মূল : রোজিনা আলি
তরজমা : মুহাম্মাদ হাসিবুল হাসান
রুমির আলোকধারা: পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ
পশ্চিমা বিশ্বে জালালউদ্দীন রুমিকে মূলত একজন মরমি সাধক, আধ্যাত্মিক আলোকিত পুরুষ হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু খুব কমই তাঁকে মুসলিম কবি হিসেবে পরিচিত করা হয়।
প্রায় দুই বছর আগে, সংগীতশিল্পী ক্রিস মার্টিন যখন অভিনেত্রী গিনেথ প্যালট্রোর সঙ্গে বিচ্ছেদের কঠিন সময় পার করছিলেন, তখন এক বন্ধু তার মনোবল চাঙা করতে তাকে একটি বই উপহার দেন। সেটি ছিল ত্রয়োদশ শতকের পারসিক কবি জালালউদ্দীন রুমির কবিতার সংকলন, যা কোলম্যান বার্কস ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে মার্টিন বলেন, “বইটি যেন আমার জীবন বদলে দিয়েছিল।”
রুমির ভাবধারা তাঁকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে, কোল্ডপ্লের সাম্প্রতিক অ্যালবামে বার্কসের কণ্ঠে রুমির একটি কবিতাও সংযোজিত হয়েছে—
“এই মানবদেহ এক পান্থশালা,
প্রতিদিন ভোরে নতুন কেউ এসে হাজির হয়।
আনন্দ, বিষণ্নতা, নীচতা—
ক্ষণিকের জন্য সচেতনতার আভাস দেয়,
অনাহূত অতিথির মতো।”
রুমি: পশ্চিমা দুনিয়ায় তাঁর পরিচিতি
রুমির রচনা যুগে যুগে বহু মানুষের আত্মিক পথচলায় আলো জ্বেলেছে। ম্যাডোনা থেকে টিল্ডা সুইনটন—অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব তাঁদের সৃজনশীল কাজের অনুপ্রেরণা হিসেবে রুমির কবিতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আজকের দিনে তাঁর নামে চালু হওয়া নানা উক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে আত্মউন্নয়ন ও অনুপ্রেরণার উৎস। যেমন—
“প্রতিটি ঘর্ষণে বিরক্ত হলে চকচকে হয়ে উঠবে কীভাবে?”
“প্রতিটি মুহূর্তে আমি নিজের নিয়তি খোদাই করি, আমি নিজের আত্মার ছুতোর।”
বিশেষ করে কোলম্যান বার্কসের ইংরেজি অনুবাদের হাত ধরে রুমির কবিতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বইয়ের দোকানগুলোতে তাঁর কবিতার সংকলন সহজেই চোখে পড়ে, এমনকি বহু বিয়ের অনুষ্ঠানে রুমির কবিতা আবৃত্তি করা হয়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বেস্টসেলিং কবি বলা হয়ে থাকে। তবে কৌতূহলের বিষয় হলো—আজীবন কোরআন ও ইসলামের গভীর অধ্যয়নে নিমগ্ন এই সুফি সাধককে সাধারণত মরমি, আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক বা সুফি গুরু হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও তাঁকে মুসলিম পরিচয়ে তেমন তুলে ধরা হয় না।
ক্রিস মার্টিনের অ্যালবামে ব্যবহৃত কবিতার অংশ রুমির মহাকাব্য ‘মসনবি’ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার পঙক্তির এই অসামান্য গ্রন্থের অধিকাংশই রচিত হয়েছে ফার্সি ভাষায়, যেখানে কোরআনের বহু আয়াতের উদ্ধৃতি রয়েছে। রচনার মধ্যে কোরআনের কাহিনি ও নৈতিক শিক্ষার ঘনঘন উল্লেখ থাকায়, কিছু পণ্ডিত একে “ফার্সি কোরআন” বলেও অভিহিত করেছেন। যদিও এই মহান রচনা অসমাপ্ত রয়ে গেছে, তবুও এর গভীর অন্তর্দৃষ্টি যুগে যুগে মানবজাতির আত্মিক সন্ধানকে পথ দেখিয়ে চলেছে।
রুমি: আধ্যাত্মিকতা, ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্ব
মারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্সিয়ান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ফাতেমেহ কেশাভার্জ মনে করেন, রুমির কবিতায় কোরআনের এত বেশি উদ্ধৃতি পাওয়া যায় যে, তিনি সম্ভবত কোরআন সম্পূর্ণ মুখস্থ করেছিলেন। স্বয়ং রুমি ‘মসনবি’-কে ইসলাম ও কোরআনের ব্যাখ্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে বহুল বিক্রীত অনুবাদগুলোতে ধর্মের এই গভীর প্রভাব প্রায় অনুপস্থিত।
রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিবাদ বিশেষজ্ঞ জাওয়িদ মোজাদ্দেদি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মানুষের ভালোবাসার রুমি ইংরেজিতে দারুণ চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছেন, তবে আপনাদের পরিশোধিত সংস্কৃতিতে ধর্ম ও ইসলাম বাদ দেওয়া হয়েছে।”
এই প্রসঙ্গটি রুমির ভাবাদর্শের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করে। পশ্চিমা বিশ্বে রুমির আধ্যাত্মিক দিকটি প্রশংসিত হলেও, তাঁর ইসলামি পরিচয় প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। অথচ রুমির রচনা কেবল এক আত্মিক দর্শনের নয়; বরং তা ইসলামের গভীরতম সত্য, কোরআনের শিক্ষা ও নবীজীর আদর্শের ছায়ায় গড়ে ওঠা এক মহান কাব্যিক সৃষ্টি।
রুমির পথচলা: জ্ঞান, সুফিবাদ ও শামস-ই তাবরিজ
ত্রয়োদশ শতকে বর্তমান আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন জালালউদ্দীন রুমি। শৈশবে পরিবারসহ তিনি বর্তমান তুরস্কের কোনিয়ায় স্থায়ী হন। তাঁর বাবা ছিলেন এক প্রখ্যাত ধর্মীয় পণ্ডিত ও ইমাম, যিনি রুমিকে সুফিবাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ থেকে রুমি সিরিয়ায় গিয়েও ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চা চালিয়ে যান এবং সুন্নি ইসলামের প্রচলিত আইনি বিধিবিধান নিয়ে গবেষণা করেন। পরে তিনি কোনিয়ায় ফিরে এসে পাঠাগারের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
এখানেই তাঁর পরিচয় ঘটে এক রহস্যময় ভ্রমণকারী, শামস-ই তাবরিজের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে শামস রুমির আধ্যাত্মিক পথচলায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেন এবং তাঁর আত্মিক গুরু হয়ে ওঠেন।
রুমি ও শামসের সম্পর্ক নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এটি নিশ্চিত যে, শামস রুমির ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও কাব্যজীবন আমূল বদলে দিয়েছিলেন। ‘রুমি’জ সিক্রেট’ বইতে ব্র্যাড গুচ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে শামস তাঁকে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন করেন এবং আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি ভক্তির ধারণায় অনুপ্রাণিত করেন। শামসের শিক্ষা রুমিকে প্রচলিত ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। একসময় তিনি সুন্নি ইসলামের আইনি বিধানের সঙ্গে সুফিবাদের গভীর খোদাপ্রেম ও শামসের কাছ থেকে শেখা আধ্যাত্মিক দর্শনকে মিলিয়ে নেন।
শামসের অন্তর্ধানের পর, গভীর শোকে মগ্ন রুমি তাঁর কাব্যিক প্রতিভার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটান, যা পরবর্তী সময়ে তাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির আসনে বসায়।
রুমি: সার্বজনীন প্রদীপশিখা ও ইসলামের গভীর ছায়া
মারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাতেমেহ কেশাভার্জ মনে করেন, রুমির চিন্তার গভীরতা ও জটিল বিন্যাস তাঁকে তাঁর সমসাময়িকদের থেকে আলাদা করেছিল। তবে তাঁর অনুসারীদের মধ্যে শুধু সুফি বা মুসলিম আলেমই ছিলেন না; খ্রিস্টান, ইহুদি এমনকি স্থানীয় সেলজুক শাসকেরাও তাঁর জ্ঞানের আলোয় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই বৈচিত্র্যময় অনুসারীসমাজ কোনিয়ার কসমোপলিটান পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল।
‘রুমি’জ সিক্রেট’ বইতে ব্র্যাড গুচ রুমির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবগুলো তুলে ধরে লিখেছেন, “রুমি একটি ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; সারা জীবন নিয়মিত নামাজ ও রোজা পালন করেছেন।” তবে তাঁর লেখায় একধরনের দোটানা স্পষ্ট। তিনি যেমন রুমির ধর্মীয় জীবন ও ইসলামের প্রতি তাঁর গভীর সংযোগের কথা বলেছেন, তেমনই তাঁকে “সব সংগঠিত ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠা এক ‘ভালোবাসার ধর্মের’ অনুসারী” হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টাও করেছেন।
এই ধরনের ব্যাখ্যা অনেক সময় রুমির ইসলামী শিক্ষা ও বিশ্বাসের প্রকৃত ভিত্তিকে আড়াল করে দেয় এবং ভুল ধারণার জন্ম দেয়। রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিবাদ বিশেষজ্ঞ জাওয়িদ মোজাদ্দেদি এই প্রসঙ্গে বলেন, “কোরআন সর্বজনীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছে এবং খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ‘কিতাবধারী জাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।”
আজকের বিশ্বে রুমির প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা ও সর্বজনীনতার স্বীকৃতি দেখা যায়, সেটিও মূলত তাঁর মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উৎসারিত। তাঁর রচনা শুধুমাত্র প্রেম ও আধ্যাত্মিকতার প্রতিচ্ছবি নয়; বরং তা ইসলামের শিক্ষার গভীর আলোকে আলোকিত এক ব্যাখ্যা, যা সকল মানুষের জন্য ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়।
রূমির ইসলামী শেকড় মুছে ফেলার দীর্ঘ প্রচেষ্টা
কোল্ডপ্লের সম্পৃক্ত হওয়ার বহু আগেই রূমির কবিতা থেকে ইসলামকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওমিদ সাফি জানিয়েছেন, ভিক্টোরীয় যুগ থেকেই পশ্চিমা পাঠকরা রূমির অতীন্দ্রিয় কাব্যকে তার প্রকৃত ইসলামী শেকড় থেকে আলাদা করার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। সে সময়ের অনুবাদক ও ধর্মতত্ত্ববিদরা রূমি ও হাফিজের মতো কবিদের রচনা ইসলামের কঠোর নৈতিক ও আইনি বিধিবিধানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি।
সাফির ভাষায়, তারা যে ব্যাখ্যায় স্থির হয়েছিলেন, তা হলো— “এই কবিদের আধ্যাত্মিক ভাবনার বিকাশ ইসলামের কারণে নয়, বরং ইসলাম থাকা সত্ত্বেও হয়েছে।” এটি এমন এক সময়ের কথা, যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে আইনি বৈষম্য ক্রমশ প্রকট হচ্ছিল। ১৭৯০ সালের এক আইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম অভিবাসনের সংখ্যা সীমিত করা হয়। এক শতাব্দী পর, ১৮৯৮ সালে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট মুসলমানদের সম্পর্কে মন্তব্য করে— “অন্য সকল গোষ্ঠী, বিশেষ করে খ্রিস্টানদের প্রতি মুসলিম বিশ্বাসের লোকেরা চরম বৈরিতা পোষণ করে।”
এই প্রেক্ষাপটেই ১৮৯৮ সালে মসনবির অনুবাদের ভূমিকায় স্যার জেমস রেডহাউস লিখেছিলেন, “মসনবি তাদের জন্য, যারা পার্থিব জীবন পরিত্যাগ করে ঈশ্বরকে জানার ও তার সান্নিধ্যে থাকার প্রয়াসী, যারা নিজেদের সত্তাকে বিলীন করে আধ্যাত্মিক ধ্যানে নিমগ্ন হতে চায়।” এখানেই প্রতিফলিত হয় পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রূমিকে ইসলাম থেকে আলাদা করার প্রবণতা।
অনুবাদে ইসলামের অনুপস্থিতি
বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট অনুবাদকদের মধ্যে ছিলেন আরএ নিকলসন, এজে আরবেরি ও আনামেরি শিমেল, যাঁরা ইংরেজি ভাষায় রূমির উপস্থিতি সুসংহত করেছেন। তবে রূমির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত করেছেন মূলত কোলম্যান বার্কস। তিনি অনুবাদক কম, ব্যাখ্যাকারী বেশি। ফার্সি ভাষা পড়তে বা লিখতে না পারলেও তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর অনুবাদগুলোকে নতুনভাবে আমেরিকান কবিতার ছন্দে রূপান্তর করেন।
বার্কসের অনুবাদ একেবারেই স্বতন্ত্র রীতির। ১৯৩৭ সালে জন্ম নেওয়া বার্কস টেনেসির চাত্তানুগায় বেড়ে ওঠেন। ইংরেজি সাহিত্যে পিএইচডি সম্পন্ন করার পর ১৯৭১ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘দ্য জুস’ প্রকাশিত হয়। ওই দশকের শেষদিকে কবি রবার্ট ব্লাই তাঁকে এজে আরবেরির অনূদিত রূমির একটি সংকলন দেন এবং বলেন, “এই কবিতাগুলোকে খাঁচা থেকে মুক্ত করো”— অর্থাৎ সেগুলোকে আমেরিকান পদ্যের ছন্দে রূপান্তর করো। এই সূত্রেই প্রথমবার রূমির কবিতার সংস্পর্শে আসেন বার্কস, যা পরে রূমির ইসলামহীন এক নতুন ব্যাখ্যার ভিত্তি স্থাপন করে।
রূমির কবিতার বিকৃত অনুবাদ ও ইসলামবিচ্ছিন্নতা
রবার্ট ব্লাই দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বই ‘আইরন জন: আ বুক অ্যাবাউট মেন’ আধুনিক পুরুষতন্ত্র বিষয়ক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি নিজেও কিছু রূমির কবিতা অনুবাদ করেছিলেন।
অন্যদিকে, কোলম্যান বার্কস কখনো ইসলামী সাহিত্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা করেননি। তবে একদিন তিনি এক ব্যতিক্রমী স্বপ্ন দেখেন— নদীর ধারে এক পাহাড়ের ওপর তিনি ঘুমিয়ে আছেন, হঠাৎ এক আলোকময় সত্তা এসে বলেন, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” অচেনা এই ব্যক্তির মুখ তাঁর পরিচিত ছিল না। কিছুদিন পর ফিলাডেলফিয়ার এক সুফি গোষ্ঠীতে যোগ দিয়ে তিনি সেই একই ব্যক্তিকে বাস্তবে দেখতে পান। সেই গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন তিনি। এরপর থেকেই বার্কস গভীরভাবে রূমির কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রতিদিন বিকেলে ব্লাইয়ের দেওয়া ভিক্টোরিয়ান যুগের অনুবাদ পর্যবেক্ষণ করতেন এবং সেগুলোকে নতুনভাবে সাজাতেন।
ইসলামবিহীন রূমির রূপান্তর
সময়ের পরিক্রমায় বার্কস রূমির কবিতার একাধিক সংকলন প্রকাশ করেন, যা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি রূমির কবিতাকে বর্ণনা করেছেন ‘হূদয় উন্মুক্ত করার রহস্য’ হিসেবে— এমন এক অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যাতীত সত্যের সন্ধানে তিনি রূমির রচনায় বিরাট স্বাধীনতা নিয়েছেন, বিশেষ করে ইসলামের উল্লেখ কমিয়ে দিয়েছেন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ‘লাইক দিস’ নামে রূমির একটি কবিতার অনুবাদ। আরবিতে কবিতাটির একটি পঙ্ক্তির অর্থ দাঁড়ায়:
‘হুরের কথা কেউ জানতে চাইলে (তোমার) চেহারা দেখিয়ে (বলো) “এই রকম”।’
ইসলামে হুরকে স্বর্গের প্রতিশ্রুত কুমারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। কিন্তু বার্কস সরাসরি ‘হুরি’ শব্দটির অনুবাদই এড়িয়ে গেছেন। বরং তার ভাষ্যে তা হয়ে গেছে: ‘কেউ যদি জানতে চায় আমাদের সব যৌন চাহিদার নিখুঁত তৃপ্তি কেমন হবে, তোমার মুখ তুলে বলো, “এই রকম”।’
এখানে ধর্মীয় প্রেক্ষিত একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। অথচ একই কবিতায় যিশু ও যোসেফের উল্লেখ তিনি বহাল রেখেছেন। যখন এ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি বলেন, ইসলামী প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন কি না তা তিনি স্মরণ করতে পারছেন না। তাঁর ভাষ্য:
‘আমি প্রেসবিটারিয়ান হয়ে বড় হয়েছি। বাইবেলের অনেক পঙ্ক্তি মুখস্থ করেছি, কোরআনের তুলনায় নিউ টেস্টামেন্ট আমার বেশি পরিচিত। কোরআন পড়া কঠিন।’
এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়, বার্কসের অনুবাদ মূলত পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে রূমিকে নতুনভাবে নির্মাণ করার প্রয়াস। তাঁর পাঠে রূমির গভীর ইসলামী শেকড়কে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, যা আধুনিক পাঠকদের কাছে রূমিকে এক ‘ধর্মনিরপেক্ষ আধ্যাত্মিক কবি’ হিসেবে তুলে ধরার এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা।
রূমির বিকৃত অনুবাদ ও আধ্যাত্মিক উপনিবেশবাদ
যুক্তরাষ্ট্রে রূমির কবিতার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল কোলম্যান বার্কসের। তিনি রূমির জীবন ও রচনা নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন ঠিকই, তবে তাঁর করা ‘অনুবাদ’ মূল রচনার চেয়ে অনেক বেশি দূরে সরে গেছে।
এমনকি বার্কস ছাড়াও আরও কিছু ভুয়া ‘অনুবাদ’ রয়েছে, যা মূল ফার্সি রচনার সঙ্গে খুব সামান্যই মিল রাখে। যেমন, দীপক চোপড়া ও ড্যানিয়েল ল্যাডিনস্কির বইগুলো। এসব বই রূমির নামে বাজারজাত হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর লেখা নয়। বিকল্প চিকিৎসা ও আধ্যাত্মিকতার প্রচারক দীপক চোপড়া নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর লেখা আসলে রূমির বক্তব্য নয়। বরং ‘দ্য লাভ পোয়েমস অব রুমি’ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “এগুলো এক নতুন সৃষ্টিকে জীবন দিয়েছে, তবে মূল ফার্সি কবিতার ‘মেজাজ’ বজায় রেখে কিছু নির্দিষ্ট বাক্যবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে।”
আধ্যাত্মিক উপনিবেশবাদ
এই নিউ এজ অনুবাদ সম্পর্কে ওমিদ সাফি বলেন, “এখানে একধরনের আধ্যাত্মিক উপনিবেশবাদ কাজ করছে। বসনিয়া, ইস্তাম্বুল, কোনিয়া, ইরান থেকে শুরু করে মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের গভীর আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য পাশ কাটিয়ে, মুছে ফেলে দখল করে নেওয়া হয়েছে।”
এই ধরনের বিকৃতি শুধু রূমির রচনার ক্ষেত্রেই ঘটছে না, বরং বৃহত্তর ইসলামী ঐতিহ্যকে পাশ কাটানোর একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। ধর্মীয় প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে আধ্যাত্মিকতাকে পৃথক করার মধ্যে এক ধরনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
আজও নীতিনির্ধারকদের অনেকেই ইসলামকে বিকৃতভাবে চিত্রিত করেন। যেমন, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল মাইকেল ফ্লিন প্রকাশ্যে ইসলামকে ‘ক্যান্সার’ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি এখনো অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি অপশ্চিমা ও অশ্বেতাঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর সভ্যতাকে তুচ্ছ করে দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও রূমির প্রকৃত পরিচয়
বার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে যখন প্রশ্ন তোলা হয়, তখন তিনি বলেন, “ধর্ম আজকের দুনিয়ায় বিতর্কিত প্রসঙ্গ। আমার নিজস্ব সত্য আছে, আপনার নিজস্ব সত্য আছে— কিন্তু আমরা একসঙ্গে আছি, আর আমি আমার হৃদয় উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছি। রূমির কবিতা আমাকে সে পথ দেখায়।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি রূমির প্রকৃত চেতনা ও ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করার এক প্রচেষ্টা। রূমির কবিতায় ইসলামী শিক্ষার গভীর ছাপ রয়েছে। তিনি প্রায়ই কোরআনের আয়াত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতার ছন্দ ও প্রকরণ তৈরি করতেন। তাঁর পারস্যভাষী পাঠকরা এই কৌশল বুঝতে পারতেন, কিন্তু অধিকাংশ আমেরিকান পাঠক ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অনভিজ্ঞ।
ওমিদ সাফির ভাষায়, “কোরআন বাদ দিয়ে রূমিকে বোঝার চেষ্টা করা মানে বাইবেল বাদ দিয়ে মিল্টন পড়ার মতো।”
রূমির কবিতা নিছক ধর্মীয় রূপকথা নয়, বরং ইসলামী পাণ্ডিত্যের চলমান বিকাশের এক অনন্য নিদর্শন। তিনি হয়তো প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে ছিলেন, কিন্তু ইসলামী সংস্কৃতিরই অংশ ছিলেন। তাঁর সময়ের ইসলামী সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বে রূমিকে ইসলামবিচ্ছিন্ন আধ্যাত্মিক কবি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে, যা তাঁর প্রকৃত পরিচয়কে বিকৃত করার শামিল।
রূমির ভাবনার প্রকৃতি ও বিকৃত অনুবাদ
রূমির কবিতা নিয়ে বর্তমান আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে— তাঁকে ইসলামবিচ্ছিন্ন এক আধ্যাত্মিক দার্শনিক হিসেবে উপস্থাপন করা। অথচ প্রকৃতপক্ষে রূমি ইসলামী ভাবধারার গভীর অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর কবিতার কেন্দ্রে ছিল কোরআন, হাদিস, ও ইসলামী আধ্যাত্মিকতা।
বার্কসের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘অনুবাদগুলোর’ একটি হলো:
“সৎ কাজ এবং মন্দ কাজের ধারণার বাইরে একটা ক্ষেত্র আছে, সেখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হবে।”
কিন্তু মূল ফার্সি ভাষ্যে ‘সৎ কাজ’ ও ‘মন্দ কাজ’ শব্দ দুটি ছিল না। বরং রূমি লিখেছিলেন:
“ঈমান (ধর্ম) এবং কুফর (ধর্মহীনতা) এর বাইরেও একটি ক্ষেত্র আছে।”
অর্থাৎ, রূমি বোঝাতে চেয়েছেন, বিশ্বাস শুধু ধর্মীয় বিধিনিষেধে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সহানুভূতি ও ভালোবাসার উচ্চতর অবস্থানে তার ভিত্তি রয়েছে।
রূমির দৃষ্টিভঙ্গি: আধ্যাত্মিকতা বনাম প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম
আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকের কাছে রূমির এই ভাবনা বিপ্লবী মনে হতে পারে, কিন্তু এটি মূলত ইসলামী আধ্যাত্মিকতারই (তাসাউফ) অংশ।
রূমির রচনা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসের মধ্যে এক বৃহত্তর দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে, যদিও তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বুদ্ধিদীপ্তভাবে।
ওমিদ সাফির ভাষায়, “ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, কোরআন ছাড়া মুসলিম কল্পনাকে রূমির মতো করে আর কোনো গ্রন্থ গঠন করেনি, হয়তো হাফিজের কবিতা ছাড়া।”
এ কারণেই রূমির সুবিশাল রচনাসম্ভার যুগের পর যুগ সংরক্ষিত হয়েছে এবং ক্যালিগ্রাফারদের হাতে যত্নের সঙ্গে লেখা হয়েছে।
রূমির অনুবাদ: বিশ্বস্ততা বনাম বিকৃতি
সিনান আন্তুন যথার্থই বলেছেন, “ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি স্মৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভাণ্ডার।”
এই দৃষ্টিকোণ থেকেই অনুবাদকের ভূমিকা নিছক ভাষান্তর নয়, বরং একটি সংস্কৃতির প্রকৃত রূপ সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করা।
রূমির ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাঁর কবিতাগুলো ইসলামী ঐতিহ্যের গভীর বহিঃপ্রকাশ। অন্যথায়, পাঠকের সামনে বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর এক রূমিকে তুলে ধরার আশঙ্কা থাকে।
রূমির মূল পাঠের প্রতি বিশ্বস্ত অনুবাদ
জাওয়িদ মোজাদ্দেদেদির প্রচেষ্টা রূমির প্রকৃত পাঠের প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি মূল ইসলামী ও কোরআনীয় উদ্ধৃতিগুলো চিহ্নিত করেছেন এবং অনুবাদে ব্যাপক টীকাটিপ্পনী যুক্ত করেছেন। ফলত পাঠক রূমির প্রকৃত দর্শন বোঝার সুযোগ পান।
তার অনুবাদ মূল ভাষার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছে, যা বার্কসের মতো অনুবাদকদের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।
কেন বিশ্বস্ত অনুবাদ জরুরি?
রূমির মূল চরিত্র বোঝার জন্য তাঁর শরীয়াহ অধ্যাপনার প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ। রূমির কাব্যচর্চা শরীয়াহ ও ইসলামি আধ্যাত্মিকতার বিপরীতে নয়, বরং তার পরিপূরক।
যখন তাঁর কবিতার ইসলামী প্রসঙ্গ মুছে ফেলা হয়, তখন একটি নতুন, বিকৃত রূমিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ রূমির প্রকৃত স্বরূপ জানার জন্য তাঁর কোরআন, হাদিস ও ইসলামী পাণ্ডিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ বোঝা প্রয়োজন।
একজন শরীয়াহ অধ্যাপকও বিশ্বের অন্যতম সেরা ভালোবাসার কবিতা লিখতে পারেন— এই সত্য উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন সঠিক ও বিশ্বস্ত অনুবাদ।
জাওয়িদ মোজাদ্দেদেদির মতো গবেষকেরা রূমির প্রকৃত ভাবনার প্রতি সুবিচার করছেন। বিপরীতে, বার্কসের মতো অনুবাদকরা তাঁর কবিতাকে ইসলামবিচ্ছিন্ন ‘আধ্যাত্মিক’ রূপ দিয়ে ভুল বোঝানোর সুযোগ তৈরি করেছেন।
ভবিষ্যৎ করণীয়
রূমির মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে প্রয়োজন—
১. মূল ফার্সি পাঠের প্রতি বিশ্বস্ত অনুবাদ।
২. তাঁর কবিতার ইসলামী প্রসঙ্গ সংরক্ষণ।
৩. ইসলামী ঐতিহ্যের নিরিখে তাঁর দর্শন বোঝার চেষ্টা।
এভাবে একজন প্রকৃত রূমিকে আমরা পেতে পারি— যিনি শুধু প্রেমের কবি নন, বরং ইসলামী জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক।
শেষকথা
রূমিকে ইসলামবিচ্ছিন্নভাবে বোঝার প্রচেষ্টা তাঁর প্রকৃত পরিচয়কে বিকৃত করার শামিল। তাঁর কবিতায় ইসলামী পাণ্ডিত্য, কোরআন ও হাদিসের গভীর প্রভাব রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে রূমিকে শুধুমাত্র একজন ‘আধ্যাত্মিক কবি’ হিসেবে উপস্থাপনের যে প্রয়াস চলছে, তা মূলত এক ধরনের সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ।
রূমির প্রকৃত ভাবনার মূল্যায়ন করতে হলে তাঁকে ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে বোঝা জরুরি। তাঁর কবিতা নিছক আধ্যাত্মিক আবেগ নয়, বরং ইসলামী পাণ্ডিত্যের এক অনন্য প্রতিফলন।
(২০১৭ সালে দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক এবং নিউ আমেরিকা টাইপ মিডিয়া সেন্টারের ফেলো রোজিনা আলি’র সাড়া জাগানো প্রবন্ধ “The Erasure of Islam from the Poetry of Rumi” অবলম্বনে)
লেখক পরিচিতি : রোজিনা আলি একজন সাংবাদিক