মূল | ডেভিড হার্স্ট
তরজমা | মুহাম্মাদ হাসিবুল হাসান
গাজার ধ্বংসস্তূপে জন্ম নিচ্ছে অমিত প্রতিরোধ
গাজা—একটি নাম, যা আজ পৃথিবীর যন্ত্রণার মানচিত্রে সবচেয়ে দগ্ধ ক্ষত। এখন আর একে শুধু ভূখণ্ড বা বন্দিশিবির বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি হয়ে উঠেছে নির্যাতনের প্রেক্ষাপট, অবিচারের প্রহরগণনা, আর মানব ইতিহাসের এক করুণতম অধ্যায়।
ইসরায়েলের কিছু অংশ, বিশেষ করে তেল আবিবের পশ্চিমাপন্থী সমাজ, নিজেদের ছোট্ট আরামদায়ক বুদ্বুদে বাস করছে—ক্যাপুচিনোর সুবাসে, যোগব্যায়ামের ক্লাসে। তাদের কাছে গাজার কান্না যেন অশ্রুত শব্দ। অথচ তাদের অদূরেই চলছে এমন এক হত্যাযজ্ঞ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী কদাচিৎ দেখেছে—রুয়ান্ডা, স্রেব্রেনিৎসার বিভীষিকার স্মৃতিও আজ যেন ম্লান।
এমন নির্মম বাস্তবতায়ও ইসরায়েলের ধারণা, হয়তো চাপের মুখে হামাস মাথানত করবে। কিন্তু ১৮ মাসের লাগাতার যুদ্ধ, অবরোধ আর অনাহারের বিভীষিকাও তাদের প্রতিরোধের অঙ্গীকারকে দমাতে পারেনি। হামাস আজও বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নেতানিয়াহু ও তার নেতৃত্ব হয়তো এখনও বোঝেননি—কী ভয়ংকর ভুল ধারণা নিয়ে তারা এই লড়াই শুরু করেছিলেন।
ইসরায়েলের সাম্প্রতিক প্রস্তাব—৪৫ দিনের খাদ্য ও পানি সরবরাহের বিনিময়ে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ—প্রকৃতপক্ষে এক পক্ষীয় আত্মসমর্পণের আহ্বান।
হামাসের জবাব ছিল সুস্পষ্ট: তারা বন্দিমুক্তির বিনিময়ে শুধু ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি ও একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চায়। তবে অস্ত্রসমর্পণ নয়, দখলদার বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রস্থান চায়।
কেন আত্মসমর্পণ নয়?
হামাসের অনমনীয়তার পেছনে লুকিয়ে আছে রক্তাক্ত কিন্তু দুর্জয় আত্মমর্যাদা। ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণে হামাসের প্রশাসন, হাসপাতাল, অবকাঠামো প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত। একের পর এক শহর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। তবুও, কেউ পিছু হটছে না। নির্বাসনের প্রস্তাব, অর্থের মোহ—কোনো কিছুই আজ গাজার প্রতিরোধীদের টলাতে পারছে না।
ইতিহাসে আমরা দেখেছি, সংকটে পড়ে কত নেতা পালিয়ে গেছেন। ইয়াসির আরাফাতের পিএলও একসময় নিরাপত্তা খুঁজেছিল দূরদেশে। ফাতাহও অস্ত্র নামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজকের গাজা ভিন্ন।
৭ অক্টোবরের ঘটনার পর গোটা গাজা এক পবিত্র ভূমিতে পরিণত হয়েছে—প্রত্যেক পরিবারের হারানো সন্তান, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর, প্রত্যেক শহীদের রক্ত যেন গাজার প্রতিরোধকে শিকড়ের মতো মাটির গভীরে গেঁথে দিয়েছে।
প্রতিরোধ আজ কেবল হামাসের নয়—এটি গাজার প্রতিটি মানুষের লড়াই। ইসরায়েলের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা তাদের ভেঙে দেয়নি, বরং জাগিয়ে তুলেছে অমিত বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।
জমিনের প্রতিটি কণা আজ প্রতিধ্বনিত করে—এই সংগ্রাম অস্তিত্বের, স্বাধীনতার, আর মানব মর্যাদার।
গাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেই জন্ম নিচ্ছে এক অবিনাশী অঙ্গীকার—জীবনের জয়গান। এ যাত্রা দীর্ঘ, রক্তাক্ত ও কঠিন; তবু প্রতিরোধের এই সুর থামার নয়।
ইসরায়েলের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’: একটি জাতির নিঃশেষীকরণের সংকল্প
ইসরায়েল কেবল জমি বা নিয়ন্ত্রণ চায়—এমন সরল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের প্রকৃত অভিলাষ বোঝা সম্ভব নয়। তারা চায় একচ্ছত্র আধিপত্য—ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে অন্য সব জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করে একটি একক ধর্মীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
এই প্রবণতা এতটাই সুস্পষ্ট যে, ইস্টার সানডের শান্ত প্রার্থনাতেও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ইহুদি রাষ্ট্রের নিপীড়ন থেকে নিস্তার পায় না। মুসলিম কিংবা খ্রিষ্টান—সব ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতি রয়েছে একইরকম দখলদার মনোভাব।
ইসরায়েলের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়: শান্তির চুক্তি কখনোই তাদের দখল-পিপাসাকে সংযত করেনি।
বস্তুত, যুদ্ধের সময়ের তুলনায় শান্তির সময়েই তাদের বসতি স্থাপনের গতি বেড়েছে আরও বহুগুণ। অসলো চুক্তির পর পশ্চিম তীরে যেভাবে দখলদারি বসতি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল শান্তিচুক্তির ওপর প্রকাশ্য আঘাত।
ইসরায়েলের গভীরে কখনোই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রতি কোনো আনুগত্য ছিল না। প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিয়নের স্বপ্ন ছিল একক ইহুদি রাষ্ট্র গঠন, আর আজ নেতানিয়াহু, ইতামার বেন গভির ও বেজালেল স্মোত্রিচ সেই স্বপ্নকেই নির্মমভাবে বাস্তবায়ন করছেন। তাদের ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ হচ্ছে—ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণভাবে উপড়ে ফেলা, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা। ডেভিড বেন গুরিয়ন যে নির্যাতন শুরু করেছিলেন, আজকের ইসরায়েল সরকার তারই চূড়ান্ত রূপ দিচ্ছে।
এ মুহূর্তে যদি হামাস আত্মসমর্পণ করে, যদি গাজা নতিস্বীকার করে, তবে তা শুধু একটি দল বা একটি অঞ্চল নয়—পুরো ফিলিস্তিনি জাতির সংগ্রামের সমাপ্তি হবে। এটি এ জন্য নয় যে, ফিলিস্তিনিরা ধর্মান্ধ, কিংবা ফাতাহ তাদের মাঝে অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। বরং এ জন্য যে, এখন প্রতিরোধই ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গাজার অদম্য ঈমান
হামাস এবং ফাতাহ—দুই ফিলিস্তিনি সংগঠনের পথ আলাদা। এর অন্যতম কারণ, হামাস মূলত একটি ধর্মনির্ভর প্রতিরোধ সংগঠন। আল-আকসা মসজিদে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের অনুপ্রবেশের প্রতিক্রিয়ায় যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, এই যুদ্ধের সূচনা সেখান থেকেই। গাজার ফিলিস্তিনিরা আজ যে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার, তার অর্থ খুঁজতে তারা নিজেদের ধর্মীয় অনুভূতির দিকেই ফিরে যাচ্ছে, শক্তি সংগ্রহ করছে আধ্যাত্মিক উৎস থেকে।
হামাসের লক্ষ্য যে স্থির, তাদের যে শৃঙ্খলা ও দুর্নীতিমুক্ত অবস্থা, তার পেছনে রয়েছে সংগঠনের সম্মিলিত ইমান ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। এই নৈতিক শক্তিই আজ গাজাবাসীর হৃদয়ে সাহসের আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
২৩ বছর বয়সী প্যারামেডিক রিফাত রাদওয়ান তার নিজের মৃত্যুর মুহূর্ত ভিডিও করে গেছেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলেন যেন নিয়মিত নামাজ না পড়ার জন্য ক্ষমা পান। রাদওয়ান হয়তো খুব ধার্মিক ছিলেন না, হয়তো কোনো সংগঠনের সদস্যও ছিলেন না। তবু মৃত্যুশয্যায় তাঁর গভীর বিশ্বাস এবং ক্ষমা প্রার্থনা ফিলিস্তিনি জাতির ঈমানের এক অবিনাশী প্রতীক হয়ে উঠেছে। গাজার আকাশ ধ্বংস হতে পারে, ঘরবাড়ি মাটিতে মিশে যেতে পারে, কিন্তু গাজার ইমান ধ্বংস হবে না।
হামাসের আত্মসমর্পণ না করার পেছনে কেবল ধর্মীয় অনুভূতিই নয়, রয়েছে সুস্পষ্ট কৌশলগত বিবেচনাও। তামিল টাইগার বা চেচেন বিদ্রোহীদের মতো বিদ্রোহী সংগঠনগুলো বড় সামরিক শক্তির হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
কিন্তু হামাস মনে করে, তারা ইতোমধ্যে তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে— ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের সংগ্রামকে আবারও বিশ্ববাসীর বিবেকের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা।
পিউ রিসার্চের সর্বশেষ তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বর্তমানে ৫৩ শতাংশ মানুষ ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক মত পোষণ করে, যা ৭ অক্টোবরের আগের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও—যেখানে হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে—জনমত ক্রমেই ইসরায়েলের বিপক্ষে সরে যাচ্ছে। মানুষ ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবেই দেখছে, তবুও তারা ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বৈধতা মানতে নারাজ।
ইসরায়েল যদি মনে করে এই যুদ্ধ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে সমাপ্ত করা যাবে, তবে তারা বিভ্রান্ত। কারণ, দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অগ্নিশিখা আজ প্রতিটি ফিলিস্তিনির হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জ্বলে উঠেছে।
নেতানিয়াহুর এই রক্তাক্ত অভিযান যত দীর্ঘায়িত হবে, ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ততই ফিলিস্তিনের পক্ষে এগিয়ে আসবে। ফ্রান্সের মতো দেশ ইতোমধ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেছে।
এই যুদ্ধ কেবল গাজায় বোমাবর্ষণের লড়াই নয়—
এটি এক অবিনশ্বর জাতিসত্তা ও আত্মার সংগ্রাম,
যেখানে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বারবার পরাজিত হচ্ছে একটি অপরাজেয় ইমানের সামনে।
ইসরায়েল আজ গাজা, পশ্চিম তীর, জেরুজালেম এবং ইসরায়েলের ভেতরে থাকা প্রতিটি ফিলিস্তিনির ওপর যে দুর্বিষহ নির্যাতন চাপিয়েছে, তা এতটাই সর্বগ্রাসী যে, হামাসের ভাগ্য ও ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ এখন এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। প্রতিরোধ এখন আর কেবল প্রতিশোধের নয়—এটি বেঁচে থাকার লড়াই, একটি জাতির শেষ আশ্রয়।
লেখক পরিচিতি : ডেভিড হার্স্ট — মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক; মিডল ইস্ট আই থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত।