রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন—”মুমিনদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহমর্মিতা এমন, যেন তারা এক দেহ। দেহের একটি অঙ্গ পীড়িত হলে, তার কারণে পুরো দেহ জেগে থাকে ও জ্বরে ভোগে।” ( মুত্তাফাকুন আলাইহি )
এই হাদীস স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়—উম্মাহ একটি শরীরসদৃশ। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কোনো মুসলমান মজলুম হলে, সেটি গোটা উম্মাহর ব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। তখন ঐ মজলুম মুসলিমকে রক্ষা করা এবং জালিমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব হয়ে যায়।
আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে মুসলমানরা নির্যাতিত, নিপীড়িত, খুন হচ্ছে। তাদের বুকফাটা আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী, কিন্তু বিশ্ব বিবেক নিশ্চুপ! বিশেষত, ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্বরতা আজ সকল সীমা অতিক্রম করেছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ—কাউকে রেহাই দিচ্ছে না তারা। ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল—সবকিছু ধ্বংস করে চলছে পরিকল্পিত গণহত্যা।
এই নির্মম পরিস্থিতিতে ২০০ কোটি মুসলিম জনতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর মুসলিম দেশগুলোর কথিত নেতারা আজও পশ্চিমাদের খুশি রাখতে ব্যস্ত। তাদের পা চাটতে যেন তারা মরিয়া!
হে আল্লাহ! আপনি তাঁদের হিদায়াত দিন, নয়তো তাঁদের সরিয়ে ঈমানদার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুন—যারা আপনাকে ভয় করে, যারা উম্মাহর ব্যথায় ব্যথিত হয়।
২
বিশ্ববিখ্যাত আলেম, পাকিস্তানের গ্র্যান্ড মুফতি, তাকী উসমানী দা.বা. ঘোষণা করেছেন:
“বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলিম শাসকদের জন্য জিহাদ ফরজ হয়ে গেছে।”
৫৫ হাজারের বেশি মুসলিম নারী, শিশু ও পুরুষ শহীদ হয়েছে—যদি এখনো জিহাদ ফরজ না হয়, তাহলে আর কবে হবে? সাধারণ মানুষের পক্ষে বন্দুক হাতে যুদ্ধ করা না পারলেও—প্রতিবাদ, ঘৃণা, বর্জন, মিছিল—এগুলোই তাদের হাতিয়ার।
এই লক্ষ্যেই ১২ এপ্রিল, ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় “মার্চ ফর গাযা” মহাসমাবেশ। উলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ আহ্বানে লাখো জনতা জমায়েত হয় ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানাতে এবং ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা এবং তাদের পণ্য বয়কটের জন্য।
সেদিন আমি ছিলাম আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া উসমান বিন আফফান, নিকুঞ্জ-এ।
জোহরের নামাজের পর এক উস্তাদ ও এক ছাত্র ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সমাবেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভুইয়া বাসে চড়ে বিজয় সরণিতে নেমে পড়লাম।
সেখানে দেখি ২০-২৫ জনের একটি দল “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” স্লোগান দিয়ে শাহবাগের দিকে এগোচ্ছে। আমরা তাদের সঙ্গে একত্রিত হলাম।
একসময় সেই ক্ষুদ্র দলটি স্রোতের মতো বিশাল মিছিলে রূপ নিলো। স্লোগানে মুখরিত হয় চারদিক—
“সাবিলুনা সাবিলুনা, আল-জিহাদ, আল-জিহাদ!”
“তুমি কে? আমি কে? ফিলিস্তিন! ফিলিস্তিন!
“ইসরাইলের আস্তানা, ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও!”
“নেতানিয়াহুর চামড়া, তুলে নেব আমরা!”
এসব শ্লোগান দিয়ে কখন যে শাহবাগ এসে পড়লাম টেরই পেলাম না। শাহবাগ পার হয়ে পৌঁছলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

উদ্যানের প্রবেশমুখে প্রচণ্ড ভিড়, ঠেলেঠুলে কোনমতে ঢুকলাম। পুরো উদ্যান কানায় কানায় পূর্ণ। শুধু তাই নয়, আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিলো মানুষের ঢল! শেষ কবে ঢাকায় এমন জাগরণ ঘটেছে, তা বলা মুশকিল।
জন মানুষের ভিড়ে এক সাথীকে হারিয়ে ফেলি। ফোনের নেটওয়ার্কও প্রায় অচল।
ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁয়েছে।
সমাবেশের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হল পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। প্রখ্যাত ক্বারি আহমদ বিন ইউসুফ আল-আজহারীর সুললিত কণ্ঠ হৃদয় ছুঁয়ে গেল।
“মার্চ ফর গাজা”র আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মঞ্চে উপস্থিত হলে “আমার দেশ” পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান “মার্চ ফর গাযা”-র ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে বিকাল ৪টা নাগাদ বাইতুল মুকাররামের খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব হৃদয়গ্রাহী মুনাজাত পরিচালনা করেন।
উদ্যান থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে আসি বাইতুল মুকাররমে— জাতীয় মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করি । খানিকপর ছোট ভাই মাহবুব উপস্থিত, তাকে নিয়ে বাসে চড়ে সেদিনের মত বাসায় ফিরলাম। রাত পোহালে দুজনকেই ছুটতে হবে মাদ্রাসায়!
একটি বিষয় আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে, তা হলো—বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান এখনো ঈমানি প্রশ্নে আপোষহীন। সমাবেশে যেসব যুবকের মুখে সাহসী স্লোগান ছিল, তাদের চোখে ছিলো প্রতিশোধের আগুন, হৃদয়ে ছিলো ব্যথা।
হে আল্লাহ, আপনি গাযাবাসীদের বিজয় দিন, ইসরাইলিদের ধ্বংস করুন।
আমাদের প্রতিবাদ কবুল করুন, আমাদেরকে হকের সৈনিক বানান।
আমিন।
মাহফুজ ইবনে আব্দুল হাকিম
শিক্ষকঃ জামিয়াতু উসমান বিন আফফান রাঃ নিকুঞ্জ ২, খিলক্ষেত, ঢাকা।