মূল | অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মাদ নাভেদ আখতার
তরজমা | মুহাম্মাদ হাসিবুল হাসান
ভূমিকা
ভারতের বুকে প্রায় এক সহস্রাব্দ বছর ধরে মুসলমানরা সমৃদ্ধ শাসন পরিচালনা করেছিল, যার অবসান ঘটে উনিশ শতকে। রাজসভায় নানা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, শাসকশ্রেণির সাধারণ জনগণের প্রতি উদাসীনতা, প্রশাসনিক কাঠামোর স্থবিরতা, কর ব্যবস্থার জটিলতা এবং মারাঠা, জাট ও শিখ প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বস্ততা লঙ্ঘনের ফলে এই শাসনের ভিত ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতকে গ্রাস করে এবং কিছু সময়ের ব্যবধানে তা সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। এই রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের পর ভারত অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে—ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চূড়ান্ত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, ভারত পরিণত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
এই রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। ব্রিটিশ শাসকেরা প্রশাসনিক ও শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। এই পরিবর্তনের প্রতি ভারতীয় মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল বহুমাত্রিক। স্যার সাইয়িদ আহমদ খান (১৮১৭-১৮৯৮) মুসলিম সমাজের পুনর্গঠনের জন্য ব্রিটিশের আনুগত্য, উদারনৈতিকতা, প্রগতিশীলতা ও যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তাধারাকে সমাধান হিসেবে দেখেছিলেন। এই দর্শনের ভিত্তিতে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিপুল সাহিত্য রচনা করেন।
অন্যদিকে, দেওবন্দ মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আলেমগণ স্যার সাইয়িদের নীতির ঘোর বিরোধিতা করেন এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ে একটি স্বতন্ত্র পথ অবলম্বন করেন। তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের দ্বারা চালু হওয়া আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাই মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট।
রেশমি রুমাল আন্দোলনের ব্যর্থতার পর দেওবন্দের আলেমগণ তাঁদের কৌশল পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯১৯ সালে তাঁরা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আদর্শগত সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে তাঁরা দেওবন্দ মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার আনেন এবং সারা ভারতে একই নীতিতে পরিচালিত মাদ্রাসার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। বর্তমানে দেওবন্দ মাদ্রাসা মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই এর অবস্থান।
ঔপনিবেশিক যুগের পূর্বে ভারতের ধর্মীয় শিক্ষা ও আলেমসমাজ
মধ্যযুগে মুসলিম শাসকগণ সাধারণ জনগণের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। দিল্লির সুলতান, মুঘল সম্রাট এবং তাঁদের উচ্চপদস্থ আমলারা এ ধারাকে অনুসরণ করেন এবং আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিক অনুদান ও জমি দান করেন। তাঁরা শাসকদের দরবারে ধর্মীয় ও বিচারিক বিষয়ে পরামর্শদানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, দিল্লি সুলতান ও মুঘল সম্রাটরা আলেম, সুফি ও কাজিদের বিভিন্ন উপহার ও জায়গির প্রদান করতেন। এ পৃষ্ঠপোষকতার ফলে মাদ্রাসাগুলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠে এবং শাসনব্যবস্থার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলে। তিনি উল্লেখ করেন—
“দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মুঘল আমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল—প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক কেন্দ্রীয়তা; দ্বিতীয়ত, সুফিদের তুলনায় উলামায়ে কেরামের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। ফলে মাদ্রাসাগুলো সম্রাট ও সাধারণ জনগণের কাছে সমানভাবে সম্মান লাভ করে।”
দিল্লি সুলতান ও মুঘল সম্রাটরা ইসলামী শিক্ষার বিস্তারের জন্য মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার মাদ্রাসাগুলোর ধাঁচে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক শ্রেণিকক্ষ বা পরীক্ষানির্ভর কাঠামো ছিল না, তথাপি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আধ্যাত্মিক বন্ধন গড়ে উঠত এবং শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করত।
উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্ণৌর বিখ্যাত ফিরিঙ্গিমহল মাদ্রাসা শিক্ষার উৎকর্ষতার জন্য প্রসিদ্ধ হলেও, এখানেও ঐতিহ্যবাহী পাঠদান পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। দক্ষিণ এশিয়ার বহু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজও সেই পুরনো কাঠামো বহন করে চলছে।
এ গবেষণায় দেওবন্দ আন্দোলনের উত্থান এবং ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটে এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। এটি বিশ্লেষণ করেছে কীভাবে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বদলে দেয় এবং দেওবন্দ মতবাদ কীভাবে মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এছাড়াও এটি দেখিয়েছে যে, কীভাবে দেওবন্দের আলেমগণ রাজনৈতিক পতন, মুসলিম সমাজের দুর্দশা এবং ব্রিটিশ আধুনিকতার প্রতিক্রিয়ায় একটি স্বতন্ত্র দর্শন ও কৌশল অবলম্বন করেন, যা মুসলিম সমাজের অন্যতম বৃহৎ মতবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমন করে। বিশেষত, মুসলমানদের তারা বিদ্রোহের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের ওপর কঠোর প্রতিশোধ নেয়। হাজার হাজার মুসলমান সৈনিককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, অনেকে কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোর ওপর নেমে আসে নিদারুণ দমন-পীড়ন, অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের বিলোপের ফলে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আর কোনো আনুষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি, যার ফলে বিশেষত দিল্লির মাদ্রাসাগুলোর ছাত্ররা ভয়াবহ দুরবস্থার মধ্যে পড়ে।
এই গভীর রাজনৈতিক সংকট ও মুসলমানদের সামাজিক অবক্ষয়ের সময়ে ইসলামী পণ্ডিতগণ উপলব্ধি করেন যে, তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা জরুরি। সেই লক্ষ্যেই ১৮৬৬ সালে ভারতের দেওবন্দ শহরের সাত্তা মসজিদে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। মাওলানা মোল্লা মাহমুদ (মৃত্যু: ১৮৮৬) ছিলেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক এবং তাঁর প্রথম ছাত্র ছিলেন মাহমুদ হাসান। পরবর্তী সময়ে এই মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, যিনি ‘শাইখুল হিন্দ’ নামে পরিচিত, দেওবন্দ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (১৮২৬-১৯০৫), মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব নানুতবী (১৮৩৩-১৮৮৪), মাওলানা শাহ রফিউদ্দীন (১৮৩৬-১৮৯০), হাজী সায়্যিদ মুহাম্মদ আবিদ হুসাইন (১৮৩৪-১৯১২), মাওলানা জুলফিকার আলী (১৮১৯-১৯০৪), মাওলানা ফজলুর রহমান উসমানি (১৮৩১-১৯০৭) এবং মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানুতবী (১৮৩২-১৮৮০)।
মুহাম্মদ মোজ তাঁর গবেষণাগ্রন্থ Deoband Madrasah Movement: Structural Trends and Tendencies-এ দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাতাদের লক্ষ্য ও তাঁদের আন্দোলনের দ্রুত বিকাশ সম্পর্কে বলেন: “প্রতিষ্ঠাতাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে মুসলিম সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা। সুতরাং একটি মাত্র মাদ্রাসা দিয়ে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ছিল না। তাই উত্তর ভারতের আপার দোয়াব অঞ্চলে আরও বেশ কিছু মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। ১৮৮০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫টি মাদ্রাসা দেওবন্দের মূল প্রতিষ্ঠানের ধাঁচে পরিচালিত হচ্ছিল। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে যায়। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাতারা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানে অটল ছিলেন, তবে তাদের গঠিত সংগঠন ছিল অত্যন্ত আধুনিক, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও সুসংগঠিত।”
দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই বিদ্যাপীঠের প্রবক্তারা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার পুনরুজ্জীবন ঘটানোর প্রয়াস নেন এবং এটি পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে।
বারবারা মেটকাফ তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ “The Madrasa at Deoband: A Model for Religious Education in Modern India”-এ ব্যাখ্যা করেছেন যে, দেওবন্দ মাদ্রাসার সংগঠন ও কাঠামো ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল এবং এটি মূলত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশাসনিক মডেলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
তিনি উল্লেখ করেছেন যে, দেওবন্দ মাদ্রাসায় শিক্ষকরা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতেন। পৃথক শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার ও ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করা হয়, যা সময়ের সঙ্গে আরও প্রসার লাভ করে। এটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে সুসংগঠিত পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয় এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোর্স সম্পন্ন করার নিয়ম চালু হয়।
মেটকাফের মতে, শিক্ষার্থীদের বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ ছিল ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এটি প্রথাগত ধর্মীয় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এক নতুন মানদণ্ড স্থাপন করে, যা পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়।
দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের জনসাধারণের অনুদানের জন্য প্রচারণা এবং তার প্রভাব
ভারতে ব্রিটিশ সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রক্ষণশীল মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করত। ফলে তারা মাদ্রাসাগুলোর উন্নয়ন বা পুনর্গঠনের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অন্যদিকে, ব্রিটিশ রাজের আনুগত্য অর্জনে ব্যস্ত মুসলিম অভিজাতরা সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক চাহিদার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।
এহেন পরিস্থিতিতে দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম জনসাধারণের সহযোগিতা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যারা ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করছিল। এটি ছিল ভারতীয় ইতিহাসে প্রথম ঘটনা, যেখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ জনসাধারণের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে সাধারণত শাসক বা ভূস্বামীদের অনুদানেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো।
দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম জনসাধারণ থেকে অর্থ সংগ্রহের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি পাশ্চাত্যধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলে। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে দেওবন্দের আলেমগণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং তাঁদের মিশনকে আরও সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন। একই কৌশল অনুসরণ করে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ৯ নভেম্বর ১৮৬৬ সালে সাহারানপুরে মাযাহিরুল উলুম নামে আরেকটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরী (১৮৫২-১৯২৭), মাওলানা মাজহার আলী নানুতবী (১৮২৩-১৮৮৫) ও মাওলানা সা’দাত আলী ফকীহ।
দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য উলামায়ে কেরামের এই গণ-অনুদান সংগ্রহের কৌশল সামাজিকভাবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি একধরনের আত্মীয়তা ও মালিকানার অনুভূতি সৃষ্টি করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের এই প্রয়াসে অংশগ্রহণ করে, যার ফলে তারা তাদের আয়ের একটি অংশ ও সময় দান করতে আগ্রহী হয়, তা যত ছোট বা বড়ই হোক না কেন।
এছাড়া রাজা-জমিদার ও প্রভাবশালী অভিজাতদের অনুদান না নেওয়ার কারণে তাদের হস্তক্ষেপ থেকে মাদ্রাসার একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা সংরক্ষিত থাকে। ফলে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি মাদ্রাসার নীতি ও মানদণ্ড লঙ্ঘন করতে পারেনি। এর ফলে দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হন, যা মাদ্রাসার শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের ধর্মীয় শিক্ষাকে জনপ্রিয় করার কৌশল
ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের জন্য স্থানীয় ভাষাকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা গভীরভাবে সচেতন ছিলেন যে মাতৃভাষা ও স্থানীয় সংস্কৃতি ভারতীয় মুসলমানদের পরিচয় গঠনে এবং সামাজিক মর্যাদার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে, তারা আরবি ও ফারসির পরিবর্তে উর্দুকে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ, এই ভাষা তখন শুধুমাত্র অভিজাত ধর্মীয় ও রাজকীয় প্রশাসনের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে ছিল।
উর্দু ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা এবং বহুল প্রচলিত যোগাযোগের মাধ্যম। উর্দুকে শিক্ষার ভাষা হিসেবে গ্রহণের ফলে সাধারণ জনগণের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা সহজবোধ্য হয়ে ওঠে এবং তারা এতে আগ্রহী হয়।
উর্দু ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্য রচনায় দেওবন্দের প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর (১৮৬৩-১৯৪৩) অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সাধারণ মানুষের দিকনির্দেশনার জন্য উর্দু ভাষায় ধর্মীয় বয়ান রচনা করেন। কুরআনের শুদ্ধ ব্যাখ্যা প্রদান এবং মুসলমানদের ধর্মীয় জ্ঞান সহজবোধ্য করার জন্য তিনি “বায়ানুল কুরআন” নামক তাফসির গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ইসলামী জীবনধারা ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নীতিমালা প্রচারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ “বেহেশতি জেওর” মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয় নিয়ে লেখা, যেখানে ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক আচার-আচরণ ও ধর্মীয় দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে।
এই বই বিশেষ করে নববিবাহিত নারীদের উপহার হিসেবে প্রদান করা হতো, যাতে তারা সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে আদর্শ জীবনযাপনের শিক্ষা নিতে পারেন। এখনো পর্যন্ত এই গ্রন্থ উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গাইড হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ অনেকের পক্ষেই মূল আরবি ধর্মগ্রন্থ বোঝা সম্ভব হয় না। মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর এই সাহিত্যকর্ম দেওবন্দী শিক্ষাপদ্ধতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা ধর্মীয় শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম সংস্কৃতি সংরক্ষণে সাহায্য করে।
দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম উর্দুকে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করায় এটি দিল্লি, হায়দরাবাদ, লক্ষ্ণৌ ও বারানসির মতো উর্দুভাষী অঞ্চলে দেওবন্দী মতবাদ ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ দারুল উলুম দেওবন্দকে তার উচ্চমানের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। ফলে, উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা এখানে ইসলামি ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নের জন্য আসে। কারণ, এখানে আরবির পাশাপাশি উর্দু ভাষাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দারুল উলুম দেওবন্দের উর্দু ভাষা প্রচারে ভূমিকা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি।
দেওবন্দের উর্দু গ্রহণের প্রভাব এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উত্থান
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, মুসলিম অভিজাত শ্রেণি মূলত আরবি ও ফারসি ভাষায় গ্রন্থ রচনা ও শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রেখেছিল। দারুল উলুম দেওবন্দ উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে ভারতীয় মুসলমানদের সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য ইসলামি ধর্মতত্ত্বে পারদর্শিতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে। ফলে, শুধু আরবি ও ফারসিতে দক্ষ ব্যক্তিদের একচেটিয়া প্রভাব দুর্বল হতে শুরু করে এবং সৈয়দ, শেখ ও মধ্যপ্রাচ্য-তুর্কিস্তানের প্রসিদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমদের বিশেষ সামাজিক মর্যাদা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
দেওবন্দের এই নীতি দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত মুসলমানদের শিক্ষাগত ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে সহায়তা করে। সাধারণ মানুষ, যাদের জন্য আরবি ও ফারসি শিক্ষা কঠিন ছিল, তারা উর্দুর মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পেয়ে সমাজে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে থাকে।
দেওবন্দের বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের কৌশল
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের সংস্কারবাদী ব্যাখ্যা প্রচার করা। তারা এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করে, যেমন—
১. একই দর্শন ও শিক্ষানীতি অনুসরণ করে অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা।
২. বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করা।
৩. এমনকি অমুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্যও দ্বার উন্মুক্ত রাখা।
এই কৌশলগুলোর মাধ্যমে দেওবন্দ শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও আধুনিকতার মোকাবিলা
ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা ৯/১১-পরবর্তী বিশ্বপরিস্থিতির আলোকে দেওবন্দ আন্দোলনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম নতুন করে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। বিশেষত, তালেবান দেওবন্দি মতাদর্শের অনুসারী হওয়ায়, গবেষকরা দেওবন্দের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তাদের মনোভাব গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করেন।
ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেওবন্দ আন্দোলনের প্রবক্তাগণ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পরবর্তী ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে যে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া চলছিল, তা মুসলিম সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের জন্য হুমকি বলে মনে করতেন তাঁরা। এর প্রতিক্রিয়ায় দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম ইসলামের প্রথাগত শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তুলতে সচেষ্ট হন।
দেওবন্দের উলামায়ে কেরামের এই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তিনটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে প্রবাহিত হয়েছে—
১. ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ: দেওবন্দের প্রবক্তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন।
২. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘রেশমি রুমাল’ আন্দোলন: তুরস্ক, জার্মানি ও আফগানিস্তানের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপন করে ব্রিটিশ রাজ উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেন।
৩. জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ: মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ গঠন করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক সহযোগিতায় যুক্ত হন।
এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে দেওবন্দ আন্দোলন কেবল একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপরের অংশে এসব ঘটনাবলির বিশদ আলোচনা করা হবে।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে দেওবন্দী আলেমগণের অংশগ্রহণ
দেওবন্দ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসিম নানুতবী (জন্ম: ১৮৩২ – মৃত্যু: ১৮৮০) এবং মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (জন্ম: ১৮২৬ – মৃত্যু: ১৯০৫) ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা—এই বিষয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে বিতর্কের প্রধান কারণ হলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক উৎসের বিপরীতমুখী বর্ণনা।
দেওবন্দের একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও আলেম মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়ব তাঁর “তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ” (১৯৭২) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, কাসিম নানুতবী ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী তাঁদের শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীর (জন্ম: ১৮১৭ – মৃত্যু: ১৮৯৯) নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশ নেন। ১৮৫৭ সালের ব্যর্থতার পর তাঁরা শামলি শহরে ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং বিচারের মাধ্যমে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
মুহাম্মদ তৈয়বের এই বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাগণ উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন এবং ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব তাঁদের আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই বিদ্যমান ছিল।
আরেকজন গবেষক মুহাম্মদ তারিক মুজ তার গবেষণায় উল্লেখ করেন যে, দেওবন্দ আন্দোলন মূলত শাহ ওয়ালীউল্লাহর আদর্শের অনুসারী ছিল, যিনি ভারতকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন।
বিকল্প মতামত ও বিতর্ক
তবে দেওবন্দী চিন্তাধারার কিছু ইতিহাসবিদ এই ধারণার বিরোধিতা করেন যে, কাসিম নানুতবী ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন।
মাওলানা আবদুল হাই আল-হাসানি তাঁর “হুজ্জাতুল ইসলাম শাইখ কাসিম নানুতবী” প্রবন্ধে দাবি করেন যে, কাসিম নানুতবীর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার বিদ্রোহের অভিযোগ আনলেও এটি ভিত্তিহীন ছিল। দারুল উলুম দেওবন্দের ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত এই লেখায় বলা হয়—
“১৮৭৩ হিজরিতে যখন ভারতীয় উপমহাদেশে এক মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে, তখন [ব্রিটিশরা] শাইখ কাসিম নানুতবীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনে। ফলে, তিনি কিছু সময়ের জন্য লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি প্রকাশ্যে আসেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে রক্ষা করেন এবং এই মিথ্যা অভিযোগ থেকে মুক্ত করেন।”
এ বিতর্ক থেকে বোঝা যায় যে, দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ তাদের ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে দেখেছেন, আবার কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তারা সরাসরি বিদ্রোহে অংশ নেননি। ফলে, এ বিষয়ে আরও গভীর গবেষণা প্রয়োজন।
মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীর যুদ্ধ-অংশগ্রহণ বিষয়ে বিতর্ক
অনুরূপভাবে, কিছু গবেষক মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহীর (জন্ম: ১৮২৬ – মৃত্যু: ১৯০৫) বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন যে, তিনি ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
মাওলানা আবদুল হাই আল-হাসানি তাঁর “দ্য এপিটম অব শরিয়াহ অ্যান্ড তরীকাহ: শাইখ রশিদ আহমদ আল-গাঙ্গুহী” শীর্ষক জীবনীগ্রন্থে লিখেছেন—
“রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী গাঙ্গুহ শহরে শিক্ষাদান শুরু করেন। কিন্তু ১২৭৬ হিজরিতে তাঁকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশগ্রহণের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং মুজাফফরনগর কারাগারে ছয় মাস আটক রাখা হয়। পরবর্তীতে তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণিত হলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পাঠদান ও জ্ঞান বিতরণে মনোনিবেশ করেন।”
মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়বের প্রতিক্রিয়া
অন্যদিকে, দেওবন্দের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মাওলানা মুহাম্মদ তৈয়ব এই দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “যারা তাঁদের রাজনৈতিক ও জিহাদ সংক্রান্ত অবদান গোপন করতে চেয়েছেন, তারা হয় অজ্ঞতার কারণে বা কৌশলগত কারণে এটি করেছেন। তবে তাদের কৌশলগত চিন্তাভাবনা অযৌক্তিক এবং তাদের অজ্ঞতা অবাস্তব।”
দেওবন্দী আলেমদের রাজনৈতিক কৌশল
এটি স্পষ্ট যে, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর উলামারা সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, তারা ব্রিটিশ শাসনের প্রতিহিংসা ও দমননীতিকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি, তারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম সমাজকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী না করে তাদের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
সুতরাং, তারা ইসলামী শিক্ষার প্রসারকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করেন এবং উপনিবেশবাদী আধুনিকতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তাদের মতে, ব্রিটিশদের প্রবর্তিত আধুনিকতা ভারতীয় মুসলিম সমাজের চেতনা ও মূল্যবোধের জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল।
রেশমি রুমাল আন্দোলন (১৯১৩-১৯২৩)
দেওবন্দ আন্দোলনের নেতা শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ভারতের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার এক সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাহায্য নিয়ে ব্রিটিশ রাজকে ভারতে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯১৫ সালের ৯ অক্টোবর, তিনি মক্কায় তৎকালীন উসমানী সাম্রাজ্যের শক্তিশালী গভর্নর গালিব পাশার সাথে সাক্ষাৎ করেন। গভর্নর শাইখুল হিন্দকে ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উৎসাহিত করার জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন। গালিব পাশা তাঁর পক্ষ থেকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে, শাইখুল হিন্দ একটি পত্র লেখেন যাতে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার আহ্বান জানানো হয় এবং তিনি আশ্বাস দেন যে, এবার সময় এসেছে অন্যায্য শাসকদের হাত থেকে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার।
মুক্তিযোদ্ধারা এটিকে ভারত থেকে ব্রিটিশ শক্তি উৎখাত করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন। শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে কাবুলে তাঁর প্রতিনিধিরূপে পাঠান এবং নিজে আরব দেশে ফিরে যান।
রেশমি রুমাল আন্দোলন এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
কাবুল থেকে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধি শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসানকে একটি পত্র লিখে জানান যে, কাবুলে তাঁর কর্মকাণ্ড কীভাবে এগোচ্ছে এবং সে সময় ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যেসব নেতা প্রস্তুত ছিলেন তাঁদের নামও উল্লেখ করেন। এ পত্রটি একটি সিল্ক বা রেশমের কাপড়ে লেখা ছিল, যা ব্রিটিশ প্রশাসন খুঁজে পায়নি। ফলে, এই ঘটনার নাম হয় “রেশমি রুমাল ষড়যন্ত্র”।
মাওলানা মাহমুদ হাসানের এই প্রচেষ্টা ভারতের ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, কারণ তুরস্ক এবং জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। এরপর মাওলানা মাহমুদ হাসান এবং মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি গ্রেপ্তার হন এবং মাল্টা দ্বীপে কারাগারে পাঠানো হয়।
মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠা
দেওবন্দী আলেমগণের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি নতুন মাত্রা আসে রেশমি রুমাল আন্দোলন উদ্ঘাটিত হওয়ার এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি খিলাফত পতনের পর। এই মুহূর্তে আলেমগণ সিদ্ধান্ত নেন মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করার, ফলে তারা খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এটি ছিল দেওবন্দ আন্দোলনের রাজনৈতিক সংগ্রামের তৃতীয় ইতিহাসিক পর্ব, যখন তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলা করার জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হতে মনস্থ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন তাদের রাজনীতির মধ্যে একটি মূলগত রূপান্তর এনে দেয় এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে তাদের সমন্বয় এবং সহযোগিতা সৃষ্টি করে।
তাদের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি সুসংহত করার জন্য, কিছু দেওবন্দী আলেম একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন, যার নাম দেওয়া হয় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি (১৮৭৯-১৯৫৭), মুফতি কিফায়াতুল্লাহ দেহলভি (১৮৭৫-১৯৫২), মাওলানা আহমদ আলী লাহোরি (১৮৮৭-১৯৬২), মাওলানা সাইয়িদ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি (১৮৭৫-১৯৩৩), মাওলানা আবদুল হক আকোড়বি (১৯১২-১৯৮৮), মাওলানা আবদুল হালিম সিদ্দিকি এবং মাওলানা আবদুল বারী ফিরঙ্গীমহল্লী (১৮৭৮-১৯২৬) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
দলের লক্ষ্য এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রকৃতি বোঝানো হয় এর মাধ্যমে যে, ১৯১৭ সালে পেশাওয়ারে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে তারা স্বাধীনের দাবি জানিয়েছিল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আগেই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শকে প্রচার করতে শুরু করেছিল। তারা “দ্বিজাতি তত্ত্ব” এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিল। এটি ভারতীয় মুসলমানদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানায় এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট প্রদান করার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের অনুরোধ জানায়।
মুসলিম সমাজের সামাজিক সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা
দেওবন্দী আলেমগণ দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের বা ইউরোপ এবং আমেরিকায় বসবাসরত মুসলমানদের সমাজ-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা সুসংগঠিত করতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে, তারা ব্যক্তি ভিত্তিক ফতোয়া প্রদানের একটি ব্যবস্থা চালু করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সময়, মুফতিগণ কাযি বা বিচারকদের জন্য ফতোয়া প্রদান করতেন, কারণ শাসকরা চাইতেন না যে, সাধারণ মানুষ সরাসরি ধর্মীয় নির্দেশনা গ্রহণ করুক। তবে, বর্তমান সময়ে যে ব্যক্তি ভিত্তিক ফতোয়ার সমস্যা ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, সেটি দেওবন্দী আন্দোলনের একটি অবদান, যা এখন অন্যান্য আলেম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও অনুসরণ করছে। এই ব্যবস্থাটি সাধারণ জনগণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে সংগঠিত হতে প্রেরণা দিয়েছে।
দারুল উলুম দেওবন্দ: ইসলামের এক প্রধান মতবাদের উত্থান ও শান্তির প্রতি অঙ্গীকার
দেওবন্দ আন্দোলন, যা উত্তর ভারতের একটি ছোট্ট শহর দেওবন্দে শুরু হয়েছিল, আজ এতটা বিস্তৃত হয়েছে যে এটি ইসলামের একটি প্রধান মতবাদ হিসেবে পরিচিত। এই আন্দোলনের সফলতার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। দেওবন্দের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বরং সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ১৯২৬ সালে মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস (১৮৮৫-১৯৪৪) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তাবলিগি জামাত এই আন্দোলনের একটি শাখা, যা একটি প্রচারমূলক অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে সংস্কারমূলক এজেন্ডায় কাজ করছে।
গত দুই দশক ধরে, তাবলিগি জামাতের তালিবান এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে কি না, এ বিষয়ে বেশ কিছু তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। গবেষকরা প্রায়শই বর্তমান সময়ে জিহাদী কর্মকাণ্ডকে দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা আলেমগণের ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তবে এটি লক্ষ্যণীয় যে, দারুল উলুম ঔপনিবেশিক যুগে সন্ত্রাসী মতাদর্শ থেকে আলাদা ছিল, যখন দেওবন্দী আলেমগণ মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, দারুল উলুম একটি ফতোয়া জারি করে জানায় যে, “যেকোনো ধরনের অবিচার, সহিংসতা এবং শান্তির ব্যাঘাতকে তারা নিন্দা জানায়।” দারুল উলুম দেওবন্দ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা এমন কোনো গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত নয় যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে অসাংবিধানিক বা সহিংস উপায় ব্যবহার করে এবং তারা সকল সন্ত্রাসী বা সহিংস কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলিকে অস্বীকার করে।
এই সংকটময় সময়ে, আলেমগণ তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন যে, তারা শান্তি, সহনশীলতা এবং ধর্মীয় সঙ্গতি প্রচারে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
উপসংহার
আলোচনার সারসংক্ষেপে বলা যায় যে, দারুল উলুম দেওবন্দ-এর আলেমগণ দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং বর্তমানে এটি বিশ্বের মুসলিমদের জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে, যেখানে তারা ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলি পরিচালনা করতে পারে। দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পুরুষগণ যদিও তাদের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম শুরু করেছিলেন জিহাদী এবং সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, তবুও তারা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আধুনিক কৌশল এবং উপায় গ্রহণ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের মঙ্গলার্থে, তারা চিন্তাভাবনায় পার্থক্য প্রকাশ করে এবং নিজেদের সমাজকে সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
দেওবন্দী চিন্তাধারার আলেমগণ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশের আধুনিকীকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, কিন্তু তারা নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠিত করতে আধুনিক কৌশল গ্রহণ করেন। তারা ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার করার জন্য নানা পদ্ধতি ও কৌশল গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন উপ-সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার ফলে দারুল উলুম দেওবন্দ বিংশ শতাব্দীতে ইসলামের একটি প্রধান মতবাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
লেখক পরিচিতি :
অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ নাভেদ আখতার, সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গাজী বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজি খান, পাকিস্তান।