শৈশবে আফ্ফান ভাইয়ের মতো বড় হতে চাইতাম। আমার বড় বড় গোঁফ থাকবে, থাকবে লম্বা দাড়ি আর বাবরি চুল। পরনে থাকবে সাহেবদের মতো প্যান্ট-কোট। তাহলে আমাকে কেউ বাজারে যেতে বাধা দিবে না, জোর করে মা আর ভাত খাওয়াবে না, বাধ্য হয়ে পড়ার টেবিলে বসতে হবে না।
কিন্তু আমি যখন শৈশব থেকে কৈশোরে পৌছানো শুরু করি তখন আমি আমার শৈশব কে মিস করতে শুরু করি। না, আমি তো কখনোই এভাবে ধীরে ধীরে বড় হতে চাইনি। আমি তো চাইতাম হঠাৎ আফ্ফান ভাইয়ের মতো হতে। অবশ্য এখন আর আমি বড় হতে চাই না । এখন শুধু চাই আবার শৈশবে ফিরে যেতে। আমি চাই শৈশবে মা আমাকে যেমন শাসন করতেন আজও যেন তেমনি শাসন করুক।
ছোট বেলায় খেতে চাইতাম না, কারণ আমি যে মালেক চাচাদের কাঁঠাল চুরি করে খেয়েছি, পেট ভরা, মা জোর করে খাওয়াতেন, খাইনি বলে। আমি বলতে চাই, মা ! আমি হারুন ভাইদের আম চুরি করে খেয়েছি, ভাত খেতে পারবো না। কিন্তু বলা হতো না। মা জোর করে খাওয়াতেন।
আর এখন যখন বলি : ক্ষুধা নাই, খাব না। মা তখন দ্বিতীয় বার বলতে যেন সংকোচবোদ করেন। মাঝে মাঝে তো খাবারের জন্য দ্বিতীয় বার বলেনো না। আমি তো চাই মা আমাকে ছোট্ট বেলার মতো জোর করে খাওয়াক, কারণ এখন আর আমি আম কাঁঠাল চুরি করে খাই না। না ! আমি ছোট থাকতে চাই, বড় হওয়ার প্রতি আমার অনীহা।
আমি আবার ছোটবেলার ন্যায় সারাক্ষণ মারবেল খেলতে চাই। আমি মারবেল খেলায় উস্তাদ ছিলাম। আমরা যারা মারবেল খেলতাম, তাদের কাছে সবসময় একটা কাপড়ের পুটলি বা বোতল থাকত যেখানে মারবেল সঞ্চয় করে রাখা হতো।
প্রায় কি হত! পাঁচটি মারবেল নিয়ে মাঠে নিমে যখন পুটলি ভরে সঞ্চয় নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আর ঐ মারবেল গুলো অনেক যত্নে লুকিয়েও রাখতাম।
কিন্তু পরের দিন দেখি ওমা! মারবেল গায়েব। ভয়ে আম্মুকেও জিজ্ঞেস করতাম না , যদি মারে আমাকে।
তখন চুপিচুপি ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করতাম, এই আমার মারবেল দেছস। ঐ সবসময় হতাশাজনক উত্তর দিবে যে, আম্মু তো সকালে ঝাড়ু দিয়ার সময় পাইছিল। তখন সব ফেলে দিছে।
কি-যে কষ্ট লাগতো তখন। আবার পাঁচ টাকার পাঁচটা মারবেল কিনে খেলা শুরু করতাম। আগের ফেলে দেওয়া মারবেলের কথা ভুলে যেতাম। আম্মু আবার পেতেন, আবার পেতেন ফেলে দিতেন ।
আজ শবকিছু কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছে।
আমি চাই দক্ষ হাতে সোনার লাটিম ঘুরাতে। আমি আষাঢ়ের খালে সাঁতার কাটতে, ভাদ্রের বিলে শাপলা তুলতে ঝাপিয়ে পরতে চাই। আমি চাই স্কুলের পিছনের তালগাছ থেকে বাবই পাখির বাসা ভাঙতে, ঝড়ের মাঝে কাঁদা নিয়ে ঢিলাঢিলি করতে চাই। পূর্ণিমা রাতে চাঁদ আমার একার হোক। আমাবস্যা রাতে সকল ছোট ভূত আমার সঙ্গি হোক।
আমি শীত সকালে শিশির ভেজা ঘাসের কচি ডগা মাড়িয়ে মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছ থেকে হাঁড়ি ভেঙে রস খেতে চাই।
আমি কিছুই পারি না, এই বড় হওয়া আমাকে অন্যের টিনের চালে ঢিল ছুড়তে নিষেধ করে। না, আমি বড় হবো না। আমি শুধু আমার শৈশব চাই। আমি আমার শৈশবের সকাল বেলায় ডালিম গাছে বসে থাকা চড়ুই পাখির কলরব শুনতে চাই। জানি আমি বড় হতেই থাকবো, তারপরও আমি আমার শৈশব চাইবো।