যখন করুণার অধিপতি, দয়ার সাগর, আমার রব—তাঁর কোনো অপরাধী, স্বার্থপর বান্দার প্রতি মেহেরবান হন, তখন তিনি তাকে নিজের রহমতের কোলে তুলে নেন—যেন এক মা, তার অবাধ্য সন্তানকে অশ্রুসিক্ত বুকে চেপে ধরেন, হাজার অপরাধ ভুলে, শুধু মায়ার টানে। তবে আমার আল্লাহ—তিনি তো সমস্ত মায়ার ঊর্ধ্বে, সমস্ত মেহেরবানির উৎস।
ঠিক তেমনই এক মেহেরবানির স্পর্শে, ২৬ মে ২০২৪, এক রবিবারের সকাল যেন এক সুশীতল স্বপ্ন হয়ে ধরা দিল। মনে হচ্ছিল—আকাশটা যেন আরও নীল, বাতাসটা যেন আরও কোমল, আর সূর্যটা যেন দুনিয়ার নয়, বরং বাইতুল্লাহর দিকে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। হৃদয় প্রার্থনায় ভরে উঠল: “হে আল্লাহ! এমন সকাল বারবার আমার কপালে জুটুক।”
আবেগে এতটাই আপ্লুত ছিলাম যে বুঝতেই পারছিলাম না, কোন কাজটি আগে করব—ল্যাগেজ গোছাব, না কি ডকুমেন্ট? দুপুর ১২টায় হাজী ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে, অথচ তখনো কিছুই গুছানো হয়নি। ঘড়ির প্রতিটি টিক টিক যেন হৃদয়ের গহীনে অপেক্ষার একেকটি ধ্বনি বাজাচ্ছিল—“কখন আমি বাইতুল্লাহর সেই মোবারক গিলাফ দেখি, আর কাঁপা কণ্ঠে বলি…” اللّٰهُمَّ زِدْ هٰذَا الْبَيْتَ تَشْرِيفًا وَتَعْظِيمًا وَتَكْرِيمًا وَمَهَابَةً…
হাজী ক্যাম্পে পৌঁছলাম। বিদায়ের মুহূর্ত—কাছের মানুষগুলোর অশ্রুসিক্ত চোখ আর দোয়ার কণ্ঠস্বর চারপাশ ঘিরে ধরল। কোনো শব্দের প্রয়োজন নেই, শুধু চোখের ভাষা বলছিল—”ফিরে এসো হে প্রিয়জন, আল্লাহ তোমার হজ কবুল করুন।” ৪৫ দিনের বিচ্ছেদ, যেন একেকটি দিন একেকটি বছর হয়ে উঠছে তাদের জন্য।
ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমরা অপেক্ষা করছিলাম বাসের জন্য, যা আমাদের নিয়ে যাবে বিমানবন্দরে। ঘড়িতে তখন বিকাল চারটা। হঠাৎ আনসার বাহিনীর একজন সাহেব ঘোষণা দিলেন—“সব হাজীগণ সিরিয়াল ধরুন, বাস এসে গেছে।”
মনে হল, এই ডাকে যেন ফেরেশতা নিজেই আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন বাইতুল্লাহর সফরে। প্রতিটি কদম যেন মাটি ছুঁয়ে, আকাশের দিকে উঠছে—একেকটি ধাপে আমি আমার প্রভুর ঘরের দিকে এগিয়ে চলেছি।
বিমানবন্দরে আসর ও মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। যেহেতু বিমানে ইহরামের দুই রাকাত নফল নামাজের সুযোগ কম, তাই মাগরিবের পরই মা, বাবা ও আমি ইহরামের নিয়ত করে সেই বিশেষ নামাজ আদায় করে ফেললাম। আলহামদুলিল্লাহ!
ঠিক তখনই এক অনাকাঙ্ক্ষিত অথচ আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। আম্মা বললেন—“বাবা, একটু হাজতে যেতে হবে।” আমি তাঁকে মহিলাদের ওজুখানা দেখিয়ে দিলাম। এদিকে তখন ঘোষণা এলো—সব হাজীকে হজ্জ টার্মিনালে যেতে হবে। আব্বা একটু অস্থির হয়ে উঠলেন, কারণ আম্মার আসতে দেরি হচ্ছিল।
আম্মা তাড়াহুড়া করে এলেন, আমরা রওনা হলাম। পথিমধ্যেই এজেন্সির মুয়াল্লিম রুহুল আমিন আংকেলের ফোন— “ভাই, আন্টির হাজী কার্ড কি হারিয়ে গেছে?”
কথাটি শুনে যেন হৃদয় হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। সেই অমূল্য হাজী কার্ড—যার বিনা বিকল্প নেই। আমি সাথে সাথেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম। “ইন্নালিল্লাহ! হয়তো ওজু করার সময় ভুলে রেখে এসেছি”—উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন তিনি।
আংকেল এক নম্বর দিলেন—যিনি কার্ডটি পেয়েছেন। আমি সাথে সাথেই কল করলাম। “ভাই, আপনি কোথায়?” “আমি হজ টার্মিনালের কাছেই।” আমিও বললাম, “আমি এখানেই আছি।” তখন দুজনেই হাত তুললাম, চেনার জন্য। সুবহানাল্লাহ! ভদ্রলোক আমার মাত্র কয়েক গজ দূরে ছিলেন।
এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর এক বান্দাকে সামান্য অসতর্কতায় ডুবে যেতে দেননি। বড় বিপদ থেকে অল্প সময়েই রক্ষা করে দিলেন। আল্লাহু আকবার! আমার রব তো কতই না দয়াময়!
টার্মিনালে সৌদি ইমিগ্রেশন এবং এশার নামাজের পর সেই কাঙ্ক্ষিত সময়—বিমানে আরোহন। ঢাকা থেকে জেদ্দা। হৃদয়জুড়ে এক স্বপ্ন, চোখজুড়ে কিছু অশ্রু আর ঠোঁটের কোণে এক দোয়া।
ঢাকা ও জেদ্দার মাঝে তিন ঘণ্টার পার্থক্য। আমরা বিমানে উঠলাম রাত ১১:৩০-এ। যাত্রা ছয় ঘণ্টার হলেও, নবীর দেশের মাটিতে পা রাখলাম স্থানীয় সময় রাত ২:৩০-এ।
আল্লাহর কী অপার কুদরত! “সুবহানাল্লাহ!”—মন থেকে বারবার উঠে আসছিল এই শব্দ। মনে পড়ল কুরআনের সেই অমিয় আয়াত: وَالقمرِ إِذا تَلاها “শপথ চন্দ্রের, যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে।” হে আল্লাহ! কী অপূর্ব সেই আয়াত, কী গভীর তার তাৎপর্য! কেমন যেন মিল খুঁজে পাই সেই আলোয় ভেসে আসা রাতে।
হেজাজের আকাশ, বাতাস—সবই যেন অন্যরকম। বাতাসে ভাসে এক অদ্ভুত সুঘ্রাণ—কী জানি, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি এমনই কোনো সুবাসে ডুবে ছিলেন? ভাবতেই অন্তর কেঁপে উঠে।
জেদ্দা বিমানবন্দরে প্রবেশ করতেই সবাই বলতে লাগলো: يا حاجي يا حاجي، حج مبارك “হে হাজী, হে হাজী, হজ মোবারক হোক!”
মনে হলো, যেন আবদুল মুত্তালিবের যুগে হাজীদের এই ভাবেই বরণ করা হতো। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে—কিছুই বলছি না, শুধু অনুভব করছি। জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছতেই ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেল।
ক্রমশ