আবু নুয়াস।
যার নাম শুনলেই মনে ভেসে ওঠে আনন্দ, হাস্যরস আর বিলাসিতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। বাগদাদের রাজদরবার থেকে সরাইখানা—সবখানেই যার জয়জয়কার। তাঁর জিহ্বা থেকে ঝরে পড়ত হাসির ছটা, রসালো কৌতুক আর মদ্যপানের গান।
তৎকালীন খলিফারা তাঁকে ভালোবাসতেন, তাঁর কবিতা শুনে হাসতেন, পুরস্কার দিতেন। কিন্তু এই মানুষটিই একসময় বদলে গেলেন। কিন্তু কেন? কী এমন ঘটেছিল?
ভোগবিলাসের জীবন
আবু নুয়াসের জীবন ছিল ভোগবিলাসের রঙে রাঙানো। তিনি ছিলেন রাজদরবারের অন্যতম প্রিয় কবি, খলিফা হারুন অর রশিদ ও তাঁর পুত্র আল-আমিনের সান্নিধ্যে তিনি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
দিনরাত উৎসব, বিলাসবহুল আসর, সুরা আর সংগীতের মাঝে কেটে যেতো তাঁর সময়।
একদিন রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে তিনি বসরার রাস্তায় হাঁটছিলেন।
পথে এক দরবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দরবেশ তাঁকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখলেন, তারপর বললেন, “কবি, তুমি কি কখনো ভেবেছো, যখন এই জিহ্বা—যে আজ এত সুন্দর শব্দ ঝরায়—একদিন থেমে যাবে?”
আবু নুয়াস হেসে বললেন, “থামবে কেন? আমি তো এখনো তরুণ, এখনো আমার কবিতা রাজদরবারে উচ্চারিত হয়!”
দরবেশ মৃদু হেসে বললেন, “কিন্তু কবি, এই জীবন তো চিরস্থায়ী নয়। তোমার প্রতিভা অপূর্ব, কিন্তু তুমি কি এটাকে কেবল দুনিয়ার আনন্দের জন্যই ব্যয় করবে? মৃত্যুর পর কী হবে, সে চিন্তা কি কখনো করেছ?”
আবু নুয়াস কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন, তারপর আবার হাসলেন। কিন্তু সেই হাসির মাঝে এক ধরনের কৃত্রিমতা ছিল। যেন দরবেশের কথাগুলো তাঁর মনের কোথাও গেঁথে গিয়েছে।
কবরস্থানে বোধোদয়
কিছুদিন পর, এক সন্ধ্যায় তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে বসরার বাইরে ঘুরতে বের হলেন। হঠাৎই তাঁদের পথ পড়ে একটি পুরোনো কবরস্থানের পাশ দিয়ে। সন্ধ্যার শেষ আলোতে কবরগুলোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে।
আবু নুয়াস সেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎই মনে হতে লাগল, এইসব কবরের নিচে শুয়ে থাকা মানুষগুলোও তো একদিন তাঁর মতোই হাসতো, আনন্দ করতো, রাজদরবারে থাকতো! এখন কোথায় তারা? কোথায় তাদের আনন্দ?
তিনি ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে একটি কবরের পাশে বসে পড়লেন। তাঁর হৃদয় কেঁপে উঠল।
মনে হতে লাগল, “একদিন আমিও তো এভাবেই মাটির নিচে হারিয়ে যাবোৃ”
তিনি নিজের হাত মাটির ওপর রাখলেন এবং একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“হে আল্লাহ! আমার জীবন তো পাপের মধ্যেই কেটে গেল আমি কি সত্যিই তোমার কাছে ফিরে আসতে পারবো?”
তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর চোখে পানি। তিনি সেদিনই প্রতিজ্ঞা করলেন, আর ফিরে যাবেন না সেই পুরোনো জীবনে।
আবু নুয়াসের তওবা ও বিখ্যাত কবিতা
এরপর থেকে আবু নুয়াস নিজেকে বদলে ফেললেন। তিনি আর রাজদরবারে যান না, সরাইখানার উৎসবে দেখা যায় না। বরং তিনি একাকী বসে থাকেন, কাগজ-কলম হাতে নেন, আর নতুন নতুন কবিতা লেখেন—কিন্তু এবার আর মদের গান নয়, এবার তাঁর কবিতায় উঠে আসে অনুশোচনা, তওবা আর আল্লাহর করুণা।
তিনি সেই বিখ্যাত কবিতাটি লিখলেন—
يا رب! إن عظمت ذنوبي كثرة
فلقد علمت بأن عفوك أعظم
(হে আল্লাহ! যদি আমার পাপ খুব বেশি হয়,
আমি জানি, তোমার ক্ষমা তার চেয়েও বড়!)
إن كان لا يرجوك إلا محسنٌ
فبمن يلوذ ويستجير المجرم؟
(যদি কেবল নেককাররাই তোমার কাছে আশা করতে পারে,
তাহলে পাপীরা কার কাছে যাবে, কোথায় আশ্রয় নেবে?)
এই কবিতা আজও মানুষের হৃদয়ে বয়ে নিয়ে যায় এক গভীর বার্তা—
আল্লাহর দরজা কখনোই বন্ধ হয় না, যদি বান্দা সত্যিকারের অনুশোচনা নিয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসে।
আবু নুয়াস ফিরে এসেছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল এক দরবেশের মতোই, এই দুনিয়ার মোহ ভুলে, আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা রেখে।
সংগৃহীত