Home ইসলামধারাবাহিক ভ্রমণগদ্য। তাবলীগে চল্লিশদিন

ধারাবাহিক ভ্রমণগদ্য। তাবলীগে চল্লিশদিন

by MD JUNAYED SHEIKH
তাবলীগে চল্লিশদিন

আল্লাহ পাকের ফজল ও করম— আগামীকাল চিল্লার সফরে বের হব। তাবলীগী মেহনতের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্বন্ধ। অধমের জন্মের বহু পূর্ব থেকেই বাবা-মা উভয়ে তাবলীগের সাথে সম্পৃক্ত। মা কুরআনের হাফেজা ও মাদ্রাসা শিক্ষিকা, বাবা মাদ্রাসায় খেদমতরত তাবলীগের পুরাতন সাথী। সেই সূত্রে বহু হক্কানি উলামা হযরতদের সাথে আমাদের পরিবারের সখ্যতা।

আমাদের জন্মই ভবিতব্য ঠিক করে দিয়েছিল— বাবা-মাকে দেখে দেখে শৈশব কৈশোর থেকে এই কাজের প্রতি ভালো লাগা, উদ্বুদ্ধ হওয়া। পড়াশোনা, বিয়েশাদি ইত্যাদি নানা কারণে তাবলীগের দীর্ঘ সফর থেকে বঞ্চিত ছিলাম। তবে সফরের আশাটা জিইয়ে রেখেছিলাম মনের নিভৃতকোনে।

একদিন স্ত্রী মারফত শুনলাম, গোপালগঞ্জের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মুফতি মুহিব্বুল হক সাহেব, স্বজন পরিচয়ে যিনি আমার কাকা, শবে বরাতের দিনদুয়েক পূর্বে বগুড়া জেলায় এক চিল্লার সফরের ইরাদা করেছেন। কথাটা পেড়ে প্রশ্নবোধক চোখে বেচারি তাকিয়ে থাকলেন অধমের মনোভাব বোঝার জন্য। তার ঐকান্তিক ইচ্ছা— মুফতি সাহেবের সান্নিধ্যে থেকে আমি যেন নিজেকে ঋদ্ধ করি— আমলদার হিসেবে গড়ে তুলি নিজ সত্ত্বাকে।

স্ত্রী মুহতারামা হাত নেড়ে নেড়ে বোঝাল— মুফতি সাহেবের সংস্পর্শে তাবলীগে সময় ব্যয় কেন আমার জন্য জরুরি। নিরন্তর অভয় আর উৎসাহ দিয়ে ব্যগ্রভাবে বলে উঠল— ‘আপনি শুধু নিয়ত করে ফেলেন, সংসারের সমস্ত কিছু দেখভাল করার দায়িত্ব আমার।’

আমার নির্লিপ্ততা দেখে এ-ও বলল— ‘ইনশাআল্লাহ, মুফতি সাহেবের সাহচর্যে আপনার সময়টা চমৎকার কাটবে। ’


আমাদের দুই বছরের দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি— পার্থিব জিনিসের প্রতি তার আগ্রহ নিতান্তই কম বরং দৈনন্দিন তার আখেরাতমুখী কথাবার্তা মুখরিত করে রাখে আমার জৌলুশহীন ঘর। সত্য বলতে কী— বিয়ের পর আজব্দি বেগমসাহেবা কর্তৃক তেমন উল্লেখযোগ্য আবদার কর্ণগোচর হয়নি। সুতরাং তার এই নির্দোষ, পবিত্র চাওয়াকে উপেক্ষা করার শক্তি পেলাম না। তাছাড়া জগতের সৌন্দর্য দেখার এক অভাবিত সুযোগ আমার সামনে। সুযোগটা হেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে কি ?


নীরব , আত্মমগ্ন হয়ে, গভীরভাবে নিজের মুখোমুখি হলাম। ভেবেচিন্তে দেখলাম— মুফতি সাহেব হুজুরের সাহচর্যে বহুল আকাক্সিড়্গত বগুড়া সফরের পাশাপাশি স্ত্রীর আব্দার রড়্গাও হবে। সুখী, নির্ঝঞ্ঝাট সংসারের জন্য স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখা একজন স্বামী হিসেবে অবশ্য কর্তব্য পর্যায়ে পড়ে। স্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ লাব্বাইক বলে মুফতি সাহেব হুজুরের সফরসঙ্গী হিসেবে চিল্লার সফরে নাম অন্তর্ভুক্ত করলাম। মোটামুটি এই ছিল বগুড়া সফরের নেপথ্য ঘটনা।

আমাদের পরিবারের প্রত্যেকেই এই পবিত্র মেহনতের জন্য দীর্ঘ সফর করেছেন, জান-মাল ব্যয় করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় অধমও এবার যুক্ত হচ্ছি তাবলীগ সফরে।

প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যবাহী শহর বগুড়াতে বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই সফরের জন্য তর সইছে না। সফরের ব্যাপ্তিকাল চল্লিশদিনের। তাবলীগী পরিভাষায় বলে এক চিল্লা। দূরে কোথাও লম্বা উদ্দেশ্যমূলক সফরের সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন যাবৎ লালন করে আসছিলাম মনের নিভৃতকোনে। সেই আশা আকাঙ্ক্ষা তাবলীগের মাধ্যমে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করছে দেখে ভারি রোমাঞ্চ আর হাজার রকমের আবেগ অনুভূতি কাজ করছে।

সফরের দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয় নি। নির্দিষ্ট করে কোনো দিন-তারিখের কথা উল্লেখ না করলেও ১৫ শাবানের পূর্বে যাওয়া হচ্ছে না এতটুকু জানি। বগুড়া রওনা হওয়ার পূর্বে তবে একথাও স্মরণ রাখতে হচ্ছে, এ সফর কোন আনন্দ ভ্রমণ কিম্বা ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্য নয় বরং নিজের আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি উম্মতকে আল্লাহ মুখী করার ভ্রমণ।

ঘর থেকে বেরোবার প্রাক্কালে শ্রদ্ধেয় আব্বাজান সাবধানবাণী দিলেন, যিনি ৮০’ র দশক থেকে এই পবিত্র মেহনতের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত, বললেন— ‘ হাদীসে পাকে সফরকে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই নবিওয়ালা সফরে পদে পদে, প্রতিটা মুহূর্তে একজন মুবাল্লিগকে বিরাট ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। খাবার, ঘুম, গোসল আর হাজার রকমের কষ্ট নিত্য সঙ্গী হয়ে থাকে।’

এ-ও বললেন— ‘রান্না-বান্না, মসজিদ ঝাঁট দেয়া, কাপড়-চোপড় ধোয়া ইত্যাদি আনুষঙ্গিক কাজকর্ম আঞ্জাম দেয়ার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবা। যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি চাও, যাযাবরের জীবনযাপন অভ্যস্ত হওয়ার কোশেশ করো। ’



বগুড়া সফরে আমাদেরকে রাহনুমায়ি (আমীর) করবেন গোপালগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ভবানিপুর মাদ্রাসার শাইখুল হাদিস, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, মুফতি মুহিব্বুল হক সাহেব। ওয়াজ, দরস, খিতাবাত, মাদরাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠা, সমাজ সেবা সহ তার অজস্র ব্যস্ততা। তা সত্ত্বেও জীবনের বড় একটা অংশ ব্যয় করে চলেছেন তাবলীগী মেহনতের পেছনে। তার এই জার্নি শুরু ১৯৮৬ সাল থেকে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না, দাওয়াতের কাজকে সার্বজনীন করার জন্য তিনি তার গোটা জীবন ওয়াকফ করে দিয়েছেন। এমন এক বিশিষ্ট মানুষের সাহচর্যে দারুন একটি সফর হবে— না বললেও চলছে।

আমাদের ২৩ সদস্য বিশিষ্ট বৃহৎ জামাত। সাথীরা দুই দলে ভাগ হয়ে বগুড়া যাচ্ছি। অধিকাংশ সাথি তিনদিন পূর্বে পৌঁছে গিয়েছেন। পরীক্ষাকেন্দ্রিক ব্যস্ততায় আমরা ছয়জন সাথি প্রথম কাফেলায় শরিক হতে পারিনি। বিলম্বিত যাত্রা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বয়ে এনেছে— পুরো যাত্রাপথ আমরা মুফতি সাহেব হুজুরের সাহচর্য পাচ্ছি। অনেক কিছু শেখা যাবে। আল্লাহ পাক সফরকে সহজ করে দিন।

অভিধানে বিদায় বলে একটা শব্দ আছে। বাড়ি থেকে বেরোবার প্রাক্কালে বিদায় পূর্ব মুহূর্তের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য বাবা-মার সামনে দাঁড়ালাম। একটি আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও তাঁরা উভয়ে নিজেদেরকে সামলে নিলেন বিজ্ঞচিতভাবে। দ্বীনী কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় এমন আচরণের বহিঃপ্রকাশ ছেলে-মেয়েদের সম্মুখে করেননি কোনদিন। চোখের পানি যা ফেলার— শুধু আল্লাহর সামনেই।


আমরা খুব ছোটবেলায় পড়াশোনার জন্য মাকে ছেড়ে ঢাকা এসেছি। গা থেকে কৈশোরের গন্ধ যায়নি। মনোবেদনায় গলা ছেঁড়ে কতদিন কেঁদেছি তার ইয়ত্তা নেই তবুও মার মধ্যে কোন ভাবান্তর হতো না। সন্তানের নিষ্কণ্টক ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে—পড়ালেখা, তালিম-তরবিয়াতকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন। পড়াশোনার ব্যাপারে নো কম্প্রোমাইজ— একফোঁটা প্রশ্রয় দেননি।

আব্বার আচরণও ছিল অভিন্ন। যুবক বয়স থেকেই বড় বড় বুজুর্গদের সোহবতে নিজেকে ধন্য করেছেন। আদর্শ মানুষ তৈরির কায়দাকানুন জানা ছিল। আব্বা কিছুটা রাশভারী মানুষ— কথা নিতান্ত কম বলেন। খুব ভয় পেতাম শৈশব থেকে। শিক্ষকগণের নিকট আমাদেরকে সঁপে দিয়ে সম্মানপ্রদর্শন পূর্বক অকৃত্রিমতার সাথে উচ্চারণ করতেন এ কথা— ‘হুজুর, হাড্ডি আমার, গোশত আপনার’।


আমাদের শিক্ষকদেরকে আব্বা সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতেন— কোনদিন সামান্যতম হেরফের চোখে পড়ে নি। মাদ্রাসার চৌহদ্দিতে প্রবেশ করিয়ে প্রস্থানের সময় বিনীতভাবে পুত্রের তারাক্কি আর উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য দোয়া চাইতেন আমাদের অগোচরে।

এখানেই শেষ নয়— নিজের যৎসামান্য বেতন থেকে সঞ্চিত কিছু টাকা মাঝেমধ্যে হাদিয়া পাঠাতেন আমাদের মাধ্যমে কিংবা তিনি নিজেও দিয়ে আসতেন। শেখ সাদী রহমাতুলস্নাহি আলাইহি বলেন, ‘আমি বুযুর্গানে দিনের মুখে শুনেছি। কেউ যদি তার ছেলে আলেম হোক বলে কামনা করে, তবে তার উচিত আহলে ইলমদের খুব সম্মান করা এবং বেশি বেশি তাদের সেবা যত্নে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। এভাবে করতে থাকলে কোন কারনে তার ছেলে আলেম না হলেও তার নাতি অবশ্যই আলেম হবে।’

আলেমদেরকে সম্মান করা আব্বার তবিয়তের একটি অংশ হয়ে গিয়েছিল।

কেন জানি মনে হয়, বাবা-মার দীর্ঘ ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সম্মানিত উস্তাদগণের নেক দোয়ার বদৌলতে তাঁদের ওরশে জন্ম নেয়া আট সন্তানের মধ্যে সাতজনই কুরআনের হাফেজ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। মা-বাবার ত্যাগময় জীবনের আশ্চর্য কিছু স্মৃতিচারণ সামনে কোথাও করব— আপাতত ক্ষ্যান্তি। এবার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া যাক।


সফরের দোয়াগুলো অর্থাৎ আদইয়ায়ে মাসনুনা পড়তে পড়তে বাড়ি থেকে দুপুর সাড়ে তিনটার দিকে মার্কাজের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সফরে রওনা হওয়ার পূর্বে ব্যাগ বিন্যাস জরূরী। প্রয়োজনীয় সব ব্যবহার্য জিনিসের পাশাপাশি—দরকারি বই, কলম ও নোট খাতা নিয়েছি।


হযরত আশরাফ আলী থানভি রহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখিত আদাবুল মুয়াশারাত কিতাবে— বইপত্র, খাতা কলম সাথে রাখা সফরের সুন্নাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ মুমিনের সফর যেন নিছক ঘুরাঘুরি না হয়ে বরং ইবাদাত ও শিক্ষা অর্জনের মাধ্যম হয়।

আমাদের মহান আকাবিরদের জিন্দেগীতে সময়ের খুব কদর ছিল। বেহুদা, ফজুল বিষয়ে বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেন নি। সময়ের মূল্যায়ন বিষয়ে উলামায়ে কেরাম স্বতন্ত্র কিতাবও লিখেছেন। সিরিয়ার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আবুল ফাতাহ আবু গুদ্দাহ রহিমাহুল্লার ‘কিমাতুয যামান ইন্দাল উলামা’— এ বিষয়ের প্রসিদ্ধ একটা গ্রন্থ।


মানুষের ভাষা, জীবনযাপন, সংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলো খুঁটিয়ে দেখার পর টুকটাক নোট নেয়া অধমের প্রিয় বিষয়। খুব আনন্দ নিয়ে কাজটি করি।
ব্যাগ বিন্যাসের সময় প্রয়োজনীয় আরো দুয়েকটি কিতাব নিতে মনস্থির করেছিলাম— মসজিদ ভিত্তিক ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরির কথা স্মরণ হওয়ায় বিরত থাকলাম।

সফরের দিনগুলোয় আল্লাহ পাক সময়ের মূল্যায়ন করার তাওফিক দিন।


হাদীস শরীফে ভোরবেলার সফরকে উত্তম বলা হয়েছে। মুফতি সাহেব হুজুর ইত্তিবায়ে সুন্নাতের পাবন্দ— সুন্নাতের ব্যাপারে খুব সজাগ। সকাল ভোরে গোপালগঞ্জ থেকে রাজশাহী অভিমুখে একটি লোকাল ট্রেন ছেড়ে যায়। বাসের তুলনায় ট্রেন জার্নি সহজ ও সাশ্রয়। যানজট, ধুলাবালি ইত্যকার নানাবিধ সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ায় রেল সফর সবসময় উপভোগ্য। সিদ্ধান্ত হয়েছে— গোপালগঞ্জ থেকে কুষ্টিয়া হয়ে ভেরামারা পর্যন্ত রেলপথে। ওখান থেকে সড়কপথে বগুড়া।

ট্রেনে ২৫৬ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে জেনে সবাই রোমাঞ্চিত। গোপালগঞ্জ জেলা মার্কাজে মাগরিবের নামাজ আদায় করে মুফতি সাহেব হুজুরের বাসায় গেলাম। রাতটুকু এখানে যাপন করব। ছাদের অর্ধেক জায়গা জুড়ে ছবির মত সুন্দর পাঞ্জেগানা মসজিদ। ওযু-ইস্তেঞ্জার জন্য দারুণ ব্যবস্থা। আল্লাহ তায়ালার ঘর— মসজিদ নির্মাণের ব্যাপারে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। হাদীসে এসেছে— ‘যে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহর তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করবেন।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫০)

যতদূর জানি— উক্ত হাদিস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মুফতি সাহেব হুজুর মসজিদটি নির্মাণ করেছেন।


মহল্লার মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। পর্দা রক্ষার সুবিধার্থে বাহির দিয়ে ইস্পাতের বৃত্তাকার সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে। জীবনে এই প্রথম বৃত্তাকার সিঁড়ি বাওয়ার অভিজ্ঞতা হলো।নাভিশ্বাস উঠার যোগাড়। সিঁড়ি তো নয়, এ যেন আ¯ত্ম একটা গোলক ধাঁধা। তবে অভ্য¯ত্ম হয়ে গেলে সমস্যা নেই। স্ক্রুর প্যাঁচের মতো পাক দেওয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে সতর্কতা অবলম্বন শর্ত। সামান্য অসতর্কতায় পা হড়কে গেলেই বিপদ।


সিঁড়ির বিরক্তিকর বাঁধা কাঁটিয়ে ছাদে উঠতেই মনটা ভালো হয়ে যাবে। চমৎকার ছিমছাম পরিবেশ। টাইলসে মোড়া ঝকঝকে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট আর সারিবাঁধা অজুখানা। ইত্তিবায়ে সুন্নাত আর মেহমানদের আরামকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মুফতি সাহেব হুজুর দুহাত ভরে খরচে কার্পণ্যতা দেখাননি।


আজ শাবান মাসের ১৫ তারিখ। পবিত্র শবে-বরাত। এ উপলক্ষে অন্যদিনের তুলনায় মহল্লার লোকজনের উপস্থিতি একটু বেশিই।


‘শবে বরাত’ ফারসি শব্দ। শব অর্থ রাত আর বরাত অর্থ মুক্তি, ভাগ্য। এ রাতে অগণিত মানুষের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং বহু জাহান্নামিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়— এ রাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য রেখে ‘শবে বরাত’ নামটির প্রসিদ্ধি ঘটেছে আমাদের উপমহাদেশে। আরব দেশগুলোতে এই পবিত্র রজনীকে ‘নিসফু শাবান’ তুরস্কে ‘বিরাত কান্দিলি’ ইরান ও আফগানিস্তানে ‘নিম শাবান’ নামে পরিচিত।


হজরত মুয়ায বিন জাবাল রাযিআলস্নাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘মহান আল্লাহ শাবানের পঞ্চদশ রাতে তাঁর বান্দাদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং মুশরিক ও পরস্পরে বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (আত-তারগিব: ২/২৪১)।


আমাদের বঙ্গ সমাজে শবে-বরাত আর তবারক সমার্থক হয়ে উঠেছে — প্রমাণ পেলাম আলোচনা শেষে। জিলাপি ব্যতীত শবে-বরাত পালন যেন অকল্পনীয়। জিলাপির কবল থেকে এই ছোটখাটো পাঞ্জেগানা মসজিদও রেহাই পাই নি। মহল্লার এক ভদ্রলোক তবারক নিয়ে এসেছেন।


ঘড়িতে রাত দশটা বাজে। আমাদের নৈশভোজের এন্তেজাম মুফতি সাহেব হুজুরের বাসার মেহমানখানায়। এখানে আসার পর থেকে কেমন জানি নিজের ঘরের অনুভূতি পাচ্ছি। টানা লম্বা দস্তরখানা বিছানো। বিরিয়ানি আর সাদা ভাতের পাশাপাশি নানা ধরনের মুখরোচক তরকারি। তৃপ্তি সহকারে খেলাম। মেহমানের আরামের দিকগুলো বিবেচনা করে মোটামুটি সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করা আছে। খাবার গ্রহনের পরে একচোট বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটি বক্স খাট পাতানো। ফুলতোলা বিছানার চাদর বিছানো টানটান করে।


মেহমানের অলস সময়টুকু মূল্যবান করে তোলার জন্য খাট সংলগ্ন বইয়ে ঠাসা আলমারি— বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমঝদার মেহমান চাইলে এখান থেকে আরবি-বাংলা উভয় কিতাবের স্বাদ নিতে পারবেন। মুফতি সাহেব হুজুর লিখিত বইগুলোর পাশাপাশি বিচিত্র বইয়ের সংগ্রহে আলমারিটা ভরপুর। বোঝা যায় হুজুরের বাসায় পড়াশোনার একটা ভালো সংস্কৃতি আছে।

মন্ত্রমুগ্ধের মত কিতাবগুলো একনজর দেখে নিলাম। আর কিছু টানুক বা না টানুক বই অধমকে প্রবলভাবে টানে, আকর্ষণ করে। তাই বইয়ের কথাগুলো আলাদা করে উলেস্নখ করলাম। সবকিছু সুন্দর পরিপাটি যত্ন করে সাজানো। মুফতি সাহেব হুজুরের উন্নত রুচির প্রশংসা করতে হয়।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment