Home মুক্ত গদ্যস্মৃতিগদ্য। শৈশবের ঈদ

স্মৃতিগদ্য। শৈশবের ঈদ

by MD JUNAYED SHEIKH
স্মৃতিগদ্য। শৈশবের ঈদ

চাঁদরাত। কেন যেন এই সময়ে এসে হারানো সেই ছেলেবেলাতেই ফেরার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে। এইদিনের পুরোনো স্মৃতিগুলো বারবার উঁকি দেয় মনের ক্যানভাসে। ঈদের কেনাকাটা আম্মা সবসময় এইদিনের জন্যই তুলে রাখতেন।

ঈদের চাঁদ ওঠার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়তাম মার্কেটের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার সময় আমাদের দুইভায়ের আনন্দটা হতো দেখার মত। দুই সহোদর আম্মার হাত ধরে নাচতে থাকতাম। বাসা থেকে মার্কেটের দূরত্ব বেশ খানিকটা পথ হলেও খুব কাছে মনে হতো।

মার্কেটে ঢুকে হতোদ্যম হয়ে যেতাম। কত রঙের জিনিসপাতি। সোজা যেতাম কাপড়ের দোকানে। কেনাকাটার বেলায় আম্মা সতর্ক। চুলচেরা বিশ্লেষন আর হার না মানা দরদাম। দীর্ঘ এই পর্ব শেষে বাড়ি ফিরতাম সারা রাজ্যের ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে। চোখের পাতায় ঘুম নামতে দেরি হতো না।

একবার চাঁদরাতের দিন মার্কেটের কথা বলতেই আম্মা বলল, তোমার আব্বু সকালে কিনে নিয়ে আসবে। আমাদের দুই ভাইয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল । বাবার অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, টেরও পেলাম না।

ঘুম থেকে জেগে দেখি আব্বা এখনও আসেনি । নতুন জামা না পাওয়ার আশঙ্কায় দুচোখ বেঁয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগল। ফজরের পর আব্বু এলেন কিন্তু আব্বুর হাত ছিলো শূন্য। আমাদের কান্না যেন কোনো বাঁধ মানছিল না।

আম্মা নিরুপায় হয়ে প্রতিবেশীর কাছে ঋণের জন্য ছুটলেন। কাঁকডাকা ভোর। কিছুক্ষণ পর আম্মা আমাদের নিয়ে ছুটলেন মার্কেটের উদ্দেশ্যে। কয়েকটা দোকান খোলা ছিল। মনের কষ্টগুলো আনন্দে রূপ নিল। নতুন জামা আর জুতা পেয়ে চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সেই দিনই প্রথম অনুভব করলাম আনন্দেও অশ্রু ঝরে।

সেদিনের সেই ছেলেমানুষী আজ মনে পরলে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। অবুঝ আমি সেইদিন আম্মাকে লজ্জিত করেছি। মহান রবের কাছে তাই একটাই চাওয়া— মা বাবা যত্নে কোন ত্রুটিই যেন আমার দ্বারা না হয়।

মনে পড়ে , ঈদের দিন তাড়াতাড়ি উঠতাম। আম্মা নিজ হাতে আমাদের গোসল করিয়ে কাপড় পরিয়ে দিতেন। যাওয়ার পথে নিজের নতুন জামার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকাতাম বারবার। গ্রামে-গঞ্জে ঈদগাহ থাকলেও ইটপাথরের এই ঢাকা শহরে ঈদগাহ এখন বিলুপ্তির পথে। যেখানে আছে তাও না থাকার মতো।

ঈদগাহের যে আমেজ—মসজিদে তা অনুপস্থিত ।

একবার ঈদগাহ থেকে নামাজ পড়ে ফিরছিলাম। গলির মুখে ঢুকলাম। নিচের দিকে তাকাতেই আনন্দে মনটা নেচে উঠল। মাটিতে পড়ে ছিলো একটা কচকচে নোট। পরিমাণটা মনে নেই। তবে অনেক কিছু কেনার মত ছিলো। দুই ভাই দৌড় দিয়ে বাসায় আসলাম।আম্মাকে বলতেই মৃদু একটা ঝাড়ি দিলেন। বললেন,পড়ে থাকা টাকা ব্যবহার করা যায়না। যদি উঠিয়েই ফেলো তাহলে মালিককে পৌঁছে দেওয়া আবশ্যক হয়ে যায়। যাও, মালিক না পেলে মসজিদে দিয়ে এসো।

আজ সেই দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ লিখতে বসে দাওরার বছর সিহাহ সিত্তাহের দরসে ‘লাকিতা’র অধ্যায়ে উবা ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর একটি হাদিস মনে পড়ছে—হযরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু স্বর্ণভর্তি একটা থলে কুড়িয়ে পেলেন। থলিটি নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে আসলেন। সবকিছু জানার পর নবীজি তাকে এক বছর এলান করার আদেশ দিলেন। তিনি এক বছর এলান করলেন।

শেষে কাউকে খুঁজে না পেয়ে ফের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর দরবারে আসলেন। নবীজি আরও এক বছর এলান করতে আদেশ করলেন। এবার ও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এভাবে তিন বছর অতিবাহিত হলো। এবার নবীজি স্বর্ণের থলিটির আকার, আকৃতি, পরিমান ইত্যাদি খুব ভালোভাবে উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে দেখে রাখতে বললেন। এবং ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। সাথে সাথে আদেশ করলেন—’যদি মালিককে কোনদিন পাওয়া যায় তাহলে তাকে তার সেই থলির অনুরূপই ফিরিয়ে দিবে।’

এই ঘটনা পড়ার পর থেকে রাস্তায় কিছু পড়ে থাকতে দেখলে এখন আর উঠানোর সাহস সাহস হয় না। তিন বছর এলান কি যেই সেই বিষয়!

আমরা ঈদগাহে ফিরে যাই।

আমাদের গ্রামের ঈদগাহে নামাজ শেষে শুরু হতো আনন্দঘন কোলাকুলি পর্ব। বাসায় এসে মায়ের হাতের সুস্বাদু সেমাই আর জম্পেশ খানা খেয়ে নেমে পড়তাম ঈদ সালামি সংগ্রহ অভিযানে। বাবা,কাকা,বড় ভাই ,দাদা,দাদি,মামা ,মামী —কেউ-ই রেহাই পেতো না। তারা হাসিমুখে আব্দার মেটাতেন।

এখন ভুগতে হয় নিজেকে, সালামি তো পাই-ই না, উল্টো বিলি বণ্টনে দিশেহারা। নতুন জামা পরার সেই আকুলতা হারিয়ে গেছে। নতুন কিছু কিনে দিতেই বেশি আনন্দ লাগে এখন।ছোট্ট ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নিরা যখন নতুন জামা পরে তখন ওদের মাঝে নিজের সেই ছেলেবেলাকে আবিষ্কার করি।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment