Home মুক্ত গদ্যরোজনামচা । মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে

রোজনামচা । মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে

by MD JUNAYED SHEIKH
রোজনামচা । মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে

২০১১ সাল। তখন হিফজখানায় পড়ি। কোরআন শরীফের বিশ পারা মুখস্ত হয়েছে। আমার হুজুর বললেন, সম্পূর্ণ পড়াটা একবার রিভিশন দিয়ে তারপর সামনে আগাও। হুজুরের পরামর্শ মেনে পিছনের পড়া রিভিশন দেয়া শুরু করলাম। রমজান চলে এলো। রোজার পর মাদ্রাসায় ভর্তি শুরু হয়েছে। আমাদের মাদারিসিল কওমিয়াহর নতুন শিক্ষাবর্ষ রমজানের পর থেকে।

ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম- আমার প্রিয় ওস্তাদকে কিতাব বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরপর তো কিছুতেই আমার মন বসে না। হুজুর আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাদ্রাসায় সকালের নাস্তায় যেদিন আলু ভর্তা দিত সেদিন আমি খেতে পারতাম না। তিনিও খেতে পারতেন না। বিষয়টি লক্ষ্য করে পরবর্তীতে নিয়মিত আলু ভর্তার দিন আমাকে হোটেলে নিয়ে নাস্তা করতেন। মাঝেমধ্যে বিকেলে আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য দশ টাকা করে দিতেন। এমন একজন শিক্ষককে হারিয়ে আমি তখন পাগল প্রায় অবস্থা।

সারাদিন মনমরা হয়ে থাকি। বিকাল হলে খাচাছুট পাখির মত উড়াল দিয়ে হুজুরের রুমে যাই। গিয়ে কান্নাকাটি করি। অবুঝ হয়ে বলি, “হুজুর , যে করেই হোক। আপনি প্রিন্সিপালের কাছে আবেদন করে হিফজ খানায় চলে আসুন”। কিন্তু আমার এই দাবি যে শুধুই পাগলের প্রলাপ সেটা বুঝতে বেশিদিন সময় লাগেনি। বুঝতে পারি হুজুর ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই।

তখন আমিও জিদ ধরি , এই মাদ্রাসায় আর পড়বো না।

অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করাই – যেন আমাকে অন্য কোথাও ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে আমাকে নতুন মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলো। ভেবেছিলাম নতুন পরিবেশে গিয়ে পিছনের মায়া ভুলে যেতে পারবো। কিন্তু হলো ঠিক তার উল্টো।

নতুন পরিবেশ, অচেনা কতগুলো মানুষ, তার ওপর বছরের কিছু দিন কেটে যাওয়ার পর এখানে এসেছি। তাই সবাই কেমন সন্দেহ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে। আগের মাদ্রাসায় কোন কান্ড ঘটিয়ে এসেছি কিনা সেটা জানতে চেষ্টা করে।

সবকিছু মিলিয়ে আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। এখন তো বাবাকেও বলতে পারি না যে আমাকে আগের মাদ্রাসায় নিয়ে যাও। সেখানে অন্তত বিকাল বেলা হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ হতো। ঠিক করলাম। শত কষ্ট হলেও আমি এখানে মানিয়ে নেব।

একদিনের কথা। নতুন মাদ্রাসায় রুটিন ছিলো সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত মাশক তথা সহিহ তিলাওয়াতের প্রশিক্ষণ করা। কিন্তু প্রতিদিন এই সময় নিয়ম করে আমার ঘুম চলে আসে। হাজার চেষ্টা করেও ঘুম দূর করতে পারিনা। ঠিক ওই সময়ে ঘুম যেন বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত আমার চোখে এসে ভর করে। ঐদিন খুব বেশিই ঘুম চলে আসলো ।

হুজুর বারবার রাগান্বিত হয়ে আমাকে দেখছিলো। পাশে থাকা বন্ধু বারবার কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি ঝিমুতেই থাকি। এক পর্যায়ে হুজুর বেত হাতে নিয়ে উঠে এসে আমাকে রামধোলাই দিতে শুরু করে ।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার উপর বিরাট এক ঝড় বয়ে গেল। এমনিতেই মনের অবস্থা তখন খারাপ। তার উপর এমন ক্যালানি খেয়ে আমি ঠিক করলাম আজই মাদ্রাসা থেকে পালাবো। যেই ভাবা সেই কাজ।

সুযোগ খুঁজছি কখন পালানোর আদর্শ সময়। ভেবে ঠিক করলাম, যোহরের নামাজ পড়তে সবাই যখন মসজিদে যাবে- তখনই কাজটা সেরে ফেলবো । আমাদের মাদ্রাসার ভিতর দিয়েই মসজিদে যাতায়াতের ব্যবস্থা। তাই মসজিদে যেতে জুতোর প্রয়োজন হয় না। এমতাবস্থায় আমি জুতা নিয়ে মসজিদে গেলে সবাই সন্দেহ করবে। তাই আমিও জুতা ছাড়াই মসজিদে গেলাম।

সবার পেছনের কাতারে নামাজে দাঁড়ালাম। ইমাম সাহেব যখন সেজদায় গেল- অমনি আমি উঠে পিছন দিয়ে খালি পায়েই দিলাম ভো দৌঁড়। অনেকক্ষণ দৌঁড়িয়ে একটা রিক্সা নিলাম। তারপর বাসার কিছু রাস্তা আগে নেমে পড়লাম।

আমার ধারণা ছিল বাবা হয়তো আজকে অন্যদিনের মতোই বাইরে আছেন। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ওই তো বাবাকে দেখা যাচ্ছে । মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসার দিকে আসছেন। বাবার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে পা ফেলছি । ঠিক এমন সময় কখন যে জ্বলন্ত সিগারেটের উপর পা দিয়েছি বুঝতেই পারলাম না। পা টা এই মুহূর্তে জ্বলে যাচ্ছে। কোন রকম পা টিপে টিপে বাবার কাছে গেলাম।

তিনি আমাকে একবার আপাতমস্তক দেখেই বুঝে ফেললেন আমি কী কান্ড করেছি। তিনি শান্ত গলায় বললেন “বাসায় চলো” । আমিও সুবোধ বালকের মত বাবাকে অনুসরণ করে এগোচ্ছি। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই বুঝতে পারছি না যে আমার সাথে কী ঘটতে যাচ্ছে।
বাসায় এসে বাবা মাকে বললেন “ভাত দাও”।
মা বড় থালায় করে খাবার আনলেন।

দস্তরখানায় যখন আমি বাবা-মা আর ছোটবোন খেতে বসলাম। খাবারের আইটেম দেখি- শুধু ভর্তা, ভাজি আর ডাল। মাছ মাংসের কোন বালাই নেই। সেদিনই আমি ছোট বোনের কাছে প্রথম জানতে পারি , আমি মাদ্রাসায় থাকলে বাসায় তেমন ভালো কোন খাবার রান্না হয় না। আমি ছুটিতে বাসায় আসলেই শুধু ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়। অন্যদিন ছোটবোন ভালো কিছু খেতে চাইলেও বাবা বলেন, “তোমার ভাইয়া যেদিন বাসায় আসবে সেদিন ওইটা খেও”।

সে যাই হোক। আমার ধারণা ছিল, বাবা আমার পালিয়ে আসার কারণ জানতে চাইবেন। আর সেই সুযোগে আমিও আরও দশটা কথা বাড়িয়ে বললে তিনি আমাকে ওই মাদ্রাসা থেকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু বাবা সেটা করলেন না। খাবার শেষ করে বাবা বললেন “মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হও”। আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কিন্তু কি আর করা,, আদেশ অমান্য করলে তো আর রক্ষা নেই। আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে বাবার সাথে মাদ্রাসার পথ ধরলাম।

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment