Home মুক্ত গদ্যশ্রদ্ধাঞ্জলি । মাওলানা আব্দুল হালিমঃ একজন প্রতিভাবান বন্ধুর প্রস্থান

শ্রদ্ধাঞ্জলি । মাওলানা আব্দুল হালিমঃ একজন প্রতিভাবান বন্ধুর প্রস্থান

by MD JUNAYED SHEIKH
মাওলানা আব্দুল হালিম

মাওলানা আব্দুল হালিম। আমার বন্ধু , আমার সহপাঠী। আমাদের প্রথম দেখা , ২০১০ সালে ৷ একবছর গ্রামে মক্তব পড়ে চলে আসি ঢাকায় ৷ ঢাকার খিলগাও শাহজাহানপুরে অবস্থিত আব্দুস সোবহান ইসলামিয়া মাদ্রাসায় এসে ভর্তি হই ইবতেদায়ী জামাতে ৷ আব্দুল হালিমও ভর্তি হয় একই জামাতে ৷ সেই সুবাদে তার সাথে পরিচয় ৷ আমাদের উভয়ের গ্রামের বাড়ি একই জেলায়— নেত্রকোনার দূর্গাপুর উপজেলায় ৷

শাহজাহানপুরে একই জামাতে ভর্তি হন আমার প্রিয় শ্রদ্ধেয় বড় ভাই হযরত মাওলানা আবুদ্দারদা আব্দুল্লাহ হাফিঃ ৷ আমার আর আব্দুল হালিমের সাথে আবুদ্দারদা ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর ৷ যদিও আরও অনেক সহপাঠী ছিল কিন্তু মনের দিক দিয়ে আমরা তিনজন ছিলাম— অভিন্ন হৃদয় , একদম কাছাকাছি। আমাদের পড়ালেখা ,খেলাধুলা এবং খুনসুটি সব একসাথেই হত ৷

বয়সজনিত কারণে ছোটখাটো বিষয়ে আমাদের ভেতর মনোমালিন্য দেখা দিত; কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হত না— আমাদের আবার মিল হয়ে যেত ৷ খুবই সুন্দর ছিল সেই সোনালী দিনগুলো ৷ আবুদ্দারদা ভাই মাদ্রাসা আব্দুস সুবহানে দু’বছর পড়ে মিজান জামাত শেষ করে অন্যত্র চলে যান ; কিন্তু আমি আর আব্দুল হালিম এখানেই থেকে যাই। এ মাদ্রাসায় শরহে -বেকায়া পর্যন্ত পড়ি ৷

ছাত্র হিসেবে আলহামদুলিল্লাহ আমি মেধাবী ছিলাম; কিন্তু আব্দুল হালিম ছিল খুবই দূর্বল ৷ এমনকি মিজান জামাত পড়ার পর, রেজাল্ট খারাপ হওয়ার দরুন; মাদ্রাসা থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাকে আর এ মাদ্রাসায় রাখা হবে না।

হুজুরদেরকে অনুনয় বিনয় করে আব্দুল হালিম নাহবেমির জামাতে সুযোগ পায় ৷ এরপর থেকেই শুরু হয় তার জীবনের অন্যতম অধ্যায় ৷ শুরু হয় তার কঠিন পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায় ৷ ভাবতেও অবাক লাগে, তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর মেহনতের ফলে সে নাহবেমীর জামাতের বোর্ড পরিক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে ৷

এরপর আমরা দুজন ভর্তি হই দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মালিবাগ জামিয়ায়। এখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। মালিবাগ থেকে দাওরায়ে হাদীস ( মার্স্টার্ষ্ট ) শেষ করি সুনামের সাথে ৷ আমাদের বন্ধন পূর্বের মতই মজবুত , শক্ত। আমরা ইফতাও পড়ি একসাথে— রামপুরার একটি স্বনামধন্য মাদ্রাসাতে ৷ আমাদের ক্লাসম্যাটদের মধ্যে আমরা দুজনই শুধুমাত্র শুরু থেকে শেষ, এক টানা দশবছর — একসাথে পড়ালেখা করে ছাত্রজীবনের সমাপ্তি টেনেছিলাম ৷

পড়ালেখার পাঠ শেষ হওয়ার পরে ভাবলাম প্রকৃতির নিয়মে এখন আমাদের দুজনকে পৃথক হয়ে যেতে হবে। খারাপ লাগছিল; কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা, আমাদের দুজনের খেদমতের বন্দোবস্ত হল একই মাদ্রাসায়— খিলগাঁও, শাহজাহানপুর মাদ্রাসা আব্দুস সোবহানে ৷

চাকরীতে জয়েন করে অল্পদিনের মধ্যে আমি বিয়ে করে ফেলি। আব্দুল হালিম পাত্রী খুঁজতে থাকে বিয়ের জন্য ৷ চাকরীর প্রায় তিনবছরের মাথায় সে বিয়ে করে ৷ সবমিলিয়ে আমাদের জীবন চলছিল খুবই আনন্দে ও সুখে ৷ তারপর ২০২৩ সালের জুলাই মাস ৷ কুরবানীর ছুটিতে আমরা বাড়ি গেলাম ৷ ছুটি শেষে দুজন এক ট্রেনে করেই মাদ্রাসায় ফিরলাম ৷ কে জানতো এটাই ছিল তার সাথে আমার শেষবার ট্রেন ভ্রমণ ৷

ছুটি থেকে আসার কয়দিন পরই সে অসুস্হ হয়ে পড়ে ৷ গায়ে ভীষণ জ্বর ৷ চারদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ। পত্রিকায় শুধু ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর। ভয়াবহ অবস্থা। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে আব্দুল হালিমের ডেঙ্গু ধরা পড়ে ৷ দ্রুত আমরা তাকে মগবাজার আদ-দ্বীন হসপিটালে ভর্তি করাই— জুলাইয়ের আঠার তারিখে , দুপুরের দিকে ৷ রাতে তার অসুস্হতার মাত্রা বেড়ে গেল ৷ পরদিন তাকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় ৷ আমরা মাদ্রাসায় ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করে তার জন্য রক্তের ব্যবস্হা করছিলাম ৷

হসপিটাল থেকে ফোন এলো , আব্দুল হালিমের অবস্হা খুবই আশঙ্কাজনক। দ্রুত হসপিটালের দিকে রওয়ানা দিলাম; কিন্তু হসপিটালে পৌঁছার আগেই ফোন এলো— আমার বন্ধু আব্দুল হালিম আমাদেরকে ছেড়ে পরকালের সফরে রওনা দিয়েছে ৷ ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন ৷

হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম, আব্দুল হালিমের লাশ বাহিরে বের করে রেখেছে ৷ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এটা আব্দুল হালিমের লাশ ৷ সাদা কাপড় থেকে মুখটা বের করে দেখলাম— সত্যিই আব্দুল হালিম আর নেই ৷ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম সবাই ৷ সবার মাঝে নেমে এলো শোকের ছায়া ৷ কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না ৷ কস্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ৷ মানুষের মৃত্যু অবধারিত। এই তিনটি শব্দ আমাকে খানিকটা সান্ত্বনা দিল।

জানাযা পড়া হয় আমাদের মাদ্রাসার পাশেই অবস্হিত শহীদবাগ জামে মসজিদে ৷ জানাযা শেষে তার লাশ নিয়ে রওয়ানা হই তার নিজবাড়ি নেত্রকোনা দূর্গাপুরের উদ্দেশ্যে ৷ সেখানে তার বাড়ির পাশেই মসজিদের মাঠে তাকে দাফন করা হয় ৷ আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন ৷

এখানে উল্লেখ্য যে , মাওলানাআব্দুল হালিম ইন্তেকাল করেন তার বিয়ের ছয় মাস পরেই ৷ তখন তার স্ত্রীর গর্ভে ছিল ছয় মাসের সন্তান ৷ এটা ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক বিষয় ৷ মেয়েটির বয়স এখন প্রায় চৌদ্দমাস ৷ এতটুকু ভাবলেই চোখে জল আসে।

হে আল্লাহ , আপনি ছোট্ট ফুটফুটে এতিম মেয়েটির জিম্মাদার হয়ে যান। আমার বন্ধুর কবরকে নুর দ্বারা ভরপুর করে দিন।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment