তামাম কোলাহল থেকে দূরে থেকে, নিরবে নিভৃতে, কিছু মানুষ শুধু আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন এবং উম্মাহর খেদমতে নিজেদের উৎসর্গ করেন। দুনিয়ার খ্যাতি বা সম্পদের মোহ তাদের স্পর্শ করতে পারে না, যদিও চাইলে তারা সেসব পেতে পারতেন। এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমার প্রিয় নানাজান—হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহঃ-এর অন্যতম খলিফা ও শাগরেদ আল্লামা নিয়াজ মাখদুম রহঃ (চিনের হুজুর)-এর হাতে গড়া শাগরেদ দ্বীনের উজ্জ্বল নক্ষত্র, অসংখ্য হাফেজ ও আলেম গড়ার কারিগর, মানুষের আত্মিক পথপ্রদর্শক, ভোলার ইসলামী অঙ্গনের অন্যতম উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব—হাফেজ মাওলানা আব্দুল মালেক রহঃ।
গত ২৩ মার্চ, ২২ রমজান আসরের সময়, উলামায়ে কেরামের একটা মজলিসে দোয়ারত অবস্থায় হঠাৎ বুক ব্যথা উঠে, তারপর বাড়িতে আনলে খুব শান্তভাবে আমাদের সবাইকে শোকাহত করে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে পারি জমান । ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৮৭+ বছর।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন ওস্তাদদের প্রিয়, মেধাবী ও পরিশ্রমী। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি সারসিনা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেন এবং তৎকালীন যুগের খ্যাতিমান আলেমদের শাগরেদ হন। বিশেষত হযরত মাওলানা নিয়াজ মাখদুম রহঃ (চিনের হুজুর) এবং বিহারী হুজুরের সান্নিধ্যে থেকে ইলম ও তাসাউফ শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে নিজ জেলায় ফিরে মাত্র ৯ মাসে হিফজ সম্পন্ন করেন আমার চাচা হাফেজ মাওলানা ইদ্রিস সাহেব রহ: (রাধাবল্লভের হুজুর) কাছে।
এরপর শুরু হয় দ্বীনের দাওয়াতি জীবন। দীর্ঘ দুই-তিন দশক ইসলামের বার্তা নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়িয়েছেন। আল্লাহ তাকে এক অপার্থিব, যাদুকরী কণ্ঠ দান করেছিলেন। কখনো কখনো তিনি ৭-৮ ঘণ্টা টানা বয়ান করতেন, কিন্তু কোন ক্লান্তি তাকে ছুঁতে পারত না। তার বয়ানের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ কুরআনের আলো লাভ করেছেন। গ্রামে নানার একটা মাদ্রাসা ছিলো, বছরে দুইবার সেখানে মাহফিল হত। মাহফিল উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন সবাই বাড়িতে আসতো। অন্যরকম একটা আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হত তখন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, ২০১০ এর দিকে মাদ্রাসা-মসজিদ সহ পুরো বাড়ি নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে যায়।
পারিবারিক জীবন
তিনি চারজন স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। তার শ্বশুর, অর্থাৎ আমার নানুর বাবা ছিলেন চরফ্যাশনের প্রখ্যাত আলেম, মাওলানা হুসাইন আহমাদ রহঃ। মৃত্যুর সময় তিনি ৩ স্ত্রী ও ১৮ জন সন্তান রেখে যান। তার ৭জন ছেলের মধ্যে ৬জনই হাফেজ-আলেম। মেয়ে ১২জন। তার মধ্যে একাধিক হাফেজা রয়েছেন। তাদের জামাইরাও হাফেজ-আলেম। আলহামদুলিল্লাহ।
মৃত্যুর ঠিক তিন দিন আগে তিনি নিজ হাতে নোয়াখালীর মাটিতে দাফন করে আসেন প্রিয় মামা হাফেজ মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ সাহেবকে। মামার মৃত্যু তাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। তিনি গ্রামে ফিরে এসে কয়েকজনকে বলেছিলেন,
“আমার ছেলে চলে গিয়েছে, আমিও চলে যাবো।”
তার সেই কথা সত্যে পরিণত হলো। ছেলের মৃত্যুর মাত্র তিন দিন পর তিনিও চলে গেলেন মালিকের ডাকে সাড়া দিয়ে।
এক মহান আলেমের উত্তরাধিকার:
তার মুহিব্বিনের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন ১২১ জন সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনি। এই বিশাল পরিবারের মধ্যে ৪০+ জন হাফেজ, আলেম-আলেমা রয়েছেন। অনেকেই এখনো ইলমের তালিব।
তার মৃত্যুর পর পুরো এলাকা শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সবাই যেন এক অভিভাবক হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে পড়েছিল। তার জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল। বাটামারা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জানাজার সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষের সমাগমই প্রমাণ করে, তিনি কতটা ভালোবাসার পাত্র ছিলেন।
তার ব্যক্তিত্ব ও জীবনধারা:
নানাজান ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী ও সবার প্রতি দয়ার্দ্র হৃদয়ের অধিকারী। রাস্তা দিয়ে চলার সময় তিনি সবার আগে সালাম দিতেন এবং সর্বদা ডানপাশ ধরে মাথা নিচু করে হাঁটতেন। সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন এবং মানুষের খোঁজখবর নিতেন।
নানার সাথে যখন রাস্তায় চলতাম, আমি মাঝে মাঝে নানা সাহেবকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতাম। তিনি নির্দ্বিধায় উত্তর দিতেন। কখনো কখনো পুরো পথজুড়ে গল্প করতেন, যার মাঝে থাকত ইলম, ইতিহাস এবং তার ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ। মাঝেমাঝে ঘরেও বসে বসে রাতের বেলা গল্প করতেন।
নানার সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো অন্য সব নাতী নাতনীর চেয়ে আলাদা। আমি নানাজানকে পেছনে রেখে মোট ৩বার খতম তারাবি পড়িয়েছিলাম। জীবনে প্রথম দুইবছর তারাবি নানার মসজিদে পড়িয়েছিলাম। করোনাকালীন সময়ে নানা, নানু, খালা মামাদের সাথে নিয়ে নানার বাড়িতে খতমে তারাবি পড়িয়েছিলাম। এমন সৌভাগ্য অন্য কারও ভাগ্যে জুটেনি। আল্লাহর শুকরিয়া। এসব স্মৃতি আমাকে প্রতিনিয়ত কাঁদাচ্ছে।
আমার বাবা ও নানাজানের পরামর্শ:
নানার যত মেয়ে-জামাই ছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম ছিলেন আমার বাবা হাফেজ মাওলানা কারী আব্দুল হাকিম দৌলতী রহঃ। নানা প্রায়ই আমাকে বলতেন,
“তোমার বাবার মতো হও।”
আল্লাহ নানার সেই দোয়া আমাদের জীবনে কবুল করুন।
স্মৃতির পাতায় শেষ সাক্ষাৎ:
নানার সাথে বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে, যা এখানে এই ছোট্ট পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। সর্বশেষ মামার জানাজায় নোয়াখালীতে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সেদিন আমরা দুই ভাই ও মামাতো দুই ভাই মিলে মামার মসজিদে তারাবি পড়িয়েছিলাম। নানা আমাদের দোয়া দিয়েছিলেন এবং ঈদে বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাকদিরে লেখা ছিলো যে ভিন্ন কিছু! আমার এক বোন নানার সামনে বসে কান্না করে বললেন, নানা! আমাদের জন্য দোয়া করবেন। নানা বললেন, আহা কি বলো! আমার এমন কোন মুনাজাত নেই যেখানে তোমাদের জন্য দোয়া করিনা। তারপর সেদিন বিদায় নেই।
২০ মার্চ, বৃহস্পতিবার ফজরের পরে, নানা মামার জন্য এক আবেগঘন মুনাজাত করেন। আমি সেটি আমার ফোনে রেকর্ড করে রেখেছিলাম। আজ সেই মুনাজাত কেবলই স্মৃতি!
আর কিছুদিন পরেই ঈদ। নানার পেছনে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য এবং নানার সাথে ঈদ কাটানোর জন্য আমরা ছুটে যেতাম নানাবাড়িতে। ঈদের নামাজ শেষে তিনি যখন আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করতেন, তখন মনে হতো—জাহান্নাম যেন সামনে উপস্থিত! মুসল্লিরা কান্নায় ভেঙে পড়তেন। কিন্তু হায়! এবার আর সেই দৃশ্য দেখা হবে না!
নামাজে তার কুরআন তিলাওয়াত ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। সুরা মুরসালাত, নাবা, গাশিয়াহ, বুরুজ, তারিক—এগুলো যখন তিলাওয়াত করতেন, তখন মনে হতো, যদি আরও বড় কোন সুরা পড়তেন! আজও নানার সুর কানে বাজে।
তবে ভালো কথা হল, আল্লাহ তাআলা তাকে রমজান মাসে, রোজা অবস্থায়, সুস্থ শরীরে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো আলামত।
আমরা মহান রবের কাছে দোয়া করি— হে আল্লাহ! আমাদের প্রিয় নানাজান হাফেজ মাওলানা আব্দুল মালেক রহঃ-কে ক্ষমা করুন। তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মর্যাদা দান করুন। তার পরিবারকে দ্বীনের উপর অটল রাখুন। আমিন।