অসুস্থতায় ভুগছি দীর্ঘদিন। জলের মতো অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। বিদেশের মাটিতে পা রাখলেই হাড়ে হাড়ে অনুমিত হয় দেশের কদর।
বাংলাদেশে সব কিছুই থাকে হাতের মুঠোয়। শিক্ষা, চিকিৎসাতো বটেই, ফলমূল থেকে শুরু করে নানান শাকসবজিতে সহজ লভ্যতাও অনিন্দ্য সত্য। কৃষির সোনালী আভা বাংলাতেই সুন্দর। বিশেষ করে সুস্বাদু ফলমূলের বাহারি অন্য দেশে খুবই কম। হরেক রকমের মাছের সমৃদ্ধ বাংলার নদ-নদীর গৌরব। ইলিশের সিংহভাগের উৎপাদন এই দেশের কোলেই। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন মান আল্লাহ প্রদত্ত। এই দেশের আবহাওয়াও অসাধারণ। শরীর নুয়ে পড়ে না কাপড়ের গাট্টির ভারে। বিপরীতে কিরগিজস্তানে এসে মুখোমুখি হয়েছি বড় ধরণের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের।
মখমল স্বচ্ছতার জীবন রেখে প্রতিনিয়ত খাতা কলমের ব্যাগ পিঠে দৌড়াতে হয় ভার্সিটির পথে। দেশের একজন শিক্ষক ও এক্সিকিউটিভ অফিসার পদবী বদলে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি ভার্সিটি পড়ুয়া হিসেবে। তথ্য বিভ্রাটের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে যাচ্ছিল নিজের স্বপ্ন, সম্বল ও সম্মান। মনস্থির করি দেশে ফেরার।
সকল খরচের হাত থেকে স্থানীয় কিরগিজদের ভালোবাসা আগলে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু নুয়ে পড়ছিলাম টিউশন ফির ভারে। দুষ্টু মানুষের মিষ্টি কথায় বড়ো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল আমার জন্য হয়তো। কিন্তু খোদার লীলা বুঝা খুবই দায়।
দেশে ফেরার প্রস্তুতি মোটামোটি সম্পন্ন। পরামর্শের জন্য ছুটে গেলাম এক বড়ো ভাইয়ের নিকট। স্যার হিসেবেই সম্বোধন করি যাকে। এখানে আমাদের অভিভাবক বলতেই একমাত্র তিনিই। নেতৃত্বে নিজের দেশের কেউ একজন থাকা যে কতটা নেয়ামত তা বুঝানো বড়ই মুশকিল।
অবশ্যি দুষ্টু প্রকৃতির হলে জীবন এখানেই থেমে যেতে হয় সহসায়। ক্ষমতার অপব্যবহার পারে দুর্বিষহ করে তুলতে একটা জাতির জীবনকে। বরফের মাটিতে এই তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে আমার।
গঠনমূলক পরামর্শে নতুন করে প্রাণ ফিরে পাই সেদিন। টাকার মোহে দাম্ভিক হয় না সবাই, এই জলজ্যান্ত উপমা আমাদের নাজমুল স্যার। সকল কিছুর মাঝেও তার বিশালতা ফুটে ওঠে অজান্তেই। আমাদের এক ছাত্র ভাই টালবাহানা করছিলো টিউশন ফি নিয়ে। জঘন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলো ওয়াদা খেলাপীর। যে কারুর মন মেজাজ বিগড়ানোর মতোই। আজ না কাল করে করেই পার করছিলো মাসের পর মাস। সবার সামনে স্যার তুমুল ভাবেই ঝেড়ে রুম থেকে বের করে দেন তাকে। চুপচাপ নিরবতা বিরাজমান তখন অফিস রুমে। নিরবতা ভেঙ্গে স্যার বলছিলেন, ছেলেটার সত্যিকারের সমস্যা থাকলে আমি অবশ্যই হেল্প করতাম।
২.
প্রবাস জীবনে একটু সান্ত্বনাও মরুর বুকে কাঠফাঁটা রোদে এক অফুরন্ত শীতল পানির দেখা। কিরগিজস্তানে আসার পর ৪/৫ মাস না যেতেই যখন টের পেলাম পায়ের নিচের মাটি সরতে যাচ্ছে। শক্ত করে ভর দিয়ে জমিনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। নিকষ কালো অন্ধকারের পথে পা ফেলতে পারছিলাম না।
তখনই নাজমুল স্যার এক মশাল নিয়ে আমাকে আলো দেখায়। সাহস যুগায় পরম আপন মনে। আমি যেনো তাঁরই অনুজ সহোদর। মনোবল সঞ্চার করে বুক টান করে ঘুরে দাঁড়াই। পড়োশোনায় মনোনিবেশ করি।
এই হঠাৎ প্রবাস জীবনে বড় ধরনের অসুস্থতায় পড়েছি। যার দরুন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছি। এইদিকে রানিং ইনকাম না থাকায় ফ্যামিলির পেরেশানি ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলছে প্রতিনিয়ত। ভিসা নেই, এমনকি প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দরকারি পাসপোর্টটা নেই হাতের কাছে। পাসপোর্ট চাওয়ার পরেও কিছু ভাই অযথা টালবাহানা করছিল। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যায় অসুস্থতায়।
ডাক্তার বললেন, কিডনি ও লিভারে একটু সমস্যা হয়তো। ব্লাড টেস্টসহ অন্যান্য রিপোর্ট ভালোই। তবুও অসুস্থতা আমাকে তাড়া দিচ্ছিল। লজ্জায় তাঁর সামনে যেতেও সাহস পাই খুব কমই। তবুও চতুর্দিকের আনাড়ি বেষ্টনীর ঈষৎ অসহযোগিতার দেয়াল ভেঙ্গে কল দিই স্যারকে।
হৃদয়ের বিশালতার একটুও কমতি ছিলো না বিন্দুমাত্রও । অনেকগুলো পরামর্শ পেলাম। নিবু নিবু প্রাণ পুনরুজ্জীবিত হয়। টাকা ও পদ থাকলে সবাই অমানুষ হয় না। নিরিহ পথিক আহত হয় কঞ্চির গুতায়। কিন্তু দোষ পড়ে বাঁশ বাগানের। প্রবাদে আছে “বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়ো”।