Home মুক্ত গদ্যস্মৃতিগদ্য । সোনালি শৈশবে কোরবানি ঈদ

স্মৃতিগদ্য । সোনালি শৈশবে কোরবানি ঈদ

by MD JUNAYED SHEIKH
সোনালি ঈদ

বেশিরভাগ মানুষের জীবনে তার ছোটবেলা আর বেড়ে ওঠার সময়টিই সম্ভবত সবচেয়ে ঐশ্বর্যময়। ফেলে আসা গ্রামের দুরন্ত জীবনের দিকে পিছু ফিরলেই চোখে ভেসে উঠে সেই দিনগুলোর স্মৃতিমধুর অধ্যায়। আমার নস্টালজিয়ার অনেকটুকু অংশজুড়ে আছে শৈশবে গ্রামের কোরবানির ঈদ।

প্রথম হাটে যাওয়ার প্রতীক্ষার গল্প দিয়ে শুরু করি।

ঈদ আসার তখনো হয়তো সপ্তাহ দুয়েক বাকি। ততদিনে শুরু হয়ে যেত কোরবানির পশু কেনার প্রস্তুতি। সে প্রস্তুতি শুরু হতো প্রথম হাটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। আমি যত জায়গায় পড়েছি সেখানে আমার মাদ্রাসা ছুটি হতো মাত্র পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে। খুব টেনশন ফিল হতো, ভাবতাম আমি বাড়ি আসার আগেই কিনা বাড়িতে গরু কিনে ফেলে ।

আমাদের গ্রামের সাপ্তাহিক হাটটিই ঈদের আগমনী বার্তা বহন করে আনত। সাপ্তাহিক হাট বিকেলবেলা বসলেও প্রথম হাটটি শুরু হতো সকালবেলা। হাটবারের কদিন আগে থেকেই আমি এবং আমার চাচাত ভাইয়েরা তক্কে তক্কে থাকতাম কী করে সেই হাটে যাওয়া যায়। হাটবার নিয়ে সমবয়সী বন্ধু কিংবা সহপাঠীদের মধ্যে চলত শলাপরামর্শ। সবার মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা। হাট বসেছে কিন্তু মাদ্রাসা ছুটি হতে দিন ছয়েক বাকি। তর সইছে না। তাই আমরা ও আমাদের সহপাঠীদের কেউ কেউ অপেক্ষার পালা সইতে না পেরে মাদ্রাসা থেকে পালাতাম।

সারাজীবন আমার বাপ চাচারা এক সাথে কুরবানি দিয়ে আসছেন। তাদের সাথেই মূলত হাটে যাওয়া হতো । ঈদের কদিন আগে কোনো একদিন বাবা, চাচার হাত ধরে যেতাম গ্রামের হাটে। কিন্তু যেদিন আমাদের গরু কিনবে তার কয়েকদিন পূর্ব থেকে চাচাত ভাই আর পড়শি বন্ধুদের সাথে পরিকল্পনা করতাম — কিভাবে, কোন পথে , কোনদিন গরু কেনা হবে ইত্যাদি। বাবা-চাচাদের আলোচনায় কান খাঁড়া করে আমরা ধারণা করে নিতাম। সেদিন সকাল থেকেই আমি তক্কে তক্কে থাকতাম বাবা-চাচা কখন হাটে যাবে! স্বাভাবিক ভাবে সেই সময়টা দুপুরের পরে হতো।

কিন্তু বড়রা কখনোই আমাকে সঙ্গে নিতে চাইতেন না। কারণ তখন আমি অনেক ছোট ছিলাম। সারা সপ্তাহের প্ল্যান পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে দেখে চিৎকার করে কাঁদতাম। তখন গরুর লাথি খাওয়ার ভয় দেখাত। তবুও আমরা যেতে চাই। অবশেষেই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতো।

দুপুরের খাবারের পর একটুখানি জিরিয়েই হাটে চলে যেতেন। গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে ক্রোশখানেক দূরের সেই হাটে পৌঁছাতেই ভিড়ের মাঝে দেখা মিলত বিক্রেতার সঙ্গে দর কষাকষিরত বাপ-চাচাদের। যদি তারা কখনো ছোট গরু দর করে, আমরা তাদেরকে বড় গরুর দিকে নিয়ে যেতাম । ছোট গরু আমাদের পসন্দ না। আর এতে বিরক্ত হতেন তারা।

দর কষাকষির এক পর্যায়ে শেষ বিকেলের কোন এক ফাঁকে কেনা হয়ে যেত কোরবানির পশুটি। সেই পশুর দড়ি ধরার সুযোগ পেতে সে কী অধীর আগ্রহ আমাদের। সেই অসীম আগ্রহে পুরোপুরি জল না ঢেলে গরুটির দড়ি ধরার সুযোগ দিতেন বাপ-চাচারা। সেই দড়ি হাতে বিজয়ীর বেশে বাড়ির দিকে যাত্রা করতাম ।

বাড়িতে ফিরে পশুটির সেবাযত্নে নিজেদের সঁপে দিতাম । কেউ তরতর করে কাঁঠাল গাছ বেয়ে পাতা সংগ্রহ করে আনতো। কেউ গরুর গায়ে কিংবা গলার নিচে হাত বুলিয়ে আদর করত। মানুষজন আসতো আমাদের গরু দেখতে। আমরা আগবাড়িয়ে ডাম বলে দিতাম। কেউ কেউ মন্তব্য করত খুব ভালো হয়েছে। আবার কেউ কেউ কমেন্ট করত মোটামুটি হয়েছে আবার কেউ কেউ কমেন্ট করত তেমন ভালো হয় নাই। শেষের মন্তব্যটি শুনতে যদিও ভালো নয় তবুও আমরা গায়ে মাখতাম না।

এভাবে ক্রমেই এগিয়ে আসত বহুল প্রতীক্ষিত ঈদের দিনটি। তবে ঈদের দিনটির চেয়ে ঈদের আগমনী বার্তা বহনকারী দিনগুলোই বোধহয় বেশি আনন্দের ছিল। ঈদের আগের রাতে মেয়েরা মেহেদি পরত। আমাদের ছোটবেলায় প্যাকেট বা টিউব মেহেদির চল ছিলো না। তাই পাটায় মেহেদি পাতা বেটে নারিকেল পাতার শলাকা দিয়ে নকশা করে তা লাগাত বাড়ির মেয়েরা। এইত এটা বেশিদিন আগের কথা না মাএ ১০/১২ বছর আগের কথা।

বহুল প্রতীক্ষিত ঈদের দিন সাতসকালেই কোরবানির পশুটিকে গোসল করানো হতো। আগেই ধার তোলা দা, ছুরি, বটির ধার পরখ করিয়ে নিতেন বড়রা। আমাদের ছোটদের মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, আগের রাত থেকেই কোরবানির পশুটি আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে কাঁদতে থাকে। কারণ, ফেরেশতারা কোরবানির পশুটিকে জবাই করার বার্তাটি জানিয়ে দিতেন। আমরাও সেই শোকে সহানুভূতি জানিয়ে পশুটির গায়ে শেষবারের মতো হাত বুলিয়ে আদর করে দিতাম।

গরু জবাই শেষ না হতেই শুরু হত আরেকটি আনন্দের উপলক্ষ। গোশত বিলি বণ্টন পর্ব। আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বিশেষ করে নানুদের বাড়ি কিভাবে গোশত পাঠাবো তা নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা থাকত। সে এক মজার আখ্যান। অন্য একদিন লেখব।

কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে আমাদের শৈশবের কাদামাটি মাখা সেই নিখাদ ঈদের আনন্দ। আজও প্রতি বছর ঈদ আসে। ঈদ বিদায় নেয়। কিন্তু শৈশবের সেই অনাবিল আনন্দের ঈদ কি আর ফিরে আসে!

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment