২০১৬ সাল। মালিবাগ জামিয়ায় নতুন ভর্তি হয়েছি। কাফিয়া জামাতে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। হুজুররা ধুমধাম খাতা দেখছেন। ভুলবশত কোন কিতাবের খাতায় দাখেলা নম্বর না লিখে চলে এসেছিলাম। কোন হুজুরের কাছে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। একবার দেখলাম ফখরুল সাহেব হুজুর দস্তারবন্দী কামরায় বসে খাতা দেখছেন। ভয়ে ভয়ে হুজুরের কাছে গেলাম। সমস্যার কথা জানালাম। হুজুর হেসে হেসে বললেন, বাড়ি কই? আমি বললাম টাঙ্গাইল। হুজুর বললেন ‘জঙ্গল’ এসব ভুল মানুষ করে? তখনই হুজুরের সাথে প্রথম কথাবার্তা হয় আমার।
এর পরের বছর শরহে বেকায়া জামাতে হুজুরের ঘণ্টা পেলাম। তরজমাতুল কুরআন পড়াতেন। হুজুরের ঘণ্টাটি আমার কাছে মধুর লাগতো। কিভাবে যেন হুজুরের দরস মুহূর্তে শেষ হয়ে যেত। হুজুরের দরসটা ছিল খুব স্বাভাবিক। এতো বেশি তাকরীর করতেন না। বুঝে আসার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু কথাই বলতেন। জটিল কোন মাসালা আসলে হুজুর নিজেই ইশকাল করতেন। শরা শরুহাত হাশিয়া দেখে হল করে পরে সামনে আগাতেন। কখনোই পাশকাটিয়ে যেতেন না।
সারা বছর এক পরিমাণ পড়াতেন। কখনো দরস মিস হতো না। নির্ধারিত সময়ে হুজুরের নেসাব শেষ হয়নি, বা কখনো এমন হয়েছে বলে মনে হয়নি ।
কোন কিছু জানা না থাকলে বিনা দ্বিধায় বলতেন, আমার জানা নাই।
হুজুরের নিকট কোরআন তরজমা আর হিদায়া প্রথম খণ্ড পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
২
পরের বছর মালিবাগে জালালাইন জামাতে ভর্তি হলাম। হুজুরের মেজো ছেলে লাবীদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে মাঝেমধ্যেই হুজুরের রুমে যাওয়া হতো। কখনো বাসায় মেহমান আসলে কিংবা লাবিদ ভাই সালমান কেউ না থাকলে হুজুর রুমে থাকতেন।
হুজুর আমার সাথে দীর্ঘক্ষণ গল্প করতেন। আমি পারিবারিক বিষয় কিছু জিজ্ঞেস করলে হুজুর বলতেন, করতে তো চাই অনেক কিছুই পারিত না। কখনো কখনো বলতেন এইতো আর দু একটা বছর সাঈদ আর লাবীদের পড়ালেখা শেষ হলে বাসা থেকে আর বের হবো না। সারাদিন বাসায় থাকবো।
হুজুরের কল্পিত সেই আরাম করে বসে থাকার দিন হুজুরের জীবনে আর এলোনা। তার আগেই পরপারে চলে গেলেন।
৩
প্রতিদিন দরসের আগে যখন নাস্তা খেতে বের হতাম। তখন প্রায়ই হুজুরের সাথে আমার সাক্ষাৎ হত। দপ্তরের সামনে নতুবা রাস্তায়। দেখতাম হুজুর একটা নীল রঙের ব্যাগ ভর্তি নাস্তা নিয়ে একদিকে ঝুলে হেঁটে হেঁটে আসছেন। আমি হুজুরের কাছ থেকে ব্যাগ নিতে চাইলে হুজুর দিতেন না। বলতেন, আমিই তো পারি। আমি জোর করে হুজুরের হাত থেকে ব্যাগ নিতাম। হুজুর দফতরের ভিতরে গিয়ে উস্তাদগণের জন্য নির্ধারিত খাতায় সাইন করতেন।
রাতেরবেলা দশটা সারে দশটার দিকে দেখতাম সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে ধীরে ধীরে নামছেন। হাতে সেই নীল ব্যাগটা। ভিতরে খালি বাটি। সকালে আবার নাস্তা নিয়ে আসবেন। আমি কাছে গিয়ে বলতাম, হুজুরকে অনেক ক্লান্ত মনে হচ্ছে। হুজুর বলতেন “কি করব বাবা! দৌড়াদৌড়ি না করলে তো হয় না”।
নিজেকে এখনও বিশ্বাস করাতে পারছি না যে এই দুনিয়াতে আর কোনদিন হুজুরের দেখা হবেনা। হুজুরের হাতে নাস্তার ব্যাগটা আর দেখবো না। হুজুর আর নাস্তা নিয়ে আসবেন না। রাতের বেলা সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে আর নামবেন না।
৪
হুজুর তাঁর সন্তানদেরকে কেমন আদর করতেন, যারা হুজুরকে একদম কাছ থেকে চেনে, তারা ভাল বলতে পারবেন। তিনি কখনোই ছেলেদের ময়লা কাপড় তাদেরকে ধুইতে দিতেন না। ওরা কাপড় লুকিয়ে রাখলেও হুজুর ঠিক খুঁজে বের করে ধুয়ে দিতেন।
বাহিরের খাবার খেলে পেটে সমস্যা হবে, এজন্য আজীবন নাস্তার ব্যাগ টেনেছেন। ওরা এতো বড় হয়ে যাবার পরেও মাঝেই মাঝেই হুজুর ওদেরকে চুমু খেতেন।
ওরা প্রায়ই আমাকে বলতো! এতো বড় হয়ে গেছি এখনো যে আব্বু এগুলো কি করে ! আসলে সন্তানরা কি বাবার কাছে কখনো বড় হয় ? আজীবন ছোটই থাকে।
৫
হুজুর একজন মুখলিস সাদা দিলের মানুষ ছিলেন। সবসময় আগে আগে উঁচুস্বরে সালাম দিতেন। কেউ অস্পষ্ট উচ্চারণে সালাম দিলে হুজুর খুব রাগ করতেন। হুজুরকে ফোন দিলে হুজুর লম্বা করে একটা সালাম দিতেন। নাম বললেই মায়াভরা কণ্ঠে বলতেন , বাবা , তুমি ফোন দিসো!
অহংকার, রিয়া, তাকাল্লুফ বলতে কিছু ছিল না হুজুরের মাঝে ৷ যশখ্যাতির জন্য জীবনে কিছু করেননি। আজীবন কষ্ট করে গেছেন। বরঞ্চ সবাইকে দিয়ে গেছেন। সাদাসিধা, পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতেন। অপরিচ্ছন্নতা একদম দেখতে পারতেন না।
হাইআতুল উলিয়ার পরীক্ষার সময় হুজুরের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যেত। এদিকে সকালে মালিবাগে ছেলেদের নাস্তা নিয়ে আসতে হয়। আবার এখান থেকে নেগরানির জন্য আরেক জায়গায় যেতে হয়।
লাবীদ তখন আমাকে আফসোস করে বলতো, এই তো আর কয়টা দিন, আব্বুকে আর দৌড়াদৌড়ি করতে দিব না। আমিই সব করব।
হুজুরকে নিয়ে ওদের স্বপ্নের অন্ত ছিলো না। ওরা বলেছিল, মালিবাগের আশেপাশে বাসা নিবে , যেন হুজুরকে কষ্ট করে এতো দূর থেকে আসতে না হয়। এসব আর হলো কই ? এসব কথা মনে করে আমি-ই তো নিজেকে সামলাতে পারছিনা, লাবিদরা কিভাবে নিজেদের সামলাবে।
বাড়িতে এসে হুজুরের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে। এইতো দুদিন আগেও কথা হল। তখনও তো বুঝতে পারিনি এটাই হুজুরের সাথে আমার শেষ কথা। হুজুর আমাকে সবসময় বাবা বলে ডাকতেন। মনে পড়ে একবার কোন কাজে হুজুরের বাসায় যেতে হয়েছিল। গিয়ে দেখি হুজুর বাসা থেকে বের হয়ে গেটের বাইরে চলে এসেছেন। আমাকে বাসায় যেতে বললে আমি বললাম হুজুর এমনি একটা কাজে এসেছিলাম বাসায় যাব না। তখন হুজুর বললেন যাবে না কেন খেতে না দিতে পারলেও বসতে তো দিতে পারব। এটা বলে হুজুর আমাকে রাস্তা থেকে চারতলা পর্যন্ত হাতে ধরে নিয়ে গেলেন। আমাকে বাসায় রেখে পরে বাহিরে গেলেন।
৬
আমার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে শুধু আমার দাদা ও নানা পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তখন অনেক ছোট ছিলাম এ কারণে তাদের মৃত্যুর খবরটা হয়তো আমাকে বেশি পীড়া দেয়নি। কিন্তু বুদ্ধিমান হওয়ার পরে হুজুরের মৃত্যুটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিল। কোনভাবেই যেন নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিনা। হুজুরের মৃত্যু সংবাদটা শোনার পর থেকে একরকম বোবা হয়ে গিয়েছি। কোনভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। হুজুরের পরিবারের জন্য মনটা বারবার হুহু করে কেঁদে উঠছে। আল্লাহ হুজুর এর পরিবারকে সবরে জামিল আতা ফরমান। আমীন।
হুজুর সবসময় হেঁটে হেঁটে চলাফেলা করতেন কখনো রিক্সায় উঠতেন না। রাস্তাঘাটে হুজুরের সাথে দেখা হলে হাতে ধরে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতেন। দেখা হলেই এই মানুষটা যেভাবে সবাইকে আপন করে নিতেন আল্লাহ যেন তাকেও এইভাবে আপন করে নেন।
তার কবর যেন আদিগন্ত প্রশস্ত হয়। জান্নাত থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সৌরভে যেন এই মানুষটার শেষ ঘর মাতোয়ারা হয়। হে আল্লাহ , কবুল করুন।
জাহিদ আফফান
সাবেক শিক্ষার্থীঃ জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা