটি জায়গায় সবাই এক — আমরা মুসলমান।
বিদেশ বিভূঁইয়ে এই অনন্য, অদ্বিতীয়, অতুলনীয় ও সুন্দর পরিচয়টি আমাদের সবার জন্য খুব আনন্দ, উপভোগের। আলহামদুলিল্লাহ।
মরক্কান ভাইদের সঙ্গে আরবিতে কথা বলতে পারিনা বটে; কিন্তু তারা অনেক ভালো মনের মানুষ। ইশারা ইঙ্গিতে ভাবনা , ভালোবাসার আদান প্রদান করি।
আমাদের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ হলে হাসি বিনিময় হয়। মনটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে খুব। ভীষণ ভালো লাগে।