Home মুক্ত গদ্যশ্রদ্ধাঞ্জলি । একজন পরোপকারী মানুষের স্মৃতি

শ্রদ্ধাঞ্জলি । একজন পরোপকারী মানুষের স্মৃতি

by MD JUNAYED SHEIKH
শ্রদ্ধাঞ্জলি । একজন পরোপকারী মানুষের স্মৃতি

মৃত্যু অনিবার্য। আমরা সকলেই একদিন মারা যাবো। এই সত্য অস্বীকারের জো নেই; এরপরেও কিছু মৃত্যুর খবর মেনে নিতে কষ্ট হয়। মাওলানা আল আমীন শাহ—ইমাম, মাসজিদুল মারহুমাতাইন, সৌদি আরব, জিজান প্রদেশ। গত দু’দিন আগে আনুমানিক রাত প্রায় ১ টার দিকে দূর্বৃত্তের গুলিতে পরলোকগমন করেন।

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রিয় আল আমীন ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছি। নিদারুণ মর্মাহত হলাম। মরহুমের সাথে কাটানো সময়গুলো স্মৃতিময় হয়ে ধরা দেয় একেক করে।

আল আমিন ভাইর সাথে পরিচয় আট নয় বছরের পুরনো।

মাদ্রাসার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী রমজানের পর দাখেলা নিতে বুকভরা আশা আর হিম্মত নিয়ে ঢাকা শহরে পা রাখলাম। রাজধানী ঢাকাকে মাদ্রাসার শহর বলা হয়, তাই হাজারো মাদ্রাসার ভীড়ে জামিয়া ইকরাকে পছন্দের তালিকায় রেখে গেইট দিয়ে প্রবেশ করে যখন দিকবিদিকশুন্য লাগছিল— ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম কিছুটা।

নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা নতুন পথচলা — সবকিছু নতুন।

এহেন সংকটময় মুহূর্তে সামনে এসে ধরা দিলো ষোল সতের বছরের পরোপকারী এক তরুণ। ধবধবে সাদা পোষাক পরিহিত। চওড়া কপাল, তরবারির ন্যায় লম্বা নাক ও চিকন পাতলা লাল ঠোঁট বিশিষ্ট সুন্দর অবয়ব। পরিচয় পর্ব শেষে তার নামটি জানলাম—আল আমিন। আমার নামে নাম। মিতা হয়ে উঠলাম এবং হাঁপ ছেড়েও বাঁচলাম। অল্প সময়ে খাতির জমে গেল।

তার নিকট থেকে জামিআ ইকরার খুটিনাটি সব তথ্য পেলাম। একজন নতুন মানুষের জন্য এতটুকু সহযোগিতা বিরাট ব্যাপার। নতুন আগন্তককে বিশ্রাম করার সুবিধার্থে একটা রুমও দেখিয়ে দিলেন। আমার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম।

তখন থেকেই বলা যায়— এই তরুণটিকে আমার ভাল লেগে গেল। তার কল্যাণে জামিআ ইকরার প্রতি অনুরাগ তৈরি হল— একেবারে প্রথমদিন থেকে।

ভর্তি কার্যক্রম শেষ করলাম। প্রতিদিন নতুন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। দ্বিতীয়দিন আমাদের জামাতে একজন ভর্তি হলেন, সাঈদ আহমাদ। কিশোরগঞ্জ বাড়ি। সদা হাস্যজ্জল। পরিচিত হলাম। ভাল লাগল খুব।

নিয়ম অনুযায়ী ইফতেতাহী দরসের পরেরদিন ক্লাসে প্রবেশ করে দেখি— পরোপকারী সেই যুবা তরুণটি আমার ক্লাসমেট। মনে মনে আনন্দিত হলাম।

দিনশেষে মাগরিব নামায পড়ে ক্লাস রুমে বসলাম। রুমের সবকিছু এলোমেলো। সহপাঠীদের কেউ নিজের ছামানা গুছানোর কাজে ব্যস্ত, কেউ সূরা ওয়াকিয়াহ তেলাওয়াত করছেন। আমি গ্রাম ছাড়ার ব্যথা বেদনা নিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আনমনে বসে ছিলাম।

হঠাৎ সুমধুর কন্ঠে কুরআনে পাকের তেলাওয়াত কানে ভেসে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি আল আমীন ভাই সুললিত কণ্ঠে পড়ছেন। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। আহ কী অনিন্দ্য সুন্দর মনোমুগ্ধকর তেলাওয়াত। মাশাল্লাহ বারাকাল্লাহ। খানিকটা ঈর্ষা হল।

আল আমীন ভাই করিতকর্মা লোক। তেলাওয়াত শেষ করে কাজে নেমে পড়লেন। রুম গোছাতে হবে। রুম পরিপাটি হওয়ার আগ পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।

আমি ছোটবেলা থেকেই অন্তর্মুখী স্বভাবের। শরহে বেকায়া জামাতে পড়ি। বয়স বেড়েছে ঠিক কিন্তু স্বভাবটা থেকে গেছে। কোন বিষয় নাক গলানোর সাহস হয় না। কিন্তু ক্লাসে যখনই কোন সংকট বা প্রয়োজন দেখা দিয়েছে , আমার চিন্তা করা লাগেনি। আল আমিন ভাই সমাধানের পথ বের করতে এগিয়ে এসেছেন।

ছোট থেকে বড়—সমস্ত বিষয় তার একটি কথাতে সমাধান হয়ে যেত। কঠিন থেকে কঠিন বিষয়গুলোকে কী নিপুণ হিকমায় যে শুধরাতেন। তার সফল নেতৃত্ব গুণ দেখে অবাক হতাম।

এ তো গেলো ক্লাসের বিষয়।

যদি ক্লাসের বাহিরের বিষয়গুলোতে যাই, ফিরিস্তি আরো লম্বা হবে। যে যখনই কোন সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে নিজেকে উজাড় করে সমাধানের পথ খুঁজে দিয়েছেন। নিজের সুরক্ষার কথা ভাবেননি, স্বার্থ কথা তো বহুত দূরের বিষয়। অপরের উপকারে নিজেকে বিলীন করা ছিল তার নেশা।

আমার পড়াশোনার দীর্ঘ চারটি বছর কেটেছে আল আমীন ভাইয়ের সাথে। চার বছরে আমার নিজস্ব কোন সিম ছিলো না, সব সময় তার মোবাইল দিয়ে বাসায় যোগাযোগ বা টাকা আনতাম। প্রায় অধিকাংশ সময় এমন হতো, আমি জানতাম নাহ টাকা আসছে বা কত আসছে? টাকা উঠিয়ে খুচরা করে আমাকে দিয়ে বলতো, বাড়ি থেকে তোমার টাকা আসছে—এই নাও। খরচ দিতেও সাহস করতাম না, কারণ ধমক খেতে হবে— এই ভয় ছিলো।

এটা শুধু আমার বেলায় সীমাবদ্ধ ছিলো না, প্রায় অধিকাংশ ছাত্রদের বেলায় এটা ঘটতো।

এরকম কত গল্প যে আমার বুকে বাসা বেঁধে আছে, লিখতে বসলে ছোটখাটো একটি পুস্তিকা হয়ে যাবে।

আমাদের জামাতের সকল প্রয়োজনে, সুখে-দুঃখে এভাবেই তাকে অগ্রগামী হিসেবেই পেয়েছি। মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা ছিল তার স্বভাব। এই মহান স্বভাবের দ্বারা কত মানুষ উপকৃত হয়েছে, ইয়ত্তা নেই।

হে আল্লাহ, অন্ধকার কবর জগতে আপনি এই পরোপকারী মানুষটির বন্ধু হয়ে যান।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment