রমজানের শেষ দিককার এক ভোর। ঈদের ছুটিতে শশুরবাড়ির পথে রওনা দিয়েছি। কুমিল্লার সীমানায় পৌঁছে যাত্রাবিরতি দিল একটি হোটেলের সামনে। চিরচেনা জায়গা— হোটেল নুরজাহান। এই হোটেলের নাম শুনলেই যাত্রীদের মুখে বিরহের সুর: “গলার রগ দিয়ে টাকা টানে রে ভাই!” “ডাকাত হোটেল একখান!”
সবার কথায় এই হোটেল যেন যাত্রীদের চরম দুঃখ-বেদনার প্রতীক! দাম বেশি, খাবার কম, যাচ্ছেতাই ব্যবহার । আমারও স্মৃতি খুব সুখকর না।
কয়েক বছর আগে এখানে তেহারি খেতে বসেছিলাম। দাম ছিল প্রায় ৩৫০-৪০০ টাকা, কিন্তু প্লেটটা দেখে মনে হলো— যেন শিশুর ডায়েট প্ল্যান!
এক্সট্রা রাইস চেয়েছিলাম, বলেছিলাম টাকাও দিবো। ওয়েটারের মুখ দেখে মনে হয়েছিল যেন আমি মহা অপরাধ করে ফেলেছি। বলল, “স্যার, এমন কোনো সিস্টেম আমাদের নেই। এক্সট্রা কিছু লাগলে নতুন অর্ডার করতে হবে।”
এই স্মৃতি পুশে রেখেছিলাম সুতরাং আজকে যখন নামছি, মুখে একরাশ বিরক্তি। কিন্তু সেহেরির সময় হয়ে গেছে। খিদে ছিল প্রচণ্ড। তাই বেশি না ভেবে একটা ভুনা খিচুড়ি অর্ডার করে বসলাম। তখনই ঘটে গেল সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
মাইকে ঘোষণা— “সেহেরির বিশেষ অফার: যারা খাচ্ছেন, তারা চাইলে এক্সট্রা রাইস ও ডাল নিতে পারবেন, কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।” আমি তো হতভম্ব! এই ঘোষণা কি সত্যি নাকি আমার কানে সমস্যা?
আস্তে করে ওয়েটারকে ডেকে বললাম, “ভাই, এক্সট্রা খিচুড়ির রাইস দেয়া যাবে?” সে মাথা নাড়ল এবং একটু পর দুই বাটি গরম রাইস, তাজা সালাদ আর লাল ডাল নিয়ে ফিরে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এইগুলার দাম?” ওয়েটার ছোকরা হেসে বলল, “না স্যার, আজ সেহেরির স্পেশাল অফার। কিছু লাগবে না।”
হোটেল নুরজাহানের এমন ব্যবহার এমন উদারতা দেখে অবাক হলাম। এই কি সেই হোটেল নুরজাহান? চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ নিয়ে খেতে খেতে ভাবছিলাম— মানুষ কি আসলেই বদলাতে পারে? একসময় যারা এক চামচ রাইসও বাড়তি দিত না, আজ তারা ডাল-ভাত-সালাদ একসাথে দিচ্ছে ফ্রিতে!
হয়তো রমজান মানুষকে বদলে দেয়। হোটেল মালিক হয়তো বুঝেছেন, মানুষকে খুশি করলে আল্লাহও খুশি হন।
আমার জন্য এটা ছিল শুধু একটা খাবারের অভিজ্ঞতা না— এটা ছিল মানবিকতার, পরিবর্তনের আর রমজানের বরকতের এক নিদর্শন।
হোটেল নুরজাহান, তুমি হয়তো এখনও দাম একটু বেশি রাখো, কিন্তু সেদিনের বদান্যতা দিল মন ছুঁয়ে গেছে। তোমাদের কল্যাণ হোক।