মোঃ একরামুল হক
সহযোগী অধ্যাপক (প্রাক্তন) ও উপাধ্যক্ষ, বিকেএসপি
———————————————
খেলার জগতে মুশফিকের অবদান অবিস্মরণীয় । ক্রিকেট অঙ্গনে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।মানুষ হিসেবে তার তুলনা হয় না। একজন সাদা মনের মানুষ। বিকেএসপিতে খেলাধুলায় ও পড়ালেখায় নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম এবং শৃঙ্খলার কোনো তুলনা হয় না। ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প যার অন্তরে বিরাজমান । ধর্মপ্রাণ মুশফিক অসহায়দের সাহায্যে একজন নিবেদিত প্রাণ।
বিকেএসপিতে তাকে নিয়ে ক্লাসে অনেক গল্প করেছি, তবে তার প্রতিষ্ঠান থেকে বের হবার পর। ছাত্র-ছাত্রীদের বলতাম তোমরা মুশফিককে অনুসরণ কর । কেউ কি তার চেয়ে বেশি ভালো হতে চাও ? যদি হতে পারো সেটা হবে খেলোয়াড় ও মানুষ হিসেবে জীবনে বিরাট প্রাপ্তি।
বলতাম, তোমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে যাও। দেখবে, একদিন সফলতা ধরা দিবেই।চলার পথে হাজারো বাধা আসবেই কিন্তু সেগুলোর মোকাবিলা করতে হলে প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবিচল মনোভাব। ক্লাসে শিক্ষার্থীদেরকে বলতাম, যতবড়ই খেলোয়াড় হও, প্রকৃত মানুষ হও আগে। মুশফিক কঠোর পরিশ্রম ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে খেলার জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
ছাত্র হিসেবে মুশফিক ছিল অসাধারণ,তার মেধা ও প্রজ্ঞা অতুলনীয়। মনে পড়ে, অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করল। ক্লাসের প্রথম দিন তাকে মানবিক বিভাগের ক্লাসে দেখে আমার একটু রাগ হলো। ক্লাসের সামনের সারিতে সামনের বেঞ্চে বসেছে । আমি তার কানটা ধরে বলছিলাম , তুমি কেন এই ক্লাসে ?
সেদিন সে বলেছিল, স্যার , খেলাকেই প্রাধান্য দিতে চাই , এ জন্য আমি আর্টস নিয়ে পড়তে চাই । মুশফিক এ-ও বলল, বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গেলে খেলায় ব্যাঘাত ঘটবে। আবার খেলায় বেশি মনোযোগ দিতে পারবো না ।
সে বলছিল বিজ্ঞান বিভাগে প্রাকটিক্যাল আছে তাছাড়া পড়ালেখায় সময় বেশি দিতে হবে ।আমি খেলায় বেশি মনোযোগ দিতে চাই । আমি কোন কথা না বলে শুধু বললাম, বেশ, তুমি যেটা ভালো মনে কর।
হাঁ আজকের মুশফিক সেদিন সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে ভূল করেনি । তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খেলার পাশাপাশি পড়ালেখায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে ।
২
ক্রিকেট খেলায় দেশ-বিদেশে সাকিব মুশফিক তুঙ্গে । একদিন তারা দুজন আমার অফিস কক্ষে এসে হাজির। সেই সময় তাদের সঙ্গে ছিল তাদের গুরু সালাহউদ্দিনের চার বা পাঁচ বছরের পুত্র সানজিদ। আমার টেবিলের সামনে পাতানো দুটি চেয়ার ধরে তারা দাঁড়িয়ে রইল। আমি তাদেরকে চেয়ারে বসতে বললাম,তারা মাথা ঝাকিয়ে বলছে , না স্যার।
আমি পর পর তিনবার তাদেরকে চেয়ারে বসতে বললাম, তারা একই ভাবে বলল,”না স্যার।আমি তাদের দিকে তাকিয়ে স্যালুট দিলাম এবং বললাম, এটা আমার বিরাট প্রাপ্তি। আজ সারা বিশ্ব তোমাদেরকে চিনে ,আমার মত মাস্টারকে কয়জনই বা চেনে। আমরা তোমাদের মাধ্যমে পরিচিত হই।
তারা দুজনেই মাথা নিচু করে সামনে দাঁড়িয়ে রইল ।
৩
ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসেছি,ঈদগাহে নামাজ শেষে বের হচ্ছিলাম । একটু দুরে আমার বাল্য বন্ধু তার পুত্র সন্তানকে বলছে ,ঐ যে কাইলা দেড় ব্যাটারী লোকটা দেখছিস না, সে হল সাকিব মুশফিকের স্যার। ছেলেটি আমার মুখপানে চেয়ে একটা ভেংচি কাটল। আমি সামান্যতম কষ্ট পাইনি। ছেলেটি ঠিক করেছে,কারন সাকিব মুশফিকের স্যার হবে সুদর্শন ও স্মার্ট। আমাকে তার পছন্দ হয়নি।
সেই দিন তাদেরকে বলেছিলাম, অজপাড়াগায়ের ছেলেরা তোমাদেরকে কত ভালোবাসে।এটাই তার জলন্ত উদাহরণ । আমার গর্ব , তোমাদের মতো স্বনামধন্য খেলোয়াড়দের শিক্ষক হতে পারা। বিকেএসপিতে যা পেয়েছি সেটা তোমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। আমার জীবনে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি হতে পারে !
৪
মাঝে মাধ্যেই মুশফিক জাতীয় দলের সাথে বিকেএসপিতে ক্যাম্পে অংশ গ্রহণ করত।সুযোগ পেলেই কলেজে এসে স্যার-ম্যাডামদের সাথে দেখা করতো । টিফিন পিরিয়ডে আমরা শিক্ষকরা কমন রুমে চা পানে অংশ গ্রহণ করতাম।
আমার কোন কারণে সেদিন কমন রুমে যেতে দেরি হল। কমন রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম মুশফিক তার স্যার-ম্যাডামদের সাথে আলাপচারিতায় মগ্ন । দরজা থেকেই আমার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো,”জলপান যে করতে দিব শালি ধানের চিঁড়ে।”
সেটা মুশফিককে উদ্দেশ্য করেই বলা। ছুটে এসে মুশফিক আমাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথা আমার বুকে লাগিয়ে দিল। তার সেই আন্তরিকতার সাথে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতিফলন ভোলা যায় না। সেইসব স্মৃতির ঐশ্বর্য এখনো অন্তরে বহমান।
একদিন দুপুর বেলায় বাসায় খাবার টেবিলে খালি গায়ে কি যেন কাজে ব্যস্ত ছিলাম । হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল । ভাগ্নি দরজা খুলে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলছে মুশফিক ভাইয়া !
আমি ভাবলাম, এ সময় গ্রাম থেকে কোন মুশফিক ভাই এল। দরজার সামনে গিয়ে দেখি কাঁদে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগ, মৃদু হেসে সালাম দিল।আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না। মুশফিক বলল, স্যার আমার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছি। আমি বললাম, আগে ভিতরে এসে বসো , তারপর কথা।
সে বলছে, আরো বেশ কয়কটা বাসায় যেতে হবে। আমি বললাম, আমার বাসায় যদি কিছু মুখে না দাও, তো তোমার দাওয়াত কবুল করব না। সে বলছে, স্যার খাওয়া দাওয়া বেশ কন্ট্রোল করতে হয়। আমি বললাম, ঠিক আছে, নওগাঁর আম আছ্ একটা কেটে দেই। বলল, হাঁ, এটা খাওয়া যেতে পারে। দু পিচ আম খেয়ে বলল, স্যার দারুন,এখন আসি স্যার।আমি বললাম , ইনশাআল্লাহ তোমার বিয়েতে দেখা হবে।
৫
বিকেএসপিতে রজতজয়ন্তী উপলক্ষে প্রাক্তন ও বর্তমানে সকলের মাঝে এক উন্মাদনা বিরাজ করছিল। আমি সেই দিনের জন্য ভিষণ ভাবে নষ্টালজিয়ায় ভুগছিলাম । কত দিন পরে এই মিলনমেলায় দেখা হবে অনেকের সাথে ।
সকাল থেকেই প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ পুরাতন ও নতুনদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল ।আমি ও আমার সহকর্মী সালাম প্রতিষ্ঠানের ভিতরে গেটের সামনে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সাথে আড্ডায় মেতেছি। লক্ষ করলাম ফাহিম ভাই দেহ মোচড়ানো (পাকানো)বোতল ব্রাশ গাছের ছায়া তলে বসে ছাত্রদের সাথে গল্পে মেতেছেন।
এই বোতল ব্রাশ গাছগুলিকে দেখলে মনে হত বিধাতা ঘাড়ে পাক দিয়ে তাদেরকে বেড়ে উঠতে সহায়তা করছে। তবে ক্রিকেট মাঠের অপরূপ সৌন্দর্য ছিল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো এই গাছগুলো । হঠাৎ গেট দিয়ে প্রবেশ করেই মুশফিকের চিৎকার, স্যার… বলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
অপলক দৃষ্টিতে সাংবাদিকগন ও তাদের ক্যামেরার চোখ নিক্ষিপ্ত হলো আমাদের উপর। একজন সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, কে আপনি ? আমি বললাম সেটা ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন ।
পরের দিন প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় প্রকাশিত হল। মুশফিক তার প্রিয় গনিতের শিক্ষককের সঙ্গে দেখা হলেই বদলে যায় সেখানকার চিত্রটা। আবেগঘন পরিবেশে ছাত্র শিক্ষকের মিলন যেন আনন্দময় হয়ে উঠল। তবে দুঃখ পেলাম প্রতিটা পত্রিকায় আমার নাম ভূল ছাপা হল।