১৬ শাবান, ১৪৪৩ হিজরি
২০ মার্চ : রবিবার ২০২২
মুফতি সাহেব হুজুর প্রোগ্রাম শেষে গভীর রাতে বাসায় ফিরেছেন। সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আমাদের নিকট ছুটে এসেছেন —সেহরি খাওয়ার জন্য ডাকতে। কুশল বিনিময় করলেন সবার সাথে। সময় কম থাকায় ঝটপট সেহরি খেয়ে নিলাম। বলতে দ্বিধা নেই— সাড়া বছরে আজকেই প্রথম কোন নফল রোজা রাখার তাওফিক হল। অলসতায় কেটেছে সারাটা বছর। আল্লাহ মাফ করুন। শাবান মাসের রোজা অনেক ফযিলতময়। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘আমি রাসুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কখনো রমজান ছাড়া পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি; আর শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে অধিক (নফল) রোজা রাখতেও দেখিনি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
২
ফজর বাদ নির্ধারিত মাসনুন আমল শেষে মুফতি সাহেব হুজুর আমাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানাগি (যাত্রাকালিন নির্দেশনামূলক কথা) বয়ান করলেন। একজন মুবাল্লিগের প্রাত্যহিক জীবনের করণীয়, পালনীয়, পরিত্যাজ্য বিষয়গুলোকে উল্লেখপূর্বক বললেন— ‘তোমাদের প্রত্যেকেই জিম্মাদার, প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নিকট জবাবদিহি করতে হবে।’
এ-ও বললেন— ‘একজন দাঈ শুধুমাত্র নিজেকে নয় বরং পুরো উম্মতকে নিয়ে ফিকির করবে। উম্মত জাহান্নাম থেকে বেঁচে কিভাবে জান্নাতি হয়ে যায় সেই ফিকির জারি রাখা। চলতে-ফিরতে, উঠতে-নামতে ফিকিরের বহিঃপ্রকাশ চাই।বেফিকিরবান দাঈ মৃত লাশ সমতুল্য। ফিকিরবান হওয়ার উত্তম পন্থা হচ্ছে— সর্বাবস্থায় দোয়া-দুরুদ,তাসবি-তাহলিল,জিকির-আজকার,তওবা-এস্তেগফার ও কোরআন শরিফ তেলাওয়াতের মগ্ন থাকা। এ-ও খেয়াল রাখতে হবে— আমার দ্বারা আল্লাহর কোন মাখলুক যেন কষ্ট না পায়। ’
বয়ানের শেষ পর্যায়ে মুফতি সাহেব হুজুর সফরের শরয়ী নিয়ম-কানুনগুলো এক এক করে বিবৃত করে শোনালেন। আমাদের আকাবিরগণ বলেন— আল্লাহর পথের কামিয়াবি জনসংখ্যার আধিক্যের সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং আমলের সাথে। একজন মুবাল্লিগ যত বেশি আমল করবেন—তার কথার মধ্যে আল্লাহ ততবেশি তাছির সৃষ্টি করে দিবেন এবং তার দ্বারা কাজ নিবেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ জাল্লাশানুহু বলেন —‘আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।’ (সূরা আল বাকারা :২৪৯)
প্রচলিত তাবলীগ পৃথিবীব্যাপী সাধারণ মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হওয়ার সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের মধ্যে মাশওয়ারা বা পরামর্শ করা অন্যতম একটি বিষয়। তাবলীগে প্রত্যেকটা কাজ মাশওয়ারার ভিত্তিতে সম্পাদন করা হয়। ছোট-বড় সবার মতামতকে বেশ গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। কাউকে অন্ত্যজ বা অপাংক্তেয় মনে করা হয় না। বয়সের তারতম্য কিম্বা ছুঁৎমার্গের বালাই নেই। পরিচয়, পেশা, শিক্ষা, কাজের ধরন আশরাফ-আতরাফ, শেখ, সৈয়দ, গাজী —সবাই সমান। বিভাজনের লেশমাত্র নেই। মাশওয়ারা ব্যতিত কারো একক সিদ্ধাšত্ম গ্রহণযোগ্য নয়। আমিরের জন্য অবশ্য কিছুটা স্বাধীনতা রাখা হয়েছে।
বগুড়া সফরের যাতায়াত খরচের জন্য মাশওয়ারার (সম্মিলিত সিদ্ধাšত্ম) ভিত্তিতে জনপ্রতি পাঁচশত টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সকল সাথির সম্মতিতে মাওলানা আবু বকর ভাইকে কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত করা হয়েছে। সুস্থ ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে, যা কিছু খরচ — তার হাত দিয়েই হবে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করতে ইত¯ত্মত বোধ করছিলেন। কোষাগার বিষয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় শেষমেশ এ দায়িত্ব তাকে গ্রহণ করতে হলো।
কোষাগার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা যে কাউকে আকৃষ্ট করবে— স্বেচ্ছাচারিতা নেই। অগ্রীম টাকা-পয়সা জমা নেয়া হয়না বরং টাকা-পয়সা যার যার জিম্মাদারিতে থাকে। মাশওয়ারার ভিত্তিতে খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াত সহ আনুষঙ্গিক সমস্ত বিষয়াদির খরচ প্রত্যহ নির্ধারণ হয় এবং সে অনুযায়ী জান-মাল ব্যয় হয়ে থাকে।
মাশওয়ারা শেষে মুফতি সাহেব হুজুরের নির্দেশে সবাই দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিরাপদ সফরের জন্য দোয়া করলাম।
৩
যাত্রার প্রারম্ভে মুফতি সাহেব হুজুর নিরন্তর একটি কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন— পুরো সফরে নামায এবং দোয়ার বেশি বেশি ইহতেমাম করতে হবে। এই দুইটি জিনিস দাওয়াত ও তাবলীগের রুহ বা প্রাণ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন— ‘এক ব্যক্তি নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি ব্যবসার উদ্দেশ্যে বাহরাইন যেতে চাই। নবীজি ইরশাদ করলেন, (সফরের পূর্বে) দুই রাকাত নফল পড়ে নাও।’ (তাবরানি, মাজমাউজ যাওয়ায়েদ)
তাবলীগে ফরজ নামাযের পাশাপাশি তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, আউওয়াবিন ও সালাতুত তাসবিহ ইত্যাদি নামাযের গুরম্নত্ব দেয়া হয় সর্বাধিক।
বাসার নীচে অটোরিকশা দাঁড়ানো। হর্ন বাজিয়ে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। নামায শেষ করে তড়িঘড়ি ব্যাগ বিছানাপত্তর সহকারে নীচে নেমে এলাম। গাড়িতে উঠার আদব এবং সফরের মাসনুন দোয়াগুলো মুফতি সাহেব হুজুর স্মরণ করিয়ে দিলেন। সর্ব হালতে আমাদের কাজ কর্ম যেন নবীর তরিকানুযায়ী হয় সে বিষয়ে মুফতি সাহেব হুজুর একজন আদর্শ অভিভাবকের মত সজাগ দৃষ্টি রাখছেন। বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই। এ নিছক ঘুরাঘুরির সফর নয়— গভীর তাৎপর্যপূর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এ যাত্রা।
৪
আমাদের গন্তব্য— বেদগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন। অধিকাংশ সাথী ভাইদের প্রথম রেল সফর। অটোরিকশা ছেড়ে দেয়া মাত্রই সাথী ভাইয়েরা স্বভাবসুলভ পরস্পর আড্ডায় মেতে উঠতেই মুফতি সাহেব হুজুর সতর্ক করে বললেন— ‘বেটারা, সফরে জিকিরের হালতে থাকতে হয়। সফর মানে —কষ্ট, মৃত্যু। পথের বাঁকে বাকে রয়েছে অনিশ্চয়তা, অজানা বিপদ। এমতাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখা চাই। সফরের মাসনুন দোয়াগুলো পড়তে থাকো। আল্লাহ পাক আমাদের সফরকে সহজ করে দিবেন।’
ভোরের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে ধীরে ধীরে আলোয় ঝলমল হয়ে উঠেছে বেদগ্রাম রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। চমৎকার অনুভূতি। আমাদের জেলায় এতো সুন্দর রেলস্টেশন আছে — আজই চাক্ষুষ দেখলাম। সময়ের তালে তালে লোকের সমাগম বাড়ছে। আন্তঃনগর টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করছি। ট্রেনের জন্য সবার অধীর অপেক্ষা। অলস বসে না থেকে হুজুরের নির্দেশে আমরা এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তালিম শুরু করে দিলাম। প্রত্যেকটা মুহূর্তকে আল্লাহর স্মরণ কাটানোর এক প্রাণান্তকর চেষ্টা মুফতি সাহেবের। হুইসেলের তীব্র,তীক্ষ্ণ আওয়াজ কানে পশতেই অপেক্ষামন যাত্রীরা তটস্থ হয়ে উঠলেন। সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের ৭৮৩/৭৮৪ নাম্বার ট্রেনটা যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল ঘড়িতে তখন সাতটা বাজে। বগি নাম্বার মিলিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
ভোরের রাস্তাঘাটের মতো ট্রেনের ভেতর একদম ফাঁকা, সুনসান। ট্রেনের ভেতর বাহির থেকে স্পষ্ট— থার্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাসের বালাই নাই। সব সমান। পুরনো সংস্করণের বগি। সিটগুলো ধুলোবালিতে একাকার। মেঝেতে যত্রতত্র চিপসের প্যাকেট, কাগজ আর পলিথিন পড়ে আছে। শৌচাগার অপরিষ্কার, দুর্গন্ধময়। দুঃখজনক ব্যাপার হল, আমাদের দেশে সরকারি আসবাবপত্র মানেই অবহেলা। রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। অযত্ন অবহেলায় ব্যবহার উপযোগিতা হারাচ্ছে কতশত সরকারি জিনিসপত্র। এ যেন সেই প্রবাদ বাক্যের বাস্তব চিত্র — ‘সরকার কি মাল দরিয়া মে ঢাল’।
টিস্যু দিয়ে সিট পরিষ্কার করে নির্ধারিত আসনে বসে পড়লাম। মুখোমুখি দুটো আসন। আমি বসেছি মুফতি সাহেব হুজুরের সন্নিকটে। কুষ্টিয়া ভেড়ামারা বাজার স্টেশন ইস্তক আমাদের গন্তব্য। তীব্র,তীক্ষ্ণ ভেঁপু বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। চলন্ত ট্রেনের মৃদু দোলায় দু’চোখের পাতা লেগে আসছে দুয়েকজন সাথীভাইয়ের। আমাদের বঙ্গ দেশে সেহরি খেয়ে লম্বা ঘুম দেয়ার রেওয়াজ আছে। এই ঘুমটুকু রোজার সাথে সমার্থক হয়ে উঠেছে— এ ছাড়া রোজা যেন অপূর্ণ । আজ সেহরির খেয়ে সাথিদের সে সুযোগটা হয়নি। পাওনা ঘুমটুকু কাজা করে নেয়ার আভাস সাথীভাইদের চোখে মুখে।
রেললাইনের দুইপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। যতদূর চোখ যায় গম, ভুট্টা আর তামাকের সারি সারি ক্ষেত। তামাকের আধিক্যতা চোখে পড়ার মতো। সারাবিশ্বে বিতর্কিত শস্য হিসেবে পরিচিত তামাক চাষের জন্য কুষ্টিয়া জেলার খ্যাতি আছে। ইংরেজিতে বলে ‘ট্যোবাকো’। বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, দোক্তা এবং গুল ইত্যাদি তামাক জাতীয় পণ্য এখান থেকেই বেশি সরবরাহ হয়। শত নেতিবাচকতার ভিড়ে এ অঞ্চলের মানুষের বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলার ইতিবাচক খ্যাতি আছে। এদের সাথে মিশেছি— মন মানসিকতা বেশ ভালো।
ট্রেন যাত্রায় বিচিত্র সব দৃশ্যের সমাহার । একেক স্টেশনে একেক কিছিমের মানুষজন উঠছে। ফাঁকা আসনগুলো বুক হয়ে গেছে অনেক আগেই। মানুষের ভারে ট্রেনের আদিমকালের বগিটা একসময় ফুলেফেঁপে উঠল— তিল ধারণের জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। নতুন উঠা যাত্রীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ভেড়ামারা টু গোপালগঞ্জ রুটে— এই একটিই ট্রেন। রোদের সাথে সাথে মানুষের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ভ্যাপসা গরমে যাত্রীদের শরীর নিঃসৃত ঘামের গন্ধ হয়ে উঠছে ঝাঁঝালো ।
এক হকার বেচারা ভীড় ঢেলে উঠেছে— যষ্টিমধু বিক্রি করার জন্য। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থামে মূলত দুয়েক মিনিটের জন্য। যাত্রীরা নামার পরে অপেক্ষমান যাত্রীদের মধ্যে ট্রেনে উঠার তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। গুঁতোগুঁতি করে, পা মাড়িয়ে যে যেভাবে পারে উঠছে। নামার সময়ও ঐ একই অবস্থা। বাঁচা মরার এই তুমুল লড়াইয়ে যাত্রীরা পরাজিত হলেও আজতক একজন হকারকে পরাজিত হতে দেখিনি। বাইম মাছের মতো শরীর গলিয়ে অদ্ভুত কায়দায় কিভাবে যেন ঢুকে পড়ে। তারপর ধীরেসুস্থে খুলে যাওয়া জামার বোতাম, কলার, আর ঘর থেকে পরিপাটি সিঁথি করে নিয়ে আসা এলোমেলো হওয়া চুলগুলো সব ঠিকঠাক করে; একেবারে ফুলবাবুটি সেজে ; গলা খাঁকারি দিয়ে বিক্রি বাট্টা শুরু করে। শুরুতে থাকে সালাম আদাব আর চোর বাটপারদের সম্পর্কে কিঞ্চিৎ সতর্কবাণী। একেকজন হকার যেন স্বভাবজাত অভিনেতা। আহা, সে কী দৃশ্য!
আমাদের বগিতে উঠা যষ্টিমধু হকারের চেহারা নাদুসনুদুস। টেরি কাটা ঘন কালো চুল তেলে পালিশ করা। মুখের হাসিটা মনে হলো জন্মগত— সেই কখন থেকে লেগেই আছে। যষ্টিমধুর গুরুত্ব, মাহাত্ম আর উপকারিতা বোঝানোর জন্য কত কথা, কত ঢঙ। বিচিত্র অ্যাডভাইস। দুয়েকটি হাদিসের বানীও আওড়াল। পাশ থেকে এক সাথি বললেন, ‘জাল হাদীস।’ মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে হকার বলে গেল— ‘আমাদের প্রিয় নবিজি এই যষ্টিমধুর উপকারীতার কথা হাদীসে বলেছেন। গলার জন্য খুবই উপকারী। মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে আপনার গলার আওয়াজ হবে সুমধুর আর সুললিত। এক প্যাকেট, মাত্র দশ টাকা, দশ টাকা।’
বিক্রি বাট্টায় মন্দা তবুও হাসিতে কোন হেরফের নেই। বেচারা হকারের বিচিত্র হাঁক-ডাকের পরেও যখন কেউ আগ্রহ দেখাল না তখন আমিই তার প্রথম সহানুভূতিশীল ক্রেতা হলাম। মুফতি সাহেব হুজুরকে একবার আড় চোখে পরখ করে দশটাকার বিনিময়ে এক প্যাকেট সংগ্রহ করে তাড়াতাড়ি পকেটে পুরলাম। অনেকদিন ধরে যষ্টিমধুর তালাশে ছিলাম। যাক, ভালোই হলো। যষ্টিমধু হল এক প্রকার গাছের ডাল। আয়ুর্বেদীয় ওষুধ তৈরির অন্যতম উপাদান হিসেবে যষ্টিমধুর ব্যবহার হয়।
পরের স্টেশনে মোলাকাত হল কাশির ট্যাবলেটের হকারের সাথে। তার একহারা গড়নের শরীরটা পাটকাঠির মতো শুকনো। রোদে পুড়ে চেহারার জৌলুশ হারিয়েছে বহু আগে। পরনে লুঙ্গি আর তিল পড়া সাদা শার্ট। কাঁধে কালো তালিযুক্ত বড়সড় একটা ঝোলা। বিচিত্র সব পণ্যের ভারে কাঁধের ঝোলাটা ফুলেফেপে উঠেছে। তাবিজ-তাগা, বেলোয়ারি কাচের চুড়ি — আর কত কি! পাবলিক পরিবহনে সম্ভবত কাশির ট্যাবলেটের পসার বেশি।
স্বাভাবিকভাবেই তার বিচিত্র ঝোলায় অগ্রাধিকার পেয়েছে কাশির ট্যাবলেট। হকার লোকটা বেশ কৌশলী আর রসিকও বটে। কৃত্রিমভাবে ‘খুক খুক’ কাশি দিয়ে ট্যাবলেটের প্রচারণা চালাচ্ছিল। এক রসিক ভদ্রলোক বললেন, ‘মিয়া, আগে তোমার কাশি ঠিক করো তারপর আমাদেরটা ঠিক করার চিন্তা করতে আইসো।’ এই সামান্য কথায় ব্যাপক হাস্যরসের যোগান দিল— পুরো বগি জুড়ে। মুফতি সাহেব হুজুরও হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। সমস্ত মানুষের মনোযোগ মুহূর্তে ঝেঁটিয়ে পড়েছে হকারের উপর।
৫
ট্রেনের হকার বাণিজ্যের ভিড়ে রশিদ বই হাতে মাদ্রাসা-মসজিদের কথিত হকারদের অনুপস্থিতি ভালো লাগলো। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি এবং সরলতাকে কাজে লাগিয়ে কোরআন-হাদিসের কথা অবলম্বন করে পাবলিক পরিবহনে চাঁদা কালেকশন— বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এমন ভিক্ষাবৃত্তি যে শুধু সাধারণ মানুষের জন্যই বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে তা নয়— বরং এ ধরনের ঘটনা দ্বীনী মাদারিসের ভাবমূর্তিও নষ্ট হয়। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসে। নিজের লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য যখন কেউ ধর্মের আশ্রয় নেয় সেটা ভীষণ অপরাধ।
মাদরাসা,মসজিদের অর্থ কালেকশনের যে পদ্ধতিটা আমরা বর্তমানে দেখতে পাচ্ছি —আমাদের মহান আকাবিরদের তরীকার বিপরীত। উস্তাদগণের মুখে শুনেছি— দেওবন্দে কালেকশনের জন্য আলাদা মুহাসসিল আছে। জামিয়া ইকরায় দীর্ঘ সময় পড়েছি। উস্তাদগণ কখনো আমাদেরকে রাস্তাঘাটে , বাসা-বাড়িতে কালেকশনে পাঠাননি।
আল্লাহ পাক এই ব্যাধি থেকে দ্বীনী মাদারিসগুলোকে হেফাজত করুন।
কয়েক মিনিট বাদেই ভেড়ামারা স্টেশন। ট্রেন থেকে নামার সময় ঠেলাঠেলির ভয় কেন জানি আঁকড়ে ধরছে। প্রতিটি স্টপে ধীরেসুস্থে গল্প করতে করতে উঠছে-নামছে মানুষ— আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রায় এসব কল্পনা দিবা স্বপ্নের মত। উঠতে-নামতে বিরাট হ্যাপা পোহাতে হয় যাত্রীদের। একপ্রকার ঠেলে ঠুলে নামলাম ট্রেন থেকে।
ঢাকা শহরের মত ভেড়ামারা স্টেশনেও সর্বত্র ধুলাবালি। প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার জো নেই। ফেরিওয়ালা, হকার, তরকারিওয়ালা ইত্যাদি অগুনতি লোকের চলাফেরা চারপাশে। রোদে ভরে গেছে চারদিক। ভীষণ গরম।
৬
ভেড়ামারা থেকে বগুড়া যাওয়ার বাকি পথটুকু আমরা বাসে করে যাব। মুফতি সাহেব হুজুরের একজন স্থানীয় ভক্ত আছেন ভেড়ামারায়— আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। আপাদমস্তক সুন্নাতি লেবাসে মোড়ানো। সদা হাস্যোজ্জ্বল। ভেড়ামারা বাজারে সুগন্ধী জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা করেন। ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে তাবলীগে সময় দিচ্ছেন। ভদ্রলোকের একমাত্র সন্তান হাফেজ সাদ— আমাদের মুফতি সাহেব হুজুরের ছাত্র। তিনি দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। যখন শুনলেন, আমরা রোজা রেখেছি, তখন ইফতারি করার জন্য কিছু ফলমূল কিনে হাদিয়া দিয়েছেন।
বগুড়া পোঁছতে এখনো অর্ধেক রাস্তা বাকি। গরমের তীব্রতায় আমাদের হাঁসফাঁস অবস্থা। গরম আবহাওয়া আর রাস্তার দূরত্ব বিবেচনা করে এসি বাসের টিকেট কাটা হয়েছে। বাস আসতে খানিক সময় বিলম্ব হবে। আমরা পার্শ্ববর্তী এক মসজিদে ওজু, ইস্তেঞ্জার প্রয়োজন সেরে মুফতি সাহেব হুজুরের ইমামতিতে জোহরের দুই রাকাত ক্বসর নামাজ পড়ে নিলাম।
‘ক্বসর’ আরবী শব্দ। অর্থ-সংক্ষিপ্ত করা, কমানো। কোনো মুসলিম ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরত্বে সফর করলে ফরজ নামাজ কসর বা সংক্ষিপ্ত করে পড়তে হয়।পারিভাষিক অর্থে —চার রাকাআত বিশিষ্ট নামাজ দু’রাকাআত করে পড়াকে ক্বসর বলে। সফরে যেহেতু কষ্ট, ক্লান্তি এবং অনেক সময় শত্রুর পক্ষ থেকে বিপদের আশংকা থাকে তাই ইসলামি শরীয়ত মুসাফিরের জন্য ক্বসর নামাজের সুবিধা প্রদান করেছে। ক্বসরের নিয়ম হলো — ফরজ নামাযসমূহ কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা। অর্থাৎ চার রাকাত বিশিষ্ট নামায ক্বসর করে দু’রাকাআত আদায় করতে হবে। সম্ভব হলে সুন্নাত নামাযগুলোও আদায়ের চেষ্টা করা, তবে ছুটে গেলে গুনাহ হবে না।
নামাজে কসর করার অনুমতি বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা বলেন— ‘তোমরা যখন জমিনে সফর করবে, তখন তোমাদের জন্য নামাজের কসর করায় কোনো আপত্তি নেই।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১০১)
নামায শেষে মুফতি সাহেব হুজুর স্থানীয় তাবলীগের সাথিদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বললেন। তাবলীগী কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও খোঁজ নিলেন। গতকাল এই মসজিদে একটি চিল্লার জামাত উঠেছে। স্থানীয়দের সাথে আলাপচারিতার মাঝেই কাউন্টারে কাঙ্ক্ষিত গাড়ি উপস্থিত।
এসির শীতল বাতাসে ঘামে ভেজা শরীরটায় আরাম অনুভূত হচ্ছে। মাঝখানের সারিতে জানালার ধারের আসনটি পেয়েছি। বুড়ো-গুড়ো সবার কাছে এই আসনটি সবসময়ই কাঙ্ক্ষিত— সারা দুনিয়া দেখা যায়। অধমের সফরকে আরেকটু উপভোগ্য আর আনন্দময় করার উদ্দেশ্যেই কি-না জানিনা— মুফতি সাহেব হুজুর আমাকে জানালার পাশে বসালেন। ছোটদের প্রতি মায়া মমতার বারিধারা বর্ষণ তাঁর চিরায়ত অভ্যাস— ছোটবেলা থেকে এমনটাই দেখে আসছি। দু-পাশের দৃশ্য দেখার প্রভূত আনন্দ থেকে কেই-বা বঞ্চিত থাকতে চায়। তাই জানালার পাশে বসার কত প্রতিযোগিতা করেছি আশৈশব। আজকে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। বড়দের পাশে বসার জন্য নিজেকে এখনো উপযুক্ত করে তুলতে পারিনি।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের জানালায় ভারি পর্দা টেনে দেয়া। বাইরের দৃশ্য দেখা বারণ। এসি বাসের এমন নিয়মের সাথে অভ্যস্ত হওয়ায় জানালার ভারি পর্দাটা ঈষৎ ফাকা থাকায় ঢেকে দিচ্ছিলাম, মুফতি সাহেব হুজুর হাতের ইশারায় নিষেধ করলেন। পর্দা সরিয়ে রাখতে বললেন। হুজুরের চেহারায় রহস্য ভাব! বাধ্য ছেলের মত নির্দেশ পালন করলাম। কয়েক মিনিট বাদেই রহস্য ভেদ হল। আমি তখনো জানতাম না— পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে দেশের সর্ববৃহৎ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। সেতু নিকটবর্তী হতে রহস্যটা বুঝা গেল। দেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও এই ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে।
মুফতি সাহেব সামান্য ঝুঁকে হাত ইশারা করে বললেন— ‘বেটা, ওই যে দেখ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।’ প্রতিত্তুরে মুচকি হাসি দিয়ে বললাম— ‘ ব্রিটিশদের তৈরি।’ হুজুর সামান্য হাসলেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এতদিন শুধু ছবিতে দেখেছি—সরাসরি এই প্রথম দর্শন। ইস্পাতে গড়া রেল সেতুটা প্রতিবাদের লাল রং ধারণ করে সটান দাঁড়িয়ে আছে রক্তচোষা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের জুলুমের সাক্ষী হয়ে।
চোখের সামনে ব্রিটিশ দ্রষ্টব্য দেখে মনে পড়লো দেওবন্দের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ শাইখুল ইসলামা হুসাইন আহমাদ মাদানি রহিমাহুল্লাহর লেখা ঐতিহাসিক গ্রন্থ নকশে হায়াতের কথা। আদতে আত্মজীবনী হলেও এই বইয়ের সিংহভাগজুড়েই রয়েছে ভারতের সামগ্রিক ইতিহাস। ব্রিটিশ সম্রাজ্যের শুরু থেকে শেষ অবধি শোষণ এবং শাসনের পূর্ণাঙ্গ দলিল। দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। বইটি ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের লুণ্ঠন এবং হাজারো অপকর্মের প্রামাণ্য দলীল গ্রন্থও বটে ।
শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান সাহেবের অনুবাদে স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির বিষয়ে মুফতি সাহেব হুজুরের সাথে কিঞ্চিৎ আলোচনা হলো। তাঁর চোখ মুখ স্নেহ, ভালোবাসায় ভরা; কিন্ত তার প্রকাশ তেমন নেই। দু-একটি দরকারি কথা ছাড়া মুফতি সাহেব হুজুর খুব একটা কথা বলেন না। তবে অধমের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আচরণই করেছেন।
বাসের জানালার পাশে বসিয়ে মুফতি সাহেব হুজুর যেভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দর্শন করালেন —ভাবতেই ক্ষণে ক্ষণে পুলকিত হচ্ছি। চেষ্টা করছি নিজের আবেগকে যথাসাধ্য শান্ত, নিবিষ্ট রাখার। ছোটবেলার এন্তার স্মৃতি ভিড় করেছে হৃদয় অলিন্দে। স্মৃতির সরণি বেয়ে ফিরে গেলাম শৈশবে, সতেরো বছর আগে। সবেমাত্র ঢাকায় এসেছি। সারাক্ষণ মায়ের জন্য পরান পোড়ে—সবকিছুতেই মায়ের স্নেহশীল মুখটা ভাসে। দেহটা ঢাকায়, কিন্ত হৃদপিন্ড আমার মফঃস্বল জনপদে। সারাক্ষন মন ভার দেখে আব্বা কৌশল গ্রহন করলেন। সময় সুযোগ করে ঢাকা শহরের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্রষ্টব্যগুলো দেখাতে লাগলেন— মুফতি সাহেব হুজুরের মত। আমার বাম হাতটা খুব শক্ত করে ধরা থাকত আব্বার ডান হাতের মুঠোর মধ্যে— যেন শহুরে ভিড় বাট্টায় হারিয়ে না যাই। হাতের ইশারায় আব্বা দেখাতেন — ‘ঐ যে বায়তুল মোকাররম, ঐ যে উঁচু দালানটা দেখা যায়- বাংলাদেশ ব্যাংক।’
শহরের সর্বত্র বড় বড় দালান, দোকানপাট। অনবরত রিকশার টুং-টাং শব্দ। চোখের সামনে যা দেখি তাতেই বিস্মিত হই। বিস্ময় কেবল বাড়ে। সে এক দারুন অব্যক্ত অনুভূতি। বিখ্যাত দ্রষ্টব্যগুলো অবলোকন করে মার প্রসঙ্গ ভুলে থাকতাম কিছুদিনের জন্য। বগুড়ার যাত্রাপথে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের অনুভূতিগুলো মুফতি সাহেবের সৌজন্যে আবার ফিরে এলো। হাদিসের ভাষ্যমতে, চাচা বাপের মতো। নবীজি যথার্থই বলেছেন । মুফতি সাহেব হুজুরের কল্যাণে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আপন পিতার স্পর্শ পাচ্ছি।
৭
বগুড়া শহরের দূরত্ব আর মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার। বাসের এয়ার কন্ডিশনার কাজ করছে না। যাত্রীরা ঘেমে নেয়ে একাকার। জানালা কপাট সব বন্ধ। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বাচ্চারা কাঁদছে। কী এক যন্ত্রনা। দুয়েকজন যাত্রী মরিয়া হয়ে মাথার উপরের এয়ারকন্ডিশনারের নব ঘুরাচ্ছে। গোড়ায় যদি গলদ থাকে— প্লাসটিকের নিরীহ নব ঘুরিয়ে লাভ কী!
যাত্রীদের মুহুর্মুহু প্রতিবাদে হাইওয়ের পাশ ঘেঁষা একটা মোটেলের সামনে গাড়ি থেমেছে। অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, বয়সের ভারে গাড়িটা ক্লান্ত, অবসন্ন। দশ মিনিটের জন্য ছোট্ট একটা যাত্রা বিরতি। যাত্রীদের নাস্তা পানির প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি গাড়ির এসি সারাইয়ের কাজটাও হবে।
দূর পাল্লার যাত্রীদের ভ্রমণ ক্লান্ত দূর করে স্বস্তি দেওয়ার জন্য এই মোটেলগুলো রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। রুটি, ভাত-তরকারি এবং শুকনো খাবার পাওয়া যায়। তবে দাম তুলনামূলক বেশি। গাড়ি পার্কিংয়ের পাশাপাশি এখানে অজু , এস্তেঞ্জার প্রয়োজন সারার জন্য রিফ্রেশ রুমের সুব্যবস্থাও আছে।
দুপুর চারটা বাজে করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত বগুড়া শহরে নামলাম। আমাদের গন্তব্য বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার পূর্বে — সারিয়াকান্দি উপজেলায়। যমুনার পাড় ঘেঁষা ছোট্ট এই উপজেলাটিকে ছোট ছোট চর ও মরিচের আবাদ সমৃদ্ধ করেছে। নদী-বিধৌত যমুনার তীরবর্তী সারিয়াকান্দি গমনের জন্য সরাসরি বাস সার্ভিস নেই, সিএনজি একমাত্র ভরসা। বাস থেকে নেমে দশ পনেরো মিনিট হাঁটলেই করতোয়া নদী। বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা নদীটি আর নদী নেই। দূরে বা কাছ থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, এটি একসময় খরস্রোতা নদী ছিল। দখল, দূষণ আর কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে ময়লা-আবর্জনায় নদী ভরাট হয়ে পানি প্রবাহের ক্ষমতা অনেকাংশেই হ্রাস পেয়েছে। নদীটাকে খাল মনে হচ্ছে। ঘিনঘিনে ময়লা পানি। কয়েকটা বিরাট বপু বিশিষ্ট কালো কুচকুচে শূকর খালের পারে মাথা ডুবিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে মোটেও রুচি হয় না।
নদীর ওপারে গেলেই সিএনজি স্টেশন।
৮
বিকাল ছুঁইছুঁই দুপুর। আছরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে এসেছে। সারিয়াকান্দি পৌঁছে নামাজ পড়ার ইরাদা। দুইটা সিএনজি রিজার্ভ করা হয়েছে। মুফতি সাহেব হুজুরকে বহন করা সিএনজি ছেড়ে দিলেও আমাদের ড্রাইভার পাঁচ হাত দূরের কারেন্টের খাম্বায় হেলান দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাপার কি ? শুনলাম, সামনের সিটে আরেকজন যাত্রী হলে তবেই স্টার্ট দিবেন। এমন অনভিপ্রেত বিব্রতকর অবস্থায় পড়ব— ভাবতেই পারি নি। দীর্ঘ পথ ভ্রমণে শরীর ক্লান্ত। বারংবার অনুরোধ সত্বেও ড্রাইভারের তরফে কোন সহানুভূতি পেলাম না। ড্রাইভার মহোদয় গাড়ির চাবি দ্বারা মনোযোগ সহকারে দাঁত খিলালে ব্যস্ত। ড্রাইভারের যে এক্সপ্রেশন— এই মুহূর্তে তার সাথে কথা বলা মানে বৃথা বাক্যব্যয়। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। রোজা রেখে গরমের দীর্ঘক্ষণ এভাবে বসে থাকাও বিরাট ধৈর্যের ব্যাপার। এক সাথীভাই অসহিষ্ণু হয়ে কারেন্টের খাম্বার কথা উল্লেখ করত রাজনীতি বিষয়ে বিস্ফোরক একটা মšত্মব্য করে বসলেন। ধৈর্য্যচুতি ঘটলে যা হয়। ক্লান্তিকর ভ্রমণে মেজাজ বিগড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রচলিত তাবলীগ রাজনীতি থেকে ‘শত হস্ত দূরে’ থাকার নীতিতে বিশ্বাসী— সবাই মিলে উক্ত সাথিকে নিবৃত্ত করলাম। নেতিবাচকতার কালি যেন গায়ে না লাগে সে জন্য বেশ সতর্ক থাকতে হয়।
আমাদের সম্মানিত মুরুব্বীগণ তাবলীগের নীতি -আদর্শের ব্যাপারে খুবই সজাগ। প্রচলিত তাবলীগ দলমত নির্বিশেষে সকল মুসলমানের প্ল্যাটফর্ম। সুতরাং মুবাল্লিগদের এমন কোন আচরণ— যা তাবলীগের ক্ষতি করে, তা থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।
একবার মেওয়াতের এক এলাকায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু-মুসলিম সংহতি সমাবেশ আহ্বান করা হল । সেখানে গান্ধিজি, সর্দার প্যাটেল, জওহারলাল নেহেরু প্রমুখ নেতৃস্থানীয় লোকজন অংশ নিয়েছিলেন। যেহেতু এটা মেওয়াত সংলগ্ন এলাকা ছিল এবং অধিকাংশ অধিবাসী হযরতজী মাওলানা ইউসুফ সাহেবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল আর তৎকালীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাঁরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল— তাই হযরতজীকে তাতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি অংশ নিলেন না। কেননা এটাকে তিনি স্বীয় মিশন তথা তাবলীগের জন্য ক্ষতিকর মনে করছিলেন। মাওলানা হিফজুর রহমান রহিমাহুল্লাহ এবং মাওলানা আহমদ সাইদ রহিমাহুল্লাহ উভয় বুজুর্গের সঙ্গে হযরতজির হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাঁরা উভয়ে নিজামুদ্দিন মার্কাজে এলেন এবং হযরতজীকে এতে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ করলেন। হযরতজি তাঁদের যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন পূর্বক এতে অংশগ্রহণ নিতে অপারগতা জানিয়ে দিলেন।
ড্রাইভার ভাই ইলেকট্রিক খাম্বার মত অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নট নড়ন-চড়ন। ভাবখানা এমন—‘বাহে, তোমরা যত যাই বলো, একজন যাত্রী আমার লাগবিই।’ সবাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি সমস্যার ত্বরিত সমাধানের। আল্লাহ পাকের ফজল ও করম— খানিকবাদে একজন যাত্রী মিলে গেল, আলহামদুলিলস্নাহ। ড্রাইভারের মুখেও স্বস্তি। এতক্ষণে হাসি ফুটেছে। ড্রাইভার সাহেব দু’মাথা ওয়ালা স্টিয়ারিং শক্ত করে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছেন, মনে হচ্ছে লস টাইমটুকু উসুল করে ছাড়বে। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সাঁইসাঁই করে ছোটার কায়দা নাই। সাইনবোর্ড টানিয়ে রাস্তা সংস্কার চলছে। গাড়ির গতি মন্থর। মাঝেমধ্যে কড়া ব্রেক কষতে হচ্ছে। রাজ্যের ধুলোবালি নাকে মুখে যেয়ে সাথিভাইদের দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়।
৯
সারিয়াকান্দিতে যখন পৌঁছালাম, বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। রাস্তা লাগোয়া কাঙ্ক্ষিত মসজিদের সদর দরজায় সিএনজি থামতেই সাথীরা উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়ে আমাদেরকে বরণ করে নিলেন। প্রত্যেকের শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত, নিস্তরঙ্গ ‘বাঙালী নদী’র স্বচ্ছ পানি দেখে অবগাহনের লোভ জাগছে। অস্তমিত সূর্যের আলো পড়ে নদীর পানি ধারণ করেছে অন্যরূপ। ঘর্মাক্ত শরীরে একটুখানি শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে নদী যেন ডাকছে। শরীরের দুর্গন্ধ তাড়াতে সময় নিয়ে গোসল করতে পারলে ভালো হত। সুতরাং নদী থেকে একটা ডুব দিয়ে আসতে পারলে মন্দ হতো না; কিন্ত সময়ের যে বড্ড অভাব!
অতি দ্রুত প্রাকৃতিক প্রয়োজন এবং অজু সম্পন্ন করে আসরের দুইরাকাত কসর নামাজ পড়লাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ইফতারির আয়োজন সম্পন্ন। এখন শুধু দস্তরখানা বিছিয়ে মাগরিবের আজানের ইন্তেজার।
স্টেইনলেসের বড় প্লেটের চারপাশ ঘিরে আমরা পাঁচজন করে বসেছি। আয়োজন সামান্য হলেও পরস্পরে আনন্দের কমতি নেই। পবিত্র রমজানের আমেজ অনুভূত হচ্ছে। প্লেটে পরিবেশিত হয়েছে চিড়ামুড়ি, খেজুর আর দই। বগুড়া যে দধির জন্য খুব বিখ্যাত — বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম, দস্তরখানে দইয়ের উপস্থিতি দেখে হঠাৎ মনে পড়ল। বগুড়ার দইয়ের নাম ডাক বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। দধি ছাড়াও বগুড়ার আরো অনেক সুস্বাদু খাবার আছে। উল্লেখযোগ্য খাবার হল—ক্ষীর, স্পঞ্জের মিস্টি, মহাস্থানগড়ের চাউলের কটকটি, লাচ্ছা সেমাই, শিক কাবাব, মুরগি ও গরুর চাপ, লাল মরিচ, আঠা আলু, ইত্যাদি। যেহেতু দীর্ঘ সময় বগুড়ায় থাকা হবে—বাকিগুলোর স্বাদও ধীরে ধীরে চাখা হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
১০
জগতের সব কোলাহল বিদায় দিয়ে আস্তে ধীরে রাত নেমে আসছে। নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। সাথীভাইয়েরা বেশিরভাগই একে অপরের পরিচিত। এদিক ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখি— আমি শুধু এক অচেনা আগন্তক। থম ধরা এক নীরবতা অপরিচিতদের চোখেমুখে। নীরবতার নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে পরস্পর পরিচিত পর্ব শুরু হলো। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ এবং নতুন নতুন সব অপরিচিত মুখের ভীড়ে নিজেকে খাপ খাওয়াতে যে কী কষ্ট — কেবল ভুক্তভোগীরা-ই উপলব্ধি করতে পারেন। তাবলীগের পরিবেশটা অবশ্য অন্যরকম। অল্প সময়ের ব্যবধানে সবার সাথে পরিচিত, আপন হয়ে উঠলাম।
সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পরিচিত পর্ব শেষ হলো। পরিবেশ এখন অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্য লাগছে।
আমাদের যাতায়াত খরচের টাকা রাখার জিম্মাদার ছিলেন মাওলানা আবু বকর ভাই। এশার নামাজের পরে তিনি আমাদের প্রত্যেককে পাঁচ টাকা করে ফেরত দিলেন। টাকাটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম— ‘ভাই, এই পাঁচ টাকা কিসের জন্য ?’
প্রতিত্তুরে আবু বকর ভাই বললেন— ‘যাতায়াত ভাড়ার উদ্বৃত্ত টাকা। মুফতি সাহেব হুজুর সবাইকে ফেরত দিতে বলেছেন।’
বিস্মিত হয়ে বললাম— ‘পাঁচ টাকা ফেরত দেয়ার কী প্রয়োজন ছিল ?’
আবু বকর ভাই মুচকি হেসে বললেন— ‘মুফতি সাহেব হুজুরের নির্দেশ। তাছাড়া সামান্য এক পয়সা হলেও সেটা ফেরত দেয়া উচিত। ইসলামের বিধান এমনই।’
আজকাল আমাদের পারস্পরিক লেনদেন-মুআমেলায় আমানতের খেয়ানত এই পরিমাণ বেড়েছে— আলোচনা করতে গেলে দুঃখ হয়। খেয়ানত যেন সমাজের চিরাচরিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেনারেল শিক্ষিত মানুষের কথা বাদ দিলাম— আজকাল মসজিদ মাদ্রাসার দায়িত্বশীলরাও টাকা পয়সার লেনদেনে গড়িমসি করেন। হিসাবের কথা উঠলে— লুকোছাপা করেন, কেউ কেউ অপমান বোধও করেন। সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় এক লহমায়।
দানের টাকা তছরুপ, স্বচ্ছ হিসেব প্রদানে গড়িমসি, লেনদেন মুয়ামেলায় অস্বচ্ছতা ইত্যাদি সমস্যায় আমরা জর্জরিত। সে একই সমাজে বসবাস করা মুফতি সাহেব হুজুর পাঁচ টাকার বেলায়ও পাই টু পাই হিসাব নীতি ধরে রেখেছেন— এটা তাঁর আল্লাহ ভীতির সাক্ষ্য ছাড়া আর কি হতে পারে!
তাঁর সততা, নৈতিকতা আর উচ্চায়ত মূল্যবোধ থেকে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
১১
কেয়ামুল্লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগ্রত হওয়ার মানসে ‘আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ’ নীতিতে মুফতি সাহেব হুজুর অভ্যস্ত — ছাত্র জমানা থেকে। রাতে আগে আগে ঘুমানো আর সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা এটা সুন্নাতও বটে। সুন্নাত পালনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য রাতের খাবার শেষ হতেই মামুরদেরকে (আমিরের অনুসরনকারী) ভ্রমণ ক্লান্তি কাটিয়ে উঠা এবং তাহাজ্জুদ পড়ার সুবিধার্থে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার নির্দেশ দিলেন।
নবীজী এশার পর দ্রুত ঘুমিয়ে যেতেন এবং সাহাবীদেরকেও দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে তাগিদ দিয়েছেন। এশার পর গল্প-গুজবে লিপ্ত হওয়াকে মাকরূহ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ক্রমশ