তামীমুল ইসলাম ফরিদী
মানবজীবনের অগ্রগতির পেছনে যে দুটি অপরিহার্য চালিকা শক্তি কাজ করে, তা হলো স্বপ্ন ও শক্তি। ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে, সমাজ পরিবর্তনের প্রতিটি অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই — কেউ না কেউ স্বপ্ন দেখেছিল, আর সেই স্বপ্ন পূরণের শক্তি তার মধ্যে ছিল।
আজকের এই সভ্যতা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য — সবই কোনো এক সময়ে কারো কল্পনায় জন্ম নেওয়া স্বপ্নের বাস্তব রূপ। এবং ইসলামেও স্বপ্ন ও শক্তির ব্যাপারে রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। তাই বলা যায়, যেখানে স্বপ্ন ছিল, সেখানে শক্তি ছিল; আর যেখানে এই দুইয়ের মিলন হয়েছে, সেখানেই সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। ইসলামের আলোকে স্বপ্ন ও শক্তির গুরুত্ব: ইসলামে স্বপ্ন (উচ্চাকাঙ্ক্ষা) ও শক্তি (পরিশ্রম ও দৃঢ়তা) উভয়কেই মানবজীবনের উন্নতির জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখা হয়েছে।
১. ইসলামে স্বপ্ন বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন: “আর তুমি তোমার প্রভুর অনুগ্রহ কামনা করো এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা রাখো।” (সূরা আদ-দুহা, ৯৩:১১) রাসূল (সা.)-ও সর্বদা উম্মতকে বড় স্বপ্ন দেখার ও আল্লাহর কাছে উচ্চ মাকাম চাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে: “যখন তোমরা আল্লাহর নিকট জান্নাত চাইবে, তখন জান্নাতুল ফিরদাউস চাইবে।” (বুখারী: ২৭৯০) এটি প্রমাণ করে, ইসলামে মহান লক্ষ্য স্থির করা এবং বড় স্বপ্ন দেখাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
২. ইসলামে শক্তি বা প্রচেষ্টা: এ ব্যাপারে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে: “মানুষের জন্য ততটুকুই আছে, যতটুকু সে চেষ্টা করে।” (সূরা নাজম, ৫৩:৩৯) আর রাসূলে কারীম (সা.) বলেছেন: “বলিষ্ঠ মুমিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মুমিনের চেয়ে অধিক প্রিয় ও সম্মানিত।” (মুসলিম: ২৬৬৪) এখানে “বলিষ্ঠ” বলতে শুধু শারীরিক বল নয়, বরং মানসিক, আত্মিক এবং ইচ্ছাশক্তিতেও বলিষ্ঠ হওয়া বোঝানো হয়েছে।
স্বপ্ন: সম্ভাবনার সূচনা
স্বপ্ন কেবল রাতের ঘুমের গল্প নয়; এটি মানুষের চিন্তার গভীরতম আকাঙ্ক্ষা, এক ধরনের মানসিক প্রতিশ্রুতি, যা তাকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। স্বপ্ন মানুষকে তার সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে সম্ভাবনার দিগন্তে নিয়ে যায়। একজন শিশু যখন ভবিষ্যতে একজন বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখনই তার ভেতর জন্ম নেয় এক নতুন শক্তি — জানার, শেখার, এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। কাজেই স্বপ্ন হলো সম্ভাবনার বীজ, যা পরিশ্রমের জলসিঞ্চনে মহীরুহে পরিণত হয়।
শক্তি: স্বপ্ন বাস্তবায়নের হাতিয়ার
শক্তি ছাড়া স্বপ্ন অলীক কল্পনা হয়ে থেকে যায়। বাস্তব জীবন সংগ্রামে প্রতিটি পদক্ষেপে চ্যালেঞ্জ আসে, আসে ব্যর্থতা, আসে হতাশা। তখন এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন মানসিক দৃঢ়তা, সহিষ্ণুতা এবং ক্রমাগত প্রচেষ্টার শক্তি। উদাহরণস্বরূপ, টমাস আলভা এডিসন হাজারবার ব্যর্থ হয়েও বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের স্বপ্ন ছাড়েননি, কারণ তার ভেতরে ছিল অপরিসীম শক্তি ও অটল বিশ্বাস। তাই বলা যায়, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে শক্তির ধারাবাহিক প্রয়োগ অপরিহার্য।
স্বপ্ন ও শক্তির পারস্পরিক সম্পর্ক
স্বপ্ন ও শক্তি একে অপরের পরিপূরক। স্বপ্ন পথ দেখায়, শক্তি সেই পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। যদি স্বপ্ন থাকে কিন্তু শক্তির অভাব হয়, তবে তা ভঙ্গুর হয়; আবার শক্তি থাকলেও যদি সুস্পষ্ট স্বপ্ন না থাকে, তবে তা দিশাহীন পরিশ্রমে রূপ নেয়। সৃষ্টিশীলতা, উন্নতি এবং আত্মসম্মান — সবকিছুর মূলে রয়েছে এই দুইয়ের সঠিক সমন্বয়। যেমন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন বাংলাদেশের, আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছিল তার অপরিসীম শক্তি ও সংগ্রামী মনোবল।
ব্যক্তি ও সমাজে স্বপ্ন ও শক্তির ভূমিকা
স্বপ্ন ও শক্তি শুধু ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য নয়, সামষ্টিক অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য। একটি জাতি তখনই উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকরা ব্যক্তিগত স্বপ্নের পাশাপাশি জাতীয় স্বপ্নকে ধারণ করে এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ — এসবই ছিল একটি জাতীয় স্বপ্নের ফল, যা শক্তির দৃঢ় প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, মানুষের ইতিহাস মানেই হলো স্বপ্ন ও শক্তির এক অনুপম মহাকাব্য। যারা স্বপ্ন দেখে এবং তাদের ভেতরের শক্তিকে কাজে লাগাতে জানে, তারাই ভবিষ্যতের নির্মাতা হয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের ভেতরের স্বপ্নকে জাগ্রত রাখা এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য নিরবচ্ছিন্ন শক্তি ও সাহসের সাথে পথ চলা। মনে রাখতে হবে, “স্বপ্ন ছিল বলেই শক্তি জন্মেছিল, আর শক্তি ছিল বলেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল।”
লেখক: প্রিন্সিপাল, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও সু-বক্তা।