মার্চ ফর গাজার উদ্দেশ্যে বেলা ১১ টায় মাদ্রাসা থেকে বেরুলাম খুব তড়িঘড়ি করে। গাড়ির জন্য দীর্ঘ ইন্তেজার কিন্তু না মিলাতে পারছি না। রাস্তাঘাট লোকে লোকারণ্য। যাত্রীদের বেশ চাপ। একধরনের যুদ্ধ করে বাসে উঠলাম।
ভীড়ের কারণ বুঝতে বেগ পেতে হয় না। এ নিয়ে কারো মধ্যে কোন অস্বস্তি নেই। গাড়ীতে কাকতালীয় ভাবে কৌশলে একটা সীট দখলে নিলাম পরে ছেড়ে দিবো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। গাড়ীর ইঞ্জিন চালু হয়েছে সবেমাত্র, চাকা এখনো ঘুরতে শুরু করেনি, সামনে দিক থেকে এক ভাই বলিষ্ঠ কন্ঠে নারায়ে তাকবীরের স্লোগান তুলল। আল্লাহু আকবার বলে সমস্বরে বাসভর্তি যাত্রীরা জানান দিল তাদের ঈমানী চেতনার। ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে সবাই উজ্জীবিত । সবার একটাই দাবি , ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের মুক্তি চাই, নিরাপত্তা চাই।
এভাবেই পুরো রাস্তাজুড়ে চললো স্লোগান ফিলিস্তিনের পক্ষে ইজরায়েলী হায়নাদের বিপক্ষে। কিন্তু আমাকে আবাক করেছে কয়েকটি বিষয়।
১. বাসে প্রায় পচানব্বই পার্সেন্ট মানুষ জেনারেল, তরুণ টগবগে যুবক টাইপের। তাদের মধ্যে যেই ঈমানী চেতনাবোধ আর উচ্ছাস দেখলাম তা বলে দেয় সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর বীর সেনা যেন জন্মেছে বাংলার ঘরে ঘরে। প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে যেন এক প্রতিশোধের অগ্নিশিখা জ্বলছিলো কি ঈমানীয়্যাত কি চেতনাবোধ কি দরদ নির্যাতিত ভাইদের প্রতি।
২. আমার পিছনের সীটে বসা আমার সমবয়সী এক ভাই হঠাৎ হৃদয়ের সবটুকু আবেগ নিয়ে, ঈমানের বলে বলিয়ান হয়ে বলল, আমাদের জন্য ফিলিস্তিন যাওয়া ওপেন করে দেন, আমাদের কোন গুলাবারুদ কামান লাগাবে না, তলোয়ারের প্রতি কুপে একটা জালেম মারবো। আমাকে মেরে ফেললে মারুক, তার আগে আমি তলোয়ার চালিয়ে ইহুদি জালেমদেরকে খতম করব।
এদের আবেগ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই তবে ইসলামের বিজয় হয়েছে যত না তরবারির মাধ্যমে তার চেয়ে একনিষ্ঠ রবের ইবাদাতের মাধ্যমে।
দীর্ঘ সময় এই টগবগে যুবককে দেখলাম। কল্পনার জগতে বিচরণ করে অনেক কিছু ভাবলাম, কিছুক্ষণের জন্য ইসলামের শুরু যুগে সাহাবায়ে কেরামের সীরাতে চলে গেলাম। কি ঈমানী জোর ছিলো সাহাবায়ে কেরামের। আজকে সেই ইমানি জোরের বড্ড অভাব।
২
বাস থেকে যতবার যতদূর তাকিয়েছি শুধু ফিলিস্তিনি পতাকাধারী মানুষের ঝটিকা মিছিল চোখে পড়েছে, কেউ পিকআপে , কেউ বাসে কেউ বা পায়দল। সবার কথা , আড্ডায় ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন অনুরণিত হচ্ছে। এক উদ্দেশ্যে নারীপুরুষ শিশু দলমত নির্বিশেষে সবাই ছুটে এসেছেন। চিরচেনা জ্যামের শহরে আজকের জ্যামের অবস্থা বুঝবার কারো বাকী নেই।
বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম, বাইতুল মোকাররম পৌঁছলাম হেঁটে হেঁটে । মানুষের প্রচন্ড ভীড় স্বেচ্ছাসেবকদের দৌড়ঝাঁপ বুঝতে বাকী রইলো না স্পেশাল কেউ হয়তো বের হবে তাই এতো ডিসিপ্লিন। যেই কথা সেই কাজ কিছুক্ষণের মধ্যে একে একে বেরিয়ে আসছিলো মঞ্চের উপস্থিত সমস্ত নেতৃস্থানীয় উলামা ও বিভিন্ন ঘরানার দায়ী হজরতগণ।
বিশেষ আকর্ষণ ছিলো জেনারেল থেকে উঠে আসা সেলেব্রিটি দায়ীদের উপস্থিতি। নেতৃত্বের ভার নিয়ে সামনের সারিতে ছিলেন বাইতুল মোকাররমের সম্মানিত খতীব আব্দুল মালেক সাহেব হাফিজাহুল্লাহ।
লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের সমাগম। সবার হাতে পতাকা– কারো হতে বাংলাদেশের, কারো হাতে ফিলিস্তিনের। সমাবেশ শেষে মানুষের ভীড় ছিন্ন করে দ্রুততার সাথে বাইতুল মোকাররম এসে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আছর নামাজের পর বের হওয়ার মতো কোন সুযোগ নেই। বাইতুল মোকাররম লোকে লোকারণ্য। দক্ষিণ গেইটে দাঁড়িয়ে সাহস করতে পারিনি বের হবার। বাদ মাগরিব যখন গন্তব্যে ফিরছিলাম, বিষন্ন মনে শুধু ভাবি, আমাদের তো গন্তব্য আছে, ফেরার জায়গা আছে কিন্তু ফিলিস্তিনে ভাই বোনদের গন্তব্য কোথায়?, ধ্বংসস্তুপে পরিণত তাদের বসতভিটা, প্রতিনিয়ত স্বজনহারা মানুষের চিৎকারে গাযযার আকাশ বাতাস ভারি হচ্ছে।
হে আল্লাহ, আপনি সহায় হোন। রক্ষা করুন আমাদের নির্যাতিত ভাই-বোনদের।