Home আন্তর্জাতিকট্রাম্পের বিরুদ্ধে কখন মুখ খুলবেন শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীরা

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কখন মুখ খুলবেন শিক্ষাবিদ ও ব্যবসায়ীরা

by MD JUNAYED SHEIKH

যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সম্পদ ও ক্ষমতার ভিত্তি দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন গবেষণা, চিন্তাধারা ও মানবসম্পদ তৈরি করে যা দেশটিকে বিশ্বের সেরা মেধাবীদের ‘তীর্থস্থান’ বানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সম্পদ ও ক্ষমতার ভিত্তি দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন গবেষণা, চিন্তাধারা ও মানবসম্পদ তৈরি করে যা দেশটিকে বিশ্বের সেরা মেধাবীদের ‘তীর্থস্থান’ বানিয়েছে। আর দ্বিতীয়টি বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ইঞ্জিনকে চালিত করেছে। তবে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ দুই স্তম্ভকেই ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

ট্রাম্পের এ আচরণ কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়। তার অর্থনৈতিক নীতির ধারণা সবসময়ই ছিল ‘উদ্ভট’। বরাবরই তিনি অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশ করে আসছেন। তিনি যে অভিজাত এসব প্রতিষ্ঠানকে কথিত ‘উয়োক’ (সামাজিক ন্যায়বিচার, বর্ণবাদ, লিঙ্গবৈষম্য এবং অন্যান্য সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে সচল থাকা) সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর হিসেবে দেখেন সেটাও সর্বজন সুবিদিত। আশ্চর্যের বিষয় হলো করপোরেট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতারা ট্রাম্পের এমন মনোভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না।

গত নভেম্বরে ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়ের পর ব্যবসায়িক মহল কিছুটা সতর্কতা, কিছুটা আশাবাদের মধ্যে ছিল। জো বাইডেনের পর ট্রাম্পের আগমন একটি ইতিবাচক পরিবর্তন বলে মনে হয়েছিল, যিনি বেসরকারি খাতের বিরুদ্ধে কঠোর কথা বলেছিলেন। সংগঠিত শ্রম ও সুশাসনের পক্ষে ছিলেন। বিপরীতে কম কর ও কম নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও তার শুল্কনীতি নিয়ে আগে থেকেই শঙ্কা ছিল, তবুও বেশির ভাগই ধরে নিয়েছিল যে এটি মূলত ‘কথার কথা’ বলেছিলেন ট্রাম্প। তার জয়ের পর স্টক মার্কেট উল্লম্ফনকে অনেকে আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছিলেন। প্রযুক্তি খাতের ধনকুবেররা তার অভিষেক অনুষ্ঠানে অনুদান দিয়েছিলেন এবং আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।

কিন্তু কিছুদিন না যেতেই এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে তাদের সে আশাবাদী হওয়াটা আসলে ছিল বড় ভুল। ট্রাম্পের একের পর এক অদ্ভুত নীতি বাজারকে বিপর্যস্ত করেছে। মার্কিন শেয়ারবাজার নভেম্বরের পর থেকে লাভের চেয়ে বেশি হারিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে ট্রাম্পের কোন পদক্ষেপটি ভুল হয়েছে বা পরিস্থিতি আরো খারাপ করেছে তা বলা মুশকিল। আমেরিকার নিকটতম মিত্রদের (কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপ) ওপর চাপানো উচ্চশুল্ক, নাকি বাণিজ্য নীতির বিষয়ে তার ক্রমাগত হুমকি ও অস্থিরতা, যা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সূচককে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও উঁচু স্তরে নিয়ে গেছে।

পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছে ইলোন মাস্কের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি, যা ফেডারেল সরকারের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। মৌলিক আইনি নীতিগুলো লঙ্ঘন করেছে, লাখেরও বেশি সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে। বিদেশী সাহায্য বন্ধ করার পেছনে কিছু নিষ্ঠুর যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু প্রশাসন যেভাবে স্বাস্থ্য ও জীববিজ্ঞান থেকে শিক্ষা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণার ওপর অযৌক্তিকভাবে আঘাত হেনেছে, তা একেবারেই বোধগম্য নয়।

মার্কিন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বোঝা উচিত যে তারা যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের ভাগ্য বদলিয়েছে সেই সিস্টেমের জন্যও ট্রাম্প মারাত্মক হুমকি, স্পষ্টতই বিপজ্জনক। তার অস্থির বাণিজ্য নীতিগুলো যতটাই ক্ষতিকর হোক না কেন, সেগুলো সেই মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি তার হুমকির তুলনায় তুচ্ছ। একটি সমৃদ্ধ বাজার অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আইনের শাসন, ক্ষমতার বিভাজন, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনে সরকারি বিনিয়োগ, জনপরিকাঠামো এবং একই মতাদর্শের বিদেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।

মাস্ক তার নিজের সাফল্যের জন্য অনেকটাই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ঋণী। সঠিক সময়ে একটি সরকারি ঋণ ছাড়া টেসলা দেউলিয়া হয়ে যেত। এমনকি সরকারি কন্ট্রাক্ট কাজে লাগিয়ে স্পেসএক্স কয়েক বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। তবুও ট্রাম্প এমন একটি এজেন্ডার সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ এসব কর্মসূচিকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন, যা কোনো সুসংগঠিত কৌশল তো দূরের কথা, দেশের সমস্যার কোনো বাস্তব সমাধানও উপস্থাপন করে না।

ট্রাম্পের হুমকি মার্কিন একাডেমিয়ার জন্য আরো স্পষ্ট। তিনি মৌলিক চিকিৎসা গবেষণায় সরকারি সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দিয়েছেন। ইহুদি বিদ্বেষের ঝাণ্ডা তুলে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে অযৌক্তিকভাবে তহবিল বন্ধ করে দিয়েছেন। তার প্রথম লক্ষ্য ছিল কলাম্বিয়া ও জনস হপকিন্স। অন্যান্য (যার মধ্যে আমার নিজের প্রতিষ্ঠান হার্ভার্ডও রয়েছে) প্রতিষ্ঠানও এখন এ সংকটের মুখে রয়েছে।

যখন গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের আক্রমণের মুখে পড়ে, তখন প্রধান ব্যবসায়িক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতাদের এ বিষয়ে কথা বলা বিশেষ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু ব্যবসায়িক নির্বাহীরা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতিদের কেউই এ বিষয়ে কথা বলছেন না। বরং মনে হচ্ছে তারা এমন অবস্থান নিয়েছে যেটাকে হার্ভার্ডের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী রায়ান ডি এনোস ও স্টিভেন লেভিটস্কি ‘নীরব তুষ্টীকরণ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের (তোষণকারীদের) ধারণা গোপনে কাজ করে এবং নিজেদের মনোযোগের বাইরে রেখে তারা খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে পারবেন।

কিন্তু এনোস ও লেভিটস্কি মনে করেন এ কৌশল কার্যকর নয়। ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, ভারতের নরেন্দ্র মোদি এবং তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের মতো কর্তৃত্ববাদী জনপ্রিয়তাবাদীরা সর্বদা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতাকে পদদলিত করে। যেকোনো ধরনের সেন্সরশিপ—সেটা সরকার কর্তৃক আরোপিত হোক বা স্ব-আরোপিত হোক-এর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মূল্য দিতে হয়। এমনকি স্বৈরশাসকরা প্রাথমিকভাবে বাজারবান্ধব হলেও তারা ধীরে ধীরে একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।

এ অন্যান্য স্বৈরশাসক চরিত্রের তুলনায় আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ট্রাম্পের আক্রমণ ও এর গতি, ঔদ্ধত ও নির্লজ্জতা অবাক করার মতো। এখন আর এটি বলার অবকাশ নেই, ‘এটি কেবল ট্রাম্প কথার কথা বলেছেন; তিনি কখনই এ হুমকিগুলো বাস্তবায়ন করবেন না।’ বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে কোনো নাগরিক সমাজের সংগঠন বা জনসাধারণের নেতা এ বিষয়ে সন্দেহ করতে পারেন না।

স্বৈরশাসকরা তখনই সফল হয় যখন তাদের বিরোধীরা বিভক্ত হয় এবং কথা বলতে ভয় পায়। বিষয়টি হলো এ রকম—আমরা যখন আমাদের নিজ নিজ গলা উঁচু করতে অস্বীকার করি তখন সবারই গর্দান যায়। এ কারণেই দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৃহত্তম করপোরেশনগুলো—যাদের সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা এবং হারানোর মতো সবচেয়ে বেশি জিনিস রয়েছে—তাদের এখন কিছু করার বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।

কল্পনা করুন, আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বৃহৎ করপোরেশনগুলোর প্রধান নির্বাহীরা শ্রমিক ইউনিয়ন, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও অন্যান্য নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, একাডেমিক স্বাধীনতা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন। এটা ট্রাম্পের মিত্রদের মনোভাবকে হয়তো পরিবর্তন করবে না, কিন্তু গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সাহস জোগাবে, উদ্বুদ্ধ করবে। তাদের সংগঠিত করতে সহায়ক হবে। লাখ লাখ আমেরিকান জানতে চায়, কখন কেউ সাহস করে এগিয়ে আসবে, মুখ খুলবে? অন্ততপক্ষে যারা কথা বলবে তারা ইতিহাসের বিচারে সঠিক পথেই থাকবেন।

ড্যানি রডরিক: হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং ‘স্ট্রেইট টক অন ট্রেড: আইডিয়াস ফর আ সান ওয়ার্ল্ড ইকোনমি’ গ্রন্থের লেখক

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment