Home শিল্প সাহিত্যপ্রবন্ধ । আল্লামা শিবলী নোমানী: আধুনিক ইসলামী শিক্ষার রূপকার

প্রবন্ধ । আল্লামা শিবলী নোমানী: আধুনিক ইসলামী শিক্ষার রূপকার

by MD JUNAYED SHEIKH
আল্লামা শিবলী নোমানী: আধুনিক ইসলামী শিক্ষার রূপকার

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মাদ্রাসা শিক্ষাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে, ৯/১১-পরবর্তী বর্ণনায় মাদ্রাসাগুলোকে ধর্মীয় চরমপন্থার উত্সস্থল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায়, অনেক দক্ষিণ এশীয় সরকার মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করেছে, যাতে এটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে আরও ভালোভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে। যদিও এই বর্ণনাগুলোর অনেক সমস্যা রয়েছে, তবুও এগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে উৎসাহিত করতে পারে। এ বিষয়ে সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে হলে আমাদের অবশ্যই উপনিবেশিক যুগের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।

ঔপনিবেশিক শক্তির উত্থানের ফলে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজে, ধর্মতত্ত্ব, ধর্ম, আধুনিকতা, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংযোগসহ বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন আলোচনা শুরু হয়। উনিশ শতক থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন মুসলিম সমাজের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে—একটি ঐতিহ্যবাদী, অন্যটি আধুনিকতাবাদী।

যদিও উভয় পক্ষের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজের “সংস্কার,” তবে ঐতিহ্যবাদীরা শুধুমাত্র ধর্মের অভ্যন্তরে প্রচলিত সংস্কারের পক্ষে ছিলেন, আর আধুনিকতাবাদীরা বিশ্বপরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে মৌলিক পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। তবে উভয় গোষ্ঠীই প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির ওপর নির্ভর করায়, শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াবলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং এই প্রবণতা আজও বিদ্যমান।

মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের ওপর এ ধরনের চাপ নতুন কিছু নয়। প্রায় এক শতাব্দী আগেও এমন চাপ স্পষ্টভাবে উপস্থিত ছিল, বিশেষ করে শিবলী নোমানীর (১৮৫৭–১৯১৪) সময়ে। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত লেখক, পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, কবি, ভ্রমণকারী ও শিক্ষাবিদ। শিবলী আলীগড়ে মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজে (বর্তমানে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়) ফারসি ও আরবি ভাষা পড়াতেন এবং ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করতেন। মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন।

শিক্ষার পরিবর্তন ও গতিধারার বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা পরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসাগুলোর সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি স্থবির করে দিতে চায়। এর অন্যতম উপায় ছিল শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বিখণ্ডিত করা—একদিকে ধর্মীয় শিক্ষা, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা। অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এই বিভাজন মেনে নিয়ে ধর্মীয় শিক্ষাকে ‘উলূমে দীন’ (ধর্মীয় জ্ঞান) হিসেবে উঁচু স্থান দিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ জ্ঞানকে ‘উলূমে দুনিয়া’ (পার্থিব/জাগতিক জ্ঞান) হিসেবে গুরুত্বহীন করে তুললেন। এই প্রবণতা আজও অব্যাহত রয়েছে।

এই প্রবন্ধে শিবলী নোমানীর চিন্তাধারা, দর্শন ও তাঁর গৃহীত উদ্যোগ বিশ্লেষণ করা হবে, যা মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নে সহায়ক হতে পারে।

শিবলী নোমানী এমন এক সময় বেড়ে উঠেছিলেন, যখন সমগ্র ইসলামী বিশ্ব, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ, তীব্র অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। উসমানীয় খিলাফত ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল এবং শেষ পর্যন্ত বিশ শতকের প্রথমার্ধে পশ্চিমা জোটের হাতে পরাজিত হয়। অন্যদিকে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশদের অভূতপূর্ব শত্রুতা ও প্রতিহিংসার সম্মুখীন হয়। এই সংকটময় সময়ে শিবলী নোমানীর লেখনী ইসলামী বিশ্বের জন্য এক আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেছিল।

তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর সময়ের ঐতিহ্যবাদী উলামায়ে কেরাম ও মুসলিম পণ্ডিতদের গবেষণাপদ্ধতিতে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পাশাপাশি তিনি নিউটনের গতিসূত্র এবং ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো নতুন বৈজ্ঞানিক ও তাত্ত্বিক চ্যালেঞ্জগুলোকেও গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাঁর সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবাহ সম্পর্কে সচেতন হয়ে শিবলী ইসলামী জ্ঞানের পাঠ ও ব্যাখ্যার পদ্ধতিকে উন্নত করার উদ্যোগ নেন, যাতে আধুনিক বিশ্বে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।

তিনি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক বিশ্বের সামাজিক-রাজনৈতিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার মাধ্যমে ইসলামী বিশ্বের মৃতপ্রায় চেতনা ও উদ্দীপনাকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন এক নতুন প্রজন্মের স্কলার তৈরি করা, যারা আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদির সঙ্গে সুপরিচিত থাকবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এভাবেই আধুনিক বিশ্বে ইসলামের প্রসারকে বেগবান করা সম্ভব হবে।

শিবলীর শিক্ষা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়ন। এই প্রবন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করা হবে নদওয়াতুল উলামার (নদওয়া) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে, যা শিবলি ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

অষ্টাদশ ও উনিশ শতক থেকে মাদ্রাসা মুসলিম সমাজের অন্যতম প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর শিক্ষার্থীরা শহর, গ্রাম ও এমনকি পশ্চাৎপদ অঞ্চলেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণেই শিবলী মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি মনে করতেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আধুনিক জ্ঞানের তত্ত্ব ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে কুরআন ও হাদিস অধ্যয়নের পদ্ধতি শেখানো প্রয়োজন।

শিবলী তাঁর জীবনের ১৪ বছর ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে আলেমদের সঙ্গে কাটান এবং পরবর্তী প্রায় ১৬ বছর আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে (এএমইউ) অধ্যাপনা করেন। আলীগড়ে থাকাকালীন তাঁর বিশ্লেষণধর্মী ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা আরও উন্নত হয়। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় বিখ্যাত প্রাচ্যতাত্ত্বিক অধ্যাপক টমাস ওয়াকার আর্নল্ডের সঙ্গে, যিনি ছিলেন কবি, রাজনীতিক এবং আল্লামা ইকবালের শিক্ষক। শিবলী তাঁকে আরবি শেখাতেন, আর বিনিময়ে আর্নল্ড তাঁকে ফরাসি ভাষা শেখাতেন। আর্নল্ডের সংস্পর্শে এসে শিবলি প্রাচ্যতাত্ত্বিক গবেষণার জগতে প্রবেশ করেন এবং উপলব্ধি করেন যে, পাশ্চাত্য গবেষকরা প্রাচ্যের সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চাকে সমৃদ্ধ করতে ব্যাপক কাজ করেছেন, অথচ মুসলিম পণ্ডিতরা তুলনামূলকভাবে অল্পই করেছেন।

ফলে তিনি মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার পুনর্জাগরণ ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক বিদ্যার সমন্বয়ের জন্য একটি কাঠামো গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি জনপ্রিয় সাময়িকী ‘রিসালা আন-নদওয়া’ প্রকাশ শুরু করেন। শিবলী এই পত্রিকার প্রাথমিক সাফল্য সম্পর্কে লিখেছেন:

‘আন-নদওয়া’-এর সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, এটি সম্মানিত ওলামাদের চিন্তাধারায় এক বিপ্লবী পরিবর্তন নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত, যতই অস্বস্তি হোক না কেন, তাদের এই প্রবন্ধগুলো পড়তে বাধ্য হতে হয়। এই সাময়িকী আধুনিক নানা আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে, ইসলামী গবেষণার সর্বশেষ পদ্ধতিগুলো বিশ্লেষণ করে এবং ওলামাদের ভাষাশৈলী ও প্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র্যের সঙ্গে পরিচিত করায়। যারা এটি পছন্দ করত, তারা এর জন্য লেখা শুরু করে, আর যারা বিরোধিতা করত, তারাও এটিকে অনুসরণ করতে থাকে।’

কেবল একটি সাময়িকী প্রকাশ করে ভারতীয় মুসলমানদের নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। কারণ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ঔপনিবেশিক শাসন মুসলমানদের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিল্পে আইনগত সার্বভৌমত্ব হারানোর দিকে ঠেলে দেয়। শিবলীর সময়েও এই রাজনৈতিক শক্তি পুনরুদ্ধার হয়নি এবং উলামায়ে কেরামের রক্ষণশীল শিক্ষাপদ্ধতি পাশ্চাত্য আধুনিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছিল।

এই সংকট মোকাবিলায় সংস্কারবাদী বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে ইসলামী আধুনিকতাবাদী সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বাধীন আলীগড় আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে পাশ্চাত্যের সমাজ, রাজনীতি, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী দারুল উলূম দেওবন্দ আন্দোলন কঠোরভাবে এটির বিরোধিতা করছিল। দেওবন্দপন্থীরা পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।

শিবলী নোমানীর শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের মূল ধারণা ছিল দেওবন্দের মতো একটি মাদ্রাসা ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যবধান দূর করা। কিন্তু ঐতিহ্যবাদী উলামায়ে কেরাম ব্যাপকভাবে তাঁর এই চিন্তাধারার বিরোধিতা করেন। শিবলী নিজেই এই প্রতিকূলতা সম্পর্কে লেখেন:

‘আজ পুরো মুসলিম সমাজ দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছে: ঐতিহ্যবাদী উলামাগণ মনে করেন যে, তারা শুধু আধ্যাত্মিক বিষয়ে নিয়োজিত, ফলে পার্থিব জীবনে তাদের কোনো অর্জন নেই; এ কারণেই তারা কেবল ধর্মীয় বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। অন্যদিকে, আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণি মনে করে যে, তারা যেহেতু আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছে, তাই তারা ধর্মীয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে না। অথচ এই উভয় দলই সেই সিরাতে মুস্তাকিমের অনুসারী নয়, যা ইসলাম সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছে।’

কিছুটা হলেও নদওয়াতুল উলামা—দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম খ্যাতনামা ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রথম মাদ্রাসা, যেখানে ঐতিহ্যগত ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতি ও শিক্ষাক্রম পড়ানো হতো—শিবলীর স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে। এটি মুসলমানদের ঐতিহ্যবাদ ও আধুনিকতার মধ্যবর্তী শূন্যস্থান পূরণ করতে সক্ষম হয়। নদওয়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে শিবলী এর শিক্ষা মডেল ও পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করেন।

তিনি লেখেন, “দারুল উলূমের মূল লক্ষ্য হলো এমন ধর্মীয় আলেম বা উলামা তৈরি করা, যারা আরবি ভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মূলনীতি সংরক্ষণে সক্ষম এবং পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে উৎসাহিত করতে পারবে।”

এরপর শিবলী ইরানের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীর একটি কবিতা উদ্ধৃত করেন—

در كفى جام شریعت در كفى سندان عشق

ہر حواس نكی نداند جام و سندان باختن

এক হাতে শরীয়তের পাত্র, অন্য হাতে ভালোবাসার নেহাই,

সবার পক্ষে সম্ভব নয় এই দুটিকে একসঙ্গে ধারণ করা।

নদওয়া দক্ষিণ এশিয়ার প্রচলিত ইসলামি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম পুনর্গঠনের চেষ্টা করে। পুরনো পাঠ্যক্রম যুক্তি ও তত্ত্ব অধ্যয়নে শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট দক্ষ করে তুলত, কিন্তু কুরআনের তাফসির ও হাদিসশাস্ত্রের সমালোচনামূলক পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এটি তেমন কার্যকর ছিল না। তাই নদওয়া প্রচলিত যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের পরিবর্তে কুরআন-হাদিসের মৌলিক গ্রন্থগুলো বিশ্লেষণ ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়।

সাধারণত, মাদ্রাসাগুলোতে আরবি সাহিত্য শেখানো হতো কেবল বড় বড় আরবি গ্রন্থ বুঝার জন্য। কিন্তু নদওয়া এই প্রচলিত পদ্ধতিকে বদলে দেয় এবং আরবি এমনভাবে পড়ানো শুরু করে, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু গ্রন্থ অধ্যয়নেই সীমাবদ্ধ না থেকে, বরং আরববিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

নদওয়াতুল উলামা শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের উন্নতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল, যাতে তারা এক বহুমাত্রিক সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীর সমাজে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে পারে। ১৯০৫ সালে শিবলী নোমানী নদওয়াতুল উলামার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি হিসেবে যোগ দেন। সে সময় তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাগুলোর ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। বলা যায়, তিনি সেই গৌরবময় ঐতিহ্যের শেষ দীপ্তি ছিলেন।

শিবলী সমসাময়িক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তাদের পাঠ্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজসহ বিভিন্ন পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত দারুল উলুম অনুষদ ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অধ্যয়ন করেন এবং সেগুলোর তুলনা করেন মাদরাসার পাঠ্যক্রমের সঙ্গে। এরপর তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার জন্য একটি উন্নত পাঠ্যক্রমের প্রস্তাব দেন, যাতে আধুনিক ভাষা শিক্ষার সুযোগ থাকে, বিশেষ করে ইংরেজি ও হিন্দি। একই সঙ্গে তিনি উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি যে ভীতি ছিল, তা দূর করার চেষ্টা করেন।

শিবলী নোমানী তাঁর আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টার কারণে মুসলিম সমাজের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। তিনি একটি নতুন, আলোকিত ও সভ্য সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশের বহুমাত্রিক ও বহুজাতিক পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, সনাতনী ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এটি সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রচলিত ইসলামী শিক্ষার সংস্কার করতে এবং একটি সুসংগঠিত বহুমাত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান অংশগ্রহণ থাকবে।

অবশেষে তিনি নারীদের ঘরের বাইরে এসে পুরুষদের মতোই শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বলেছিলেন:

“নারীরা যেন পুরুষদের সমান শিক্ষা লাভ করে। আমি লিঙ্গভিত্তিক পাঠ্যক্রম বিভক্ত করার ধারণার সঙ্গে একমত নই। আমার মতে, নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য একই পাঠ্যসূচি থাকা উচিত। আমি দৃঢ়ভাবে নারীদের অধিকারের পক্ষে। আজ নারীদের শুধুমাত্র গৃহপরিচারিকার কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। তবে, একইসঙ্গে আমি পর্দা ব্যবস্থারও দৃঢ় সমর্থক।”

শিবলী নোমানী একাধারে শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, জীবনীকার, আইনজীবী, পণ্ডিত, দার্শনিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তবে তাঁর প্রধান প্রকাশভঙ্গি ছিল কবিতা। তাঁর কবিতায় মুসলিম বিশ্বের গৌরবময় ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে, একইসঙ্গে এতে মুসলমানদের অপমানজনক পরিস্থিতির জন্য হাহাকার এবং সমকালীন মুসলিম সমাজের কঠিন পরিণতি নিয়ে চিন্তাভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। সমাজ-রাজনীতি ও শিক্ষার আধুনিকীকরণ নিয়ে জনসচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে তিনি আলতাফ হুসাইন হালি ও আল্লামা ইকবালের সমকক্ষ ছিলেন।

তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা, পশ্চাদপদতা এবং পুরনো আরবি শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন এবং কারিগরি শিক্ষাকে শিক্ষাব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁর “সুবহে উম্মিদ”, যা মসনবির শৈলীতে রচিত, এই বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করে।

“গাফেলতির কারণে আমরা ডুবে গিয়েছিলাম,

অনুকরণ আমাদের মুছে দিয়েছিল।

আমরা কেবল সম্পদই হারাইনি,

আমরা জ্ঞান ও দক্ষতাও হারিয়ে ফেলেছি।”

এরপর তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্ভাবনার উৎস হিসেবে দেখিয়ে বলেন—

“অবশেষে বিষয়টি স্থির হলো আধুনিক বিজ্ঞানের শিক্ষায়।

আমাদের শেখা দরকার সেই নতুন ধারণাগুলো, যা আজ ইউরোপে শিক্ষাদান করা হচ্ছে।

আমাদের কেপলারের সৃজনশীলতা ও নিউটনের প্রশ্নগুলোর নির্ভুলতা অনুধাবন করা প্রয়োজন।”

শিবলী তাঁর ফারসি কবিতায়ও একই মত প্রকাশ করেছিলেন—

“আমাদের উচিত আধুনিক জ্ঞানকে ধর্ম ও প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া।

হে প্রভু, মানুষ যেন গণিত ও প্রকৃতির জ্ঞান অর্জন করতে পারে।”

দুর্ভাগ্যবশত, সমকালীন উলামায়ে কেরাম তাঁর সংস্কারমূলক উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। যারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন, তারা স্থিতাবস্থার কোনো পরিবর্তন সহ্য করতে পারেননি। তারা সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতেও প্রস্তুত ছিলেন না, মুসলিম সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়েও তেমন চিন্তিত ছিলেন না। এমনকি তারা শিবলীকে বাধ্য করেছিলেন নদওয়াতুল উলামার প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে।

তবে যারা মুসলিম সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন, তাঁরা শিবলীর সহযোগী হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। ১৯০৫ সালে মুম্বাইতে তিনি শিবলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শিবলী তাঁকে নদওয়াতে নিয়ে যান, যেখানে আজাদ শিবলীর সঙ্গে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক আলোচনা করেন। সেখানে তিনি কুরআনের তাফসিরবিশারদ মাওলানা হামিদউদ্দিন ফারাহি-র সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।

মাওলানা সাইয়িদ সুলাইমান নদভী মনে করেন, শিবলীর সঙ্গে এই সাক্ষাৎ মাওলানা আজাদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং তাকে “আল-হিলাল” পত্রিকা প্রকাশের দিকে নিয়ে যায়।

১৯১৩ সালে শিবলী নোমানী নদওয়াতুল উলামা থেকে পদত্যাগ করেন এবং এরপর মুম্বাই, হায়দরাবাদ ও আজমগড় সফর করেন। আজমগড়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের শেষ অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন—একটি গ্রন্থাগার, যা দারুল মুসান্নিফিন (লেখকদের কেন্দ্র) নামে পরিচিত।

তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯১০ সালের মার্চে দিল্লি অধিবেশনের জন্য প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনে। সেখানে তিনি লেখেন—

“যেমন কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় একটি সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনি একটি বৃহৎ গ্রন্থাগারও একটি জাতির জন্য অপরিহার্য। যদি আমরা মুসলমানদের ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, তাহলে এমন একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার নির্মাণ করা উচিত, যেখানে ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক—উভয় ধারার বই বিপুল পরিমাণে সংরক্ষিত থাকবে। এই গ্রন্থাগার গোটা মুসলিম সমাজের নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত, যাতে উপমহাদেশের সব লেখক, গবেষক ও চিন্তাবিদ মুক্তভাবে এটি ব্যবহার করতে পারেন।”

জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্যেও শিবলী তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হন। তিনি এমন সংস্কার শুরু করেছিলেন, যা ইসলামী সমাজকে তার সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করেছিল।

তিনি প্রচলিত ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করলেও পাশ্চাত্য সভ্যতার আকস্মিক প্রভাব থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি কিছু ঐতিহ্যগত বিষয়, যেমন মুসলিম নারীদের পর্দাকে শক্তভাবে সমর্থন করেছিলেন। তিনি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে একটি মধ্যপন্থা খুঁজতে চেয়েছিলেন।

একদিকে প্রচলিত ধর্মীয় কাঠামো মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারেনি, অন্যদিকে সমকালীন মুসলিম আধুনিকতাবাদীরা আধুনিকতার প্রকৃত রূপ বুঝতে বা মুসলিম সমাজের জন্য কার্যকর অবদান রাখতে পারেননি।

এই প্রেক্ষাপটে, শিবলী এমন একদল বক্তা ও ধর্মপ্রচারক নির্বাচন করেছিলেন, যারা উপমহাদেশের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রাখতে পারতেন। তিনি নদওয়া ও দারুল মুসান্নিফিনে তাদের আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞানে দক্ষ করে তুলেছিলেন, যাতে তারা একটি উন্নত প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারে।

শিবলী নোমানীর মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা ধর্মীয় সমাজে সামাজিক ও শিক্ষাগত সংস্কারের একটি দীর্ঘস্থায়ী ভিত্তি তৈরি করেছিল, যার প্রভাব আজও অনুভূত হয়। এক শতাব্দী আগে তিনি যে বীজ রোপণ করেছিলেন, তা এখনো ফলপ্রসূ।

ড. সৈয়দ হাসান সরদার জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (নয়াদিল্লি) পারস্য ও মধ্য এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্র থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র মধ্যযুগীয় ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস, বিশেষত মুসলিম সমাজে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি। তার গবেষণার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে—

কুরআনের তাফসির, মধ্যযুগীয় ইসলামী জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর আরবি ও ফারসি ভাষার প্রভাব ইত্যাদি।  তিনি ইসলামী জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভারতে ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের বিকাশে ফারসি ভাষার ভূমিকা এবং ভারতে মুসলিম চিন্তাধারার প্রসারে শিয়া উলামাদের অবদান বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধ ও পর্যালোচনা প্রকাশ

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment