বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আমি তখন সবেমাত্র নাহবেমীর জামাতে পড়ি। পিতৃতুল্য উস্তাদদের নেগরানে সারা বছর অনেক মেহনত করে সুন্দর ভাবে পরিক্ষা শেষ করি। শিক্ষাবর্ষ শেষ। চারপাশে ছুটির আমেজ। রমজান মাস আসন্ন। চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তারাবীহ। গত বছর খুলনা পাবলিক কলেজে তারাবীহ পড়ালেও এ বছর সেখানে আর আমার তারাবিহ পড়ানো হচ্ছে না। কারন সেখানে তারা তাদের ছাত্রদের দিয়ে তারাবীহর নামাজ পড়াবেন।
বিভিন্ন স্থানে তারাবির ইন্টারভিউ দিতে শুরু করি কিন্তু কোথাও তারাবীহ হল না। পরিক্ষার চাপে সারা বছর তেমন কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করার সুযোগ হয়নি। যদ্দুরুন ইয়াদে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। খুব খারাপ লাগছিল। মনে মনে আল্লাহর কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করছিলাম । একজন হাফেজ সাহেবের তারাবীহ না পড়ানো কতটা বেদনাদায়ক তা শুধু একজন হাফেজ সাহেবই উপলব্ধি করতে পারবেন।
হঠাৎ তারাবীহর দিন সকালে আমার প্রিয় উস্তায হাফেজ আবু সাঈদ সাহেবের ফোন। ভূমিকা ছাড়াই হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, তাকদীর, তোর তারাবীহ ঠিক হয়েছে? বললাম, না। হুজুর বললেন, দ্রুত জামা কাপড় গুছিয়ে রওনা কর। সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বাঁশতলা গ্রামে একটা ভালো তারাবীহ আছে।
আগে পরে কিছু জিজ্ঞেস না করেই বাসায় জানিয়ে রওনা হলাম অজানা গন্তব্যের দিকে।বাসে উঠে হাফেজ সাহেবের দেওয়া নাম্বারে ফোন করে নিশ্চিত করলাম। তারা জানালেন, এখানে প্রথম তিনদিন দুই পারা করে পড়তে হয়। আর আপনি শেষে অর্থাৎ দুই নাম্বার পারা থেকে পড়াবেন অন্যদিকে আমি প্রথম পারা ইয়াদ করে বসে আছি। তাদের কে কিছু বলতে গেলাম না,কি না কি ভাবে সেই ভয়ে।
বাসে বসেই ইয়াদ করতে লাগলাম। মধ্য আওয়াজে পড়ছিলাম। বাসের যাত্রীরা আমার দিকে ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে ছিল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে মোটামুটি ইয়াদ হয়ে গেল। দুইবার বাস পরিবর্তন করতে হল। তারপর মটরসাইকেল যোগে মাগরিবের পর যেয়ে সেই মসজিএ পৌঁছালাম। প্রথমে যেয়েই গোসল করে ফ্রেশ হই এরপর মাগরিবের নামাজ আদায় করে পড়তে বসে যাই। এশার আগ পর্যন্ত একবার ভালো ভাবে দেখি। আলহামদুলিল্লাহ সেদিন তারাবীহ অনেক ভালো হয়েছিল।
২
সাতক্ষীরায় পূর্বে কখনো আসা হয়নি, এবারই প্রথম। সেখানকার মানুষের খাওয়া- দাওয়া, চলন, বলন সামাজিকতা রীতিনীতি সব কিছু এক ভিন্ন প্রকৃতির। অবশ্য এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নিদর্শন। সব মিলিয়ে আমার জন্য এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা বলা যেতে পারে।
দৈনন্দিন জীবনে তেলাপিয়া মাছের ব্যবহার দেখলে মনে হবে এখানকার জাতীয় মাছ তেলাপিয়া। কারনয় অধিকাংশ মানুষ শুধু তেলাপিয়া মাছ খায়। তেলাপিয়ার চাষও হয় অনেক। এরা টক বা খাটা খেতে খুব পছন্দ করে। সব খাবারের শেষে এই জিনিস না খেলে তাদের খাবার হজম হয় না। কেউ দিয়ে টক রান্না করে।
আমি প্রথমদিন ডাল মনে করে টক ঢেলে নেই এবং টকের তীব্রতার দরুন খেতেই পারিনি।মাছ রান্না করে একেবারে কাঁচা কাঁচা। তরকারি হয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে মাছ দেয়। একজনের কাছে জানতে চাইলাম এমনটা করার কারণ কি ? তিনি জানালেন, টকের কারণে মাছের আসল স্বাদ পাওয়া যায়।
তারা সাইকেলে ও ভাড়া টানে। যাকে সবাই হেলিকপ্টার নামে ডাকে। এই আজব হেলিকপ্টারে আরোহণের নিয়ম আছে। সাইকেলের পেছনে উঠলে মেয়েদের মতো এক পাশ হয়ে বসতে হবে অন্যথায় সবাই হাসাহাসি করবে। একবার তো আমি লজ্জায় নিজেই সাইকেল চালিয়েছিলাম কারন এক পাশ হয়ে বসার অভ্যাস নেই।
৩
এখানে ছোটদের “নুনু” বলে সম্বোধন করা হয়। একদিন আমি এক বাড়িতে দাওয়াতে গিয়েছি। দেখি, এক মুরুব্বি মনের সুখে বারান্দায় দোলনায় দুলছে। (এখানে প্রায় সবার বাড়িতে দোলনা থাকে তবে তা বাচ্চাদের জন্য নয়, বরং মুরুব্বিদের জন্য) মুরুব্বী আমাকে ডেকে বললেন, ” হাদে নুনু , তুমার বাড়ি কুতায় বলো ? কথাটা শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। মনে মনে রাগ হলো খুব। বললাম, খুলনা।
পরবর্তীতে জানতে পারি এখানে ছোটদের নুনু বলা হয়। ধীরে ধীরে স্থানীয় মাদ্রাসার ছাত্র, উস্তাদ আর এলাকাবাসীর সাথে পরিচিত হই। মানুষজন খুব আন্তরিক। অল্পতে আপন বানিয়ে নেয়। সবাই অনেক সহজ সরল।
একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রতিদিন আমার তারাবির মসজিদে ইফতারির জন্য পানি সেমাই আর শরবত খেতে দিতো । কোন দিন খেজুর থাকতো আবার কোন দিন থাকতো না। মসজিদের ইফতারে শরিক হওয়ার জন্য সবাই দূর দূরান্ত থেকে আসতো। তাদের ধারণা , পুরুষ মানুষ মসজিদে ইফতারি না করলে রোজা পরিপূর্ণ হয় না। আমিমসজিদের ইফতার খেতে পারতাম না। দোকান থেকে একশো গ্রাম পেঁয়াজি আর আলুর চপ কিনে এনে ইফতারি করতাম।
এখানে ইফতারির সব কিছু কেজি দরে বিক্রি হয় এমনকি কলাও। একবার আমি এক দোকানে কলা কিনতে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানদার প্রতিউত্তরে বলল, ভাই, ক’য়শো গ্রাম নিবেন ?
একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব তার ইফতারির দিন তিনি সেমাই না দিয়ে দুধের ক্ষীর রান্না করে দেন। এ নিয়ে তো তুলকালাম অবস্থা। কেন সেমাই দিলো না, এ কারণে মুসুল্লিগন বেজায় রাগ হয়েছে। অনেকে ইফতার না করেই চলে গেল।
বিকালে ছাত্রদের সাথে ঘুরতে বের হতাম সাত্তার সাহেবের বাগান বাড়ি । অসম্ভব সুন্দর পরিবেশ। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে ঘুরতে আসতো। এখানে ছিল বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালির সমারোহ। ছোট একটা চিরিয়াখানা বললেও ভুল হবে না।কি নেই তাতে? হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির পশু,পাখি, কবুতর, ইত্যাদি।
মজার বিষয় হচ্ছে, বাগান বাড়ির পুকুরে অনেক বড় বড় মাছ ছিল। মাছগুলো মনুষ্য বাচ্চাদের ন্যায় ফিডারে খাবার খেত । ঘাটের পাশেই ফিডার ও খাবার থাকতো। ফিডারে খাবার দিয়ে পানিতে দিলেই ইয়া বড় বড় মাছ এসে তা চুষতে থাকতো। আজিব ব্যাপার।
দেখতে দেখতে তারাবীহর দিনগুলো শেষ হয়ে গেল। এখানকার প্রতিটি জিনিসের মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছে। বিদায় বলাটা কঠিন। খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবু ও বিদায় যে নিতেই হবে। সকলের কাছে দোয়া নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা করি। মন পড়ে রইল সাতক্ষীরায় ।