অস্তপ্রায় সূর্য। কিছুক্ষণের মাঝে তা হারিয়ে যাবে পশ্চিমাকাশে। সাধ্য অনুসারে ইফতারের আয়োজন সামনে নিয়ে রোযাদার অপেক্ষায় আছে সূর্যাস্তের। হাতে খাবার। পেটে ক্ষুধা। পিপাসাকাতর ক্লান্ত শরীর। তবুও কিছু মুখে দিচ্ছে না। কারণ এখনও আল্লাহ্র হুকুম হয়নি। সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য! আল্লাহ তাআলার নিকট এ দৃশ্যটি অত্যন্ত প্রিয়। বান্দার এ সময়ের এ অবস্থাকে আল্লাহ পাক বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকেন।
ইফতার : রোযাদারের জন্য বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত
ইফতারের সময় বান্দার দেহমনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
لِلصّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ، وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ.
রোযাদারের জন্য দুটি বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত রয়েছে। একটি হল, ইফতারের সময়।অপরটি হল, যখন সে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে (আর তিনি তাকে বিশাল পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন)। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১
ইফতার : যে সময় দুআ কবুল হয়
পুরো রমযানই রহমত-বরকতের মাস। তবে কিছু কিছু মুহূর্তে বান্দার প্রতি তা প্রবল বেগে ধাবিত হয়। ইফতারের সময়টিও এমন। তাই এ সময়ের দুআ আল্লাহ পাক বিশেষভাবে কবুল করেন। নবীজী বলেন
إِنّ لِلصّائِمِ عِنْدَ فِطْرِهِ لَدَعْوَةً مَا تُرَدّ.
ইফতারের সময় রোযাদারের একটি দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ কমপক্ষে একটি দুআ অবশ্যই কবুল হয়। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩
এ হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. ইফতারের সময় এ দুআ করতেন
اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الّتِي وَسِعَتْ كُلّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِي .
আয় আল্লাহ, আমি আপনার সর্বব্যাপী রহমতের ওসিলায় প্রার্থনা করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৫৩
এজন্য ইফতারের একটি আদব হচ্ছে, সময় হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ইফতার প্রস্তুত করে আল্লাহমুখি হওয়া, বেশি বেশি দুআ-দরূদ পড়া, তওবা-ইস্তিগফার করা। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা।
ইফতার : যে সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয়
ইফতারের মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। এ সময়ে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন। নবীজী বলেন
إِنّ لِلهِ عِنْدَ كُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ، وَذَلِكَ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ.
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ইফতারের সময় অনেক জাহান্নামীকে মুক্ত করে থাকেন এবং এটা প্রতি রাতে করেন। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৬৪৩
তাই এ মুহূর্তে নিজের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য, পাশাপাশি সকল মরহুম মুমিন মুসলমানের জন্য মাগফিরাতের দুআয় মশগুল থাকা কাম্য।
সময় হওয়ার সাথে সাথেই ইফতার করি
এতক্ষণ আল্লাহর হুকুম ছিল খাবে না। এখন সূর্য অস্ত গিয়েছে। এখন বিধান হল, ইফতার করা। তাই আর দেরি নয়, সময় হয়েছে জলদি জলদি ইফতার শুরু করে দিন। পূর্বে উল্লেখ হয়েছে দ্রুত ইফতার করা ছিল নবীগণের বৈশিষ্ট্য।সাহাবায়ে কেরামও দ্রæত ইফতার করতেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন
لاَ يَزَالُ النّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجّلُوا الفِطْرَ.
মানুষ ততদিন খায়র ও কল্যাণের মাঝে
থাকবে যতদিন তারা সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রæত ইফতার করবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৫৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৮
অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়
لَا يَزَالُ الدِّينُ ظَاهِرًا مَا عَجّلَ النّاسُ الْفِطْرَ، إِنّ الْيَهُودَ وَالنّصَارَى يُؤَخِّرُونَ.
ততদিন দ্বীন প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতদিন মানুষ দ্রæত ইফতার করবে। কেননা ইহুদী-নাসারারা বিলম্ব করে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৮৯৪৪
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন
إِنّ أَحَبّ عِبَادِي إِلَيّ أَعْجَلُهُمْ فِطْرًا.
সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রæত ইফতারকারী আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। জামে তিরমিযী, হাদীস ৭০০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭২৪১, ৮৩৬০
একবার হযরত মাসরূক রাহ. হযরত আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন দুইজন সাহাবী। উভয়েই কল্যাণের কাজে খুব অগ্রসর। একজন ইফতার ও মাগরিব দ্রæত শুরু করেন। আরেকজন কিছুটা বিলম্ব করেন। আম্মাজান জিজ্ঞাসা করলেন, তবে দ্রুত করেন কে? বললেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.। হযরত আয়েশা রা. বললেন
كَذَلِكَ كَانَ يَصْنَعُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এমনটিই করতেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭০২
তাই সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত ইফতার করে নেই।
নামাযের আগেই ইফতার করি
নামাযের পূর্বেই সংক্ষিপ্তভাবে ইফতার সেরে নেওয়া; ইফতারের জন্য বিশাল আয়োজন লাগবে এমনটি নয়। নবীজীর আমলও এমনই ছিল। হযরত আনাস রা. বলেন
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يُفْطِرُ عَلَى رُطَبَاتٍ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ رُطَبَاتٌ، فَعَلَى تَمَرَاتٍ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ حَسَا حَسَوَاتٍ مِنْ مَاءٍ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাগরিবের নামায পড়ার পূর্বেই তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করে নিতেন। তাজা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর তাও না থাকলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন।সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৭৮৯
খেজুর দিয়ে ইফতার করি
মাত্রই আমরা দেখে আসলাম, নবীজী খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাই খেজুর দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব। খেজুর না পেলে পানি দিয়ে। নবীজী বলেন
إِذَا أَفْطَرَ أَحَدُكُمْ فَلْيُفْطِرْ عَلَى تَمْرٍ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُفْطِرْ عَلَى مَاءٍ فَإِنّهُ طَهُورٌ.
তোমাদের কেউ ইফতার করলে সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে। খেজুর না থাকলে পানি দিয়ে। কেননা তা পবিত্র বস্তু। জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৫
ইফতারের দুআ পড়ি
ইফতারের সময় হাদীস শরীফে এ দুআ পড়ার কথা এসেছে
اللّهُمّ لَكَ صُمْتُ، وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ.
আয় আল্লাহ! আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছি এবং আপনার রিযিক দিয়েই ইফতার করেছি। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৯৭৪৪; কিতাবুয যুহদ, ইবনুল মুবারক, হাদীস ১৪১০, ১৪১১
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআও পড়তেন
ذَهَبَ الظّمَأُ وَابْتَلّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ.
পিপাসা নিবারিত হল, শিরা-উপশিরা সতেজ হল। আর আল্লাহ চাহে তো সওম-এর সওয়াব প্রাপ্তির খাতায় লিপিবদ্ধ হল। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৫৭; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৩৩১৫, ১০০৫৮
রোযাদারকে ইফতার করাই
ইসলামে মেহমানদারি ও আপ্যায়নের ফযীলত অনেক। আর যদি সেই আপ্যায়ন হয় রোযাদারকে ইফতার-আপ্যায়ন তাহলে তো তা আরো বেশি ফযীলতের! রোযাদারকে ইফতার করানো অনেক বড় সওয়াবের আমল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন
مَنْ فَطّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ، غَيْرَ أَنّهُ لاَ يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصّائِمِ شَيْئًا.
কেউ যদি কোনো রোযাদারকে ইফতার করায় তাহলে সে ঐ রোযাদারের সমান সওয়াব লাভ করবে। আর এতে ঐ রোযাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।জামে তিরমিযী, হাদীস ৮০৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৪৬; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৩৩১৬, ৩৩১৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭০৪৪, ১৭০৩৩