২০২১-২২ ইংরেজি শিক্ষাবর্ষে উচ্চতর ইসলামী আইন ও গবেষণা (ইফতা) কমপ্লিট করার পর দেশের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিজেদের জায়গায় একটি প্রাইভেট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছি। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে তৃতীয় বছরের শুরুতে বর্তমানে মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা ১২০। নূরানী বিভাগ ও কিতাব বিভাগের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দিলেও হেফজ বিভাগের পরিপূর্ণ জিম্মাদারী আমার কাছে রেখেছি।
শৈশবে হেফজ শেষ করার পর থেকেই আশা ছিল, পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে একটা হেফজখানার জিম্মাদারি পালন করব । এর পিছনে কারণ ছিল নিজের ইয়াদ মজবুত করা এবং কোরআনের খেদমতের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা। আল্লাহ তাআলা আমার মনের আশা কবুল করেছেন।
এক বছর পূর্বের কথা । আমার প্রতিষ্ঠানের হেফজ বিভাগে আমাদের গ্রামের আব্দুল হাকিম নামে ভর্তি হয়, মেধা ভালো হওয়ায় অল্প কিছুদিনের তাকে হেফজ করার জন্য অনুমতি দিলাম। ছেলেটি তিন মাসের মাথায় তিন পারা মুখস্থ করে ফেলল। ভারি খুশি হলাম।
আল্লাহর মর্জি, চতুর্থ পারা শুরু করার পরে ছেলেটি হঠাৎ ঠান্ডা সর্দি রোগে আক্রান্ত হল। তার পরিবার আমার কাছে জানাল, আমাদের ছেলে অসুস্থ । তাকে যেন রাত্রিতে বাড়িতে থাকার জন্য ছুটি দেওয়া হয়।
ছেলেটির মধ্যে ভাল কিছু করার সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছিলাম। তাই অনুমতি দেইনি। তার পরিবার বলে পাঠাল , ছেলে যদি সুস্থ যদি না থাকে তাহলে পড়বে কিভাবে ? আগে ছেলের সুস্থতা প্রয়োজন। জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক পড়ালেখা করতে পারবে।
কথায় যুক্তি আছে বটে। তবে আমি শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মতিগতি বুঝতে পারি। দের কথায় সায় দিতে মন চাচ্ছিল না। এমন অনেক কথা বলে আমার কাছ থেকে রাত্রে বাড়িতে থাকার অনুমতি নিয়ে নেই।
কয়েকদিন ফজরের আগেই তার পিতা তাকে মাদ্রাসায় রেখে যায় , কয়েকদিন যাওয়ার পরে সকালে ঘুমের ছুটিতে মাদ্রাসায় এসে ঘুমাই ঘুম থেকে উঠে একটু পড়ালেখা করে খাবার খাইতে যাই খাবার খেয়ে এসে বিকালে আসর পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও কোন পড়াই ঠিকমতো দিতে পারে না, নতুন পড়া পিছনের পড়া কোনটাই না।
তার এই অবস্থার কথা পরিবারের কাছে জানালে তার পিতা বলে ছেলে সুস্থ হইলে সব পড়া ঠিক করে নেবে, কিছুদিন পরে ছেলে সুস্থ হয়ে যায় ঠিকই কিন্তু তার পিছনের পড়া সম্পূর্ণ ভুলে যায়। আমি নিদারুণ কষ্ট পেলাম।
তারপরে পুনরায় মাদ্রাসার নিয়মে মাদ্রাসায় থাকা শুরু করে কিন্তু পড়ালেখায় মন বসে না, যে ছেলে মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করত সেই ছেলে পড়তে বসে কোরআন সামনে নিয়ে কোথায় হারিয়ে যায় বিভিন্ন দূশচিন্তাই মগ্ন হয়ে যায়। বাড়িতে গেলে আসতে চায় না সারাদিন চলে যায় মাদ্রাসায় আসে না। বিরক্তিকর ব্যাপার।
তার ব্যাপারে বাড়িতে জানালে বাবা বলে ছোট মানুষ জোরাজরি করবেন না তার ইচ্ছায় একটু চলতে দেন, পর্যাপ্ত পড়ালেখার বয়স আছে এখন তো একটু দুষ্টামি করবেই,এমন সব কথা বলে। ছেলে ও সাহস পেয়ে যায়।
পড়ালেখা ভালো লাগে না অসুস্থতার কথা বলে বাসায় থেকে যায়, আমি একদিন তারে পাশে রেখে লম্বা সময় বুঝলাম অনেক কিছুই বললাম। ভাবলাম, ছেলেটি ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু দুপুরের খাবারের ছুটিতে বাসায় গিয়ে আর আসলো না, পরের দিন ঘুমের সময় আসলো মাদ্রাসায়।
চতুর্থ পাড়া এখনো শেষ হলো না চার মাস অতিক্রম করল, এই চার মাসে আরো চার পারা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু এই পারায় শেষ হলো না, যারা তারা অনেক পিছে ছিল তারা তার থেকে অনেক এগিয়ে যায় দ্বিধায় তার মনোবল আরো দুর্বল হয়ে যায়, দেখতে দেখতে রমজান মাস চলে এলো আমি তারে বললাম পিছনে যা করেছ একটা লম্বা সময় পেয়েছ এই সময়ের মধ্যে তোমার পিছনের পড়া সম্পূর্ণ মজবুত করে ঈদের পর থেকে আবার নতুন পড়া শুরু করবা।
তারপরে একদিন পিছনের পড়া ৫ পৃষ্ঠা শুনাইলেও সম্পূর্ণ রমজান মাসে আর একদিনও পড়াশোনায় নাই, পড়া নিয়ে ডাকলে বলে ইয়াদ হয়নি একটু শাসন করলে বাড়ি থেকে খবর আসে রমজান মাসে রোজা রাখতেছে ছেলেরে চাপ দিবেন না। ঈদের ছুটি হয়ে গেল মাদ্রাসা খোলার এক সপ্তাহ পরে এসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে বলল হুজুর আমি আর হেফযখানায় পড়বো না আমার পড়া মনে থাকে না, পিছনের পড়া সব ভুলে গেছি এই অবস্থায় আমাকে কিতাব বিভাগে ভর্তি করায় দিন।
আফসোস হলে ও নিরুপায় হয়ে তাকে কিতাব বিভাগে ভর্তি করলাম যাতে করে সে লাইনচ্যুত না হয়। তবে নিজের অভিজ্ঞতায় দেখলাম চোখের সামনে একটা মেধাবী ছাত্র কিভাবে দুর্বল হয়ে যায় তার হাফেজ হওয়ার স্বপ্ন নিমিষে শেষ হয়ে গেল, তার পিতা-মাতার হাফেজের পিতা-মাতা হওয়ার সৌভাগ্যতা কিভাবে নষ্ট হয়ে গেল।
শেষ ফলাফল কী ?
এখন তার বাবা আমার কাছে এসে দুঃখ প্রকাশ করে, যেভাবে ছেলের কথামতো তারা চলেছেন , একদম উচিত হয়নি। ছেলে নষ্ট হওয়ার জন্য তারা নিজেরাই নিজেদেরকে দোষী সাব্যস্ত করছেন বারবার।
পিতা মাতার উচিত, সন্তানের পড়ালেখার ব্যাপারে শিক্ষকের দিকনির্দেশনা মেনে চলা। সন্তানের কথামত চললে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়, আল্লাহ পাক সকল অভিভাবককে এই সত্যটি বোঝার তাওফিক দান করুন।