বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান সামুদ্রিক বন্দর মোংলা, বাগেরহাটের একটি মাদরাসায় দুই বছর যাবত খেদমতের দায়িত্বে আছি। পবিত্র রমজান মাস। মাদ্রাসায় ছুটির আমেজ চলছে। দীর্ঘ একমাসের লম্বা ছুটি। নূরানি এবং হিফজ শাখার ছেলেরা এই ছুটির আওতায় নেই। কিতাব বিভাগের যারা থাকে, তাদের নিয়েই মূলত আমাদের ব্যস্ত সময় কাটে। যথাসম্ভব যোগ্য করে গড়ে তলার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা। দরস প্রদান, হাতের লেখার তদারকি ও মাসিক পরিক্ষা বাস্তবায়ন ইত্যাদি।
রমজান মাসের রুটিনে পরিবর্তন এসেছে।
ফজরের নামাজ পড়িয়ে তারাবীহর পড়া ইয়াদ করতে হয়েছে। দূরে একটি মসজিদে খতম তারাবি পড়িয়েছি। ঘুম থেকে উঠে সকাল নয়টা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত দরস করিয়ে শরীরে আর কুলোয় না তাই একটু বিশ্রাম নিতাম।
সারা দিন রোজা রেখে মাদরাসা,মসজিদ, তারাবীহ— এই তিনটি খেদমত একসাথে আঞ্জাম দেওয়া কতটা কষ্টকর তা শুধু সেই ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে যিনি এই বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। মোদ্দাকথা , রমজানের প্রতিটি দিনই অনেক মেহনতের উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে।
সে কারণে কিছু ছাত্রদের সাথে পরামর্শ করলাম, সাতাশ রমজানে তারাবীহ শেষ করে কোথাও ঘুরতে গেলে কেমন হয়। সবাই খুব আগ্রহ প্রকাশ করল। দর্শনীয় জায়গা নির্বাচন নিয়ে বেগ পেতে হল না। যশোর লিচুতলা মাদরাসায় সফর করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারন আমার প্রিয় উস্তাযে মুহতারাম মুফতী আমির হামজা সাহেব সেখানকার নাযেমে তালিমাতের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু দিন তারিখ মেলাতে গিয়ে বিপত্তি দেখা গেল। আজকে বৃহস্পতিবার, আগামীকাল জুমাবার। শুক্রবারে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে, ইচ্ছা করলেও কোথাও যাওয়া হয় না।
ছাত্রদের মুখগুলো মলিন হয়ে গেল। বললাম— “নিয়াত যখন করেছি তখন যাবো”। যেই কথা সেই কাজ জুমা পড়িয়েই চৈত্রের প্রখর রোদে বেরিয়ে পড়লাম যশোর লিচুতলা মাদরাসার উদ্দেশ্যে। ট্রেনে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু স্টেশনে যেতে যেতেই ট্রেন ছেড়ে চলে যায়।
আমরা এবার রওনা হই সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ঘড়ির কাঁটয় তখন সন্ধ্যা ছয়টা ছুঁই ছুঁই।সেখানে গিয়ে টিকিট কেটে চটপট বাসে উঠে পড়ি। আমার সহপাঠী মুফতী কাজী আরশাদ হুসাইন, যিনি আল্লামা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ নাওওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু’র ভাতিজা। আমাদের জন্য ইফতারের আয়োজন করে বসে আছেন। তিনিও লিচুতলা মাদরাসায় হাদীসের কিতাব পড়ান। এই খান্দানের বড় বিশিষ্ট — মেহমাননেওয়াজি। আদর আপ্যায়নে এঁদের জুড়ি মেলা ভার।
আমরা ইফতারের জন্য কিছু খাবার ও পানি নিয়ে বাসে উঠলাম। একটি মসজিদের সামনে গিয়ে বাস থামল। ইফতারের জন্য় ব্রেক। আমরা তড়িঘড়ি ইফতার করি । এই ইফতারি এসেছে পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে— বাসের যাত্রীদের জন্য ইফতারি পাঠিয়েছে । মসজিদ কমিটির উদারতাটুকু মুগ্ধ করে। ইফতারি শেষে নামাজ পড়ে আবার রওনা করি।
রাত সাড়ে আটটার দিকে আমরা যশোরে পৌঁছাই। আরশাদ সাহেব প্রথমে তাদের বাসায় নিয়ে যান। হরেক রকম খাবারের আয়োজন করেন। খাবার শেষে আমরা লিচুতলা মাদরাসার অভিমুখে রওয়ানা হই। মাদ্রাসায় ঢুকতেই মন জুড়িয়ে গেল ।
মাদ্রাসার বিস্তর যায়গা, ছড়ানো ছিটানো গাছপালা আর নয়ানাভিরাম মসজিদ দেখে বিমোহিত হয়ে গেলাম। মাদরাসা বন্ধ থাকায় হিফজ খানার কিছু ছাত্র ব্যতীত তেমন ছাত্র ছিলনা। আমাদের জন্য আগ থেকেই বিছানা করা ছিল। ছাত্ররা অনেক ক্লান্ত। তারা দ্রুত শুয়ে পড়ে।
আরশাদ সাহেবের সাথে অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় আমরা বিভিন্ন কথা বার্তা বলতে থাকি। আমারো ঘুম পাচ্ছে। যখন ঘুমাতে যাব ঠিক তখনই কাজী সাহেবের আরেক ভাতিজা মুফতী ইয়াহিয়া সাহেব এক লিটার ‘ক্লেমন’ নিয়ে উপস্থিত— খেতেই হবে। আদর আপ্যায়ন আর খোশগল্পে ঘুম উবে গেল।
চা খাওয়ার জন্য বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে মাদরাসা থেকে ঢাকা রোড পর্যন্ত চলে গেলাম। এক দোকান থেকে দুধ চা খেয়ে বেশ খানিক পরে মাদ্রাসায় ফিরে এলাম। তখন রাত চারটা বাজে। ছাত্রদের সাহরীর জন্য জাগিয়ে দেই।
কাজী আরশাদ সাহেব আমাদের জন্য বাসা থেকে সাহরীর খাবার নিয়ে এসেছেন। মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেবও কম যান না— তিনি নিয়ে এসেছেন কেক আর ফল। না খেয়ে নিস্তার নেই। অল্প স্বল্প খেয়ে ফজরের নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকাল নয়টার দিকে ঘুম থেকে উঠে মুফতী আমির হামজা সাহেবের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলাম। হুজুর খুব গুরুত্বপূর্ণ নসিহা পেশ করেন। এরপর আমরা যশোর জেলার দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি স্পটে ঘোরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সারাদিন যশোর ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার ট্রেনে আমরা মোংলার উদ্দেশ্যে রওনা করি।এবারো ইফতার চলতি পথে করতে হয়।
খুলনা পৌঁছে জিরো পয়েন্ট থেকে চুই ঝালের মাংস দিয়ে খানা খেলাম। মাদ্রাসার পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত এগারোটার বেজে গেল । ছাত্ররা বলে — ঈদের পূর্বে আমাদের ঈদ আনন্দ উপভোগ হয়ে গেল।