সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করা ১৯ বছরের আবিদ। সালটা ২০২১। সেবার রমজানে তারাবি পড়ানোর সুযোগ এসেছিল এক দূর-দুর্গম গ্রামে। নিজের এলাকা কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থেকে পাড়ি জমাতে হয়েছিল সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার এক হাওর-বেষ্টিত, নদী-ঘেঁষা গ্রামে। সেখানকার পরিবেশ, মানুষের চালচলন, কথাবার্তা, এমনকি খাবারের ধরন—সবকিছুই ছিল তার জন্য নতুন, যেন এক ভিন্ন জগত!
সাধারণত রমজানে ইফতার মানেই বাহারি সব খাবারের সমারোহ। কিন্তু সেখানে ইফতার বলতে বোঝাতো খিচুড়ি, ছোলা-বুট আর মিষ্টান্ন। প্রথমদিন ইফতারের প্লেটে খিচুড়ি দেখে আবিদ একটু হতাশই হয়েছিল। তার তো অভ্যাস ছিল ছোলা-মুড়ি, বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি আর শরবত দিয়ে ইফতার করার। কিন্তু এখানে সেসবের কিছুই নেই! সারাদিন রোজা রেখে নিজের পছন্দের খাবার না পেয়ে প্রথম দু’দিন একটু কষ্টই লাগছিল, তবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেল। একথা মনে পড়ে, যতই আগাই, ততই পথ আরো দীর্ঘ হয়—আলাদাভাবে মানিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
তবে ইফতারের তুলনায় আরও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সাহরি! গ্রামের মানুষজন খাবারে প্রচুর ঝোল আর টমেটো ব্যবহার করত, যা আবিদের একেবারেই পছন্দের ছিল না। সবকিছুতেই এত বেশি ঝোল যে, মাছ-মাংস, তরকারি—সবকিছুই যেন ডালের মতো হয়ে যেত! ঝালও ছিল প্রচণ্ড! তবে সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল সাহরির দুধ।
প্রথম দিন গ্রামবাসীদের দেওয়া দুধ দেখে আবিদ বেশ খুশি হয়েছিল, মনে মনে ভেবেছিল, গরু গরু গো, গরম গরুর দুধ দিয়ে সাহরি জমবে ভালোই। কিন্তু এক চুমুক দিতেই বোঝা গেল, এটা আসলে প্যাকেটের দুধ, তাও আবার এত বেশি পানিতে মিশ্রিত যে, স্রেফ সাদা পানির মতো! আবিদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল, তবে ভাগ্যক্রমে সঙ্গে কলা ছিল—তবুও মনে মনে ধৈর্য ধরো, ফল পাবে বলেই ত্যাগের পথ বেছে নিল।
এসব নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যেও গ্রামের মানুষদের আন্তরিকতা ছিল অসাধারণ। প্রথম থেকেই সবাই আবিদকে খুব আপন করে নিয়েছিল। মসজিদের মুসল্লিরা, গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা তাকে ঘিরে রাখত।
একদিন ইফতারের সময় গ্রামের একজন জিজ্ঞেস করল, “হুজুর, আপনি মনে হয় আমাদের খাবার ঠিকমতো খেতে পারেন না?” আবিদ লাজুক হেসে বলল, “আসলে আমাদের এলাকায় খাবারের স্বাদ একটু ভিন্ন, তাই মানিয়ে নিতে সময় লাগছে।” তখনই একজন মুরব্বি বললেন, “তাহলে চলেন, আগামীকাল আপনাকে আমরা নিজের হাতে রান্না করা কিছু খাওয়াই!”
পরদিন সত্যিই আবিদের জন্য বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল। এক মুরব্বি তার বাড়ি থেকে বিশেষভাবে রান্না করা মাংস আর রুটি পাঠালেন। সেই খাবার খেয়ে আবিদ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল! তখন সে বুঝতে পারল, মানুষের দানে সুখ কোথায়, তা ভালোবাসার চেয়ে আর কী হতে পারে! খাবারের স্বাদ হয়তো মনের মতো ছিল না, কিন্তু মানুষের ভালোবাসার স্বাদ ছিল অনন্য।
এই পুরো রমজানটা আবিদের জন্য ছিল এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। খাবার আর পরিবেশের পার্থক্য থাকলেও, গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আর আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করেছিল। রমজান শেষে যখন বিদায়ের সময় এলো, তখন আবিদের মন সত্যিই ভারী হয়ে উঠল। মানুষ তাকে এতটাই আপন করে নিয়েছিল যে, ফিরে আসতে ইচ্ছা করছিল না।
আজও সেই হাওরের রমজান আর ইফতার স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করে। খাবারের স্বাদ হয়তো মনের মতো ছিল না, কিন্তু মানুষের ভালোবাসার স্বাদ ছিল অনন্য! যতই দূরে থাক, ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না!