পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিফাইল ছবি: রয়টার্স
চার দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১০ মে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই লড়াইয়ে কেউ পুরোপুরি জয়ী হয়েছে কি না, তা বলা কঠিন। তবে সংঘাতে দুই পক্ষই নিজেদের ‘বিজয়’ দাবি করেছে।
গত ২২ এপ্রিল ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্বল্প পরিচিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। তবে ভারত দাবি করেছে, এই গোষ্ঠী পাকিস্তান–সমর্থিত। তবে পাকিস্তান এ অভিযোগ নাকচ করে দিলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেন।
এরপর দুই প্রতিবেশী দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি নানা কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে থাকে। এরপরই সেই উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেয়। ৭ মে সকালে পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের চারটি স্থানে ‘জঙ্গিঘাঁটি’তে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত।
এরপরের দিনগুলোতে দুই দেশই একে অপরের ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং একে অপরকে হামলার জন্য দায়ী করেছে। ১০ মে উভয় দেশ একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পর উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।
ভারত শুরুতে পাকিস্তানের তিনটি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়, যার একটি ছিল রাওয়ালপিন্ডি। এ শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সদর দপ্তরের অবস্থান হওয়ায় একে সামরিক ঘাঁটির শহর (গ্যারিসন সিটি) হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর ভারত আরও কিছু পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।
যুদ্ধবিরতির পর উভয় দেশই সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের ‘জয়ী’ দাবি করে এবং নানা ‘প্রমাণ’ উপস্থাপন করে। গত সোমবার ভারত ও পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা ফোনে কথা বলেন এবং আগামী দিনগুলোতে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন।
অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে অবস্থিত সামরিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ভারতের অন্তত চারটি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে।
পরিস্থিতি যখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে যাচ্ছিল, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং দাবি করেন, এ যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হয়েছে। পাকিস্তান এ উদ্যোগের প্রশংসা করলেও ভারত বলেছে, বাইরের কারও হস্তক্ষেপ ছাড়াই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত দুই দেশের মধ্যেই হয়েছে।
যুদ্ধবিরতির পর উভয় দেশই সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের ‘জয়’ দাবি করে এবং নানা ‘প্রমাণ’ উপস্থাপন করে। গত সোমবার ভারত ও পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তারা ফোনে কথা বলেন এবং আগামী দিনগুলোতে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২২ এপ্রিলের ঘটনার পর কেউই পুরোপুরি নিজেদের সত্যিকারের জয়ী বলে দাবি করতে পারে না। বরং উভয় দেশই কিছু লাভ করলেও ক্ষতিও হয়েছে তাদের।

ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মুজাফফরাবাদের বিলাল মসজিদের প্রাঙ্গণে এক পাকিস্তানি সেনা। পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর, ৭ মেছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানের লাভ: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাশ্মীর
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আগের চারটি যুদ্ধের তিনটি হয়েছিল কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে। গত সপ্তাহের সামরিক সংঘাতও মূলত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের দীর্ঘদিনের বিরোধ থেকেই উদ্ভূত।
পাকিস্তান ও ভারত কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। পাশাপাশি চীনও দুটি সরু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত পুরো কাশ্মীরকেই নিজের অংশ হিসেবে দাবি করে। অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতনিয়ন্ত্রিত অংশটিকেও নিজেদের দাবি করে। তবে পাকিস্তানের মিত্র চীন যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, তা নিয়ে পাকিস্তান কিছু বলে না।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছে, কাশ্মীর ইস্যু শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানযোগ্য এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এবার ভারতকে বাইরের মধ্যস্থতা মেনে নিতে হয়েছে, যা তাদের জন্য একটি চাপের বিষয়।
অন্যদিকে ভারত দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে এসেছে, কাশ্মীর ইস্যু শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানযোগ্য এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু এবার ভারতকে বাইরের মধ্যস্থতা মেনে নিতে হয়েছে, যা তাদের জন্য একটি চাপের বিষয়।
বিশ্লেষক সুধা রামচন্দ্রন বলছেন, ভারতের ভেতরে মোদি সরকারের জাতীয়তাবাদী সমর্থকেরা পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে উজ্জীবিত হলেও যুদ্ধবিরতি কট্টরপন্থীদের কাছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়। তখন ভারত-পাকিস্তানও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, যা শিমলা চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তিতে তারা একমত হয়েছিল, পারস্পরিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ ও দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে।
তখন থেকে ভারত সব সময়ই বলে এসেছে, কাশ্মীর ইস্যু ও দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য বিরোধ শুধু দ্বিপক্ষীয়ভাবেই সমাধানযোগ্য। এখানে তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ চলবে না।
তবে পাকিস্তান জাতিসংঘের প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করে এসেছে, যেন তারা কাশ্মীর সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে।
ওয়াল্টার আরও বলেন, অবশ্য ইসলামাবাদ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে এখন নিজেদের জড়িত না থাকার প্রমাণ উপস্থাপনের দায় ক্রমশ পাকিস্তানের ওপরই বর্তেছে।
গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। তিনি নিজের ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, ‘আমি দুই পক্ষের সঙ্গেই কাজ করতে প্রস্তুত, যাতে কাশ্মীর নিয়ে হাজার বছরের বিরোধের কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়।’
কিংস কলেজ লন্ডনের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, সর্বশেষ এ সংঘাত পাকিস্তানকে একটি সুযোগ দিয়েছে কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার, যা তাদের বহুদিনের কৌশলগত লক্ষ্য ছিল।

ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মুর একটি পরিবার হামলা থেকে নিরাপদে থাকতে বাংকারে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে। ৮ মে, জম্মুছবি: রয়টার্স
ওয়াল্টার ল্যাডউইগ আল-জাজিরাকে বলেন, ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানিয়েছে এবং যুদ্ধবিরতিকে বাইরের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
ওয়াল্টার বলেন, বিপরীতে ভারতকে বাইরের শক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ সংঘাত নিজের শর্তে শেষ করতে পারেনি।
সর্বশেষ এই সংঘাত পাকিস্তানকে একটি সুযোগ দিয়েছে কাশ্মীর ইস্যুকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরার, যা তাদের বহুদিনের কৌশলগত লক্ষ্য ছিল।
—ওয়াল্টার ল্যাডউইগ, জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, কিংস কলেজ লন্ডন
দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীর দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক সুধা রামচন্দ্রন বলেন, মোদি সরকার এই সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারতের জাতীয়তাবাদী ও কট্টরপন্থী সমর্থকদের আরও দৃঢ়ভাবে পাশে পেয়েছে হয়তো। তবে যুদ্ধবিরতির কারণে কিছু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমর্থনও হারাতে পারে।
রামাচন্দ্রন আরও বলেন, এই পদক্ষেপ জাতীয়তাবাদী কট্টরপন্থী সমর্থকদের মধ্যে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। কিন্তু কট্টরপন্থীরা যুদ্ধবিরতিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।
ভারতের লাভ: সন্ত্রাসবাদকে সামনে আনা
বিশ্লেষকদের মতে, এ সংঘাতে ভারতও কৌশলগতভাবে কিছু অর্জন করেছে। পেহেলগামে হামলার পর ভারত আন্তর্জাতিক মহলে আবারও পাকিস্তানের মাটিতে সক্রিয় ‘জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো’র বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
পরবর্তী সময়ে যেকোনো সংঘাত আরও রক্তক্ষয়ী এবং বিস্তৃত হতে পারে। যদি দুই পক্ষ দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পথে যায়, তাহলে উভয়েরই জনবহুল শহরাঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, যাতে কোনো পক্ষই প্রকৃত অর্থে লাভবান হবে না।
—মুহাম্মদ শোয়েব, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক
অবশ্য পাকিস্তান এ অভিযোগ অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। তবু এখন আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের ওপর সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়ার চাপ আরও বেড়েছে।
ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, কূটনৈতিকভাবে ভারত আন্তর্জাতিক মনোযোগ আবার পাকিস্তানভিত্তিক ‘জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো’র দিকে ফেরাতে সফল হয়েছে এবং ইসলামাবাদের ওপর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি নতুন করে জোরদার করতে সক্ষম হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের এই বিশ্লেষক বলেন, পাকিস্তানের জন্য এটি একটি সুনামহানিকর পরিস্থিতি। কারণ, এ হামলায় তাদের মাটি থেকে পরিচালিত ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’র যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
ওয়াল্টার আরও বলেন, অবশ্য ইসলামাবাদ হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে এখন নিজেদের জড়িত না থাকার প্রমাণ উপস্থাপনের দায় ক্রমশ পাকিস্তানের ওপরই বর্তেছে। পাকিস্তানের ওপর এখন সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করার চাপ বাড়ছে।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তান কাশ্মীরকে ভারতের কাছ থেকে আলাদা করতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করছে, তারা কেবল কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে থাকে।

ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় একটি যুদ্ধবিমানের ধাতব ধ্বংসাবশেষ। ৭ মে, উইয়ানছবি: রয়টার্স
পাকিস্তানের সাফল্য: ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত
পাকিস্তান দাবি করেছে, তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা একাধিক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত তা নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি, তবে ফরাসি ও মার্কিন সূত্র থেকে অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান হারানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। কিছু ভাঙা অংশ ভারত–নিয়ন্ত্রিত জমিতে পাওয়া গেছে, যা থেকে ধারণা করা হয়, সেগুলো ভারতীয়ই ছিল।
ভারত দাবি করেছে, ৭ মে তাদের চালানো হামলায় ১০০-এর বেশি ‘সন্ত্রাসী’ নিহত হয়েছেন। তবে পাকিস্তান বলছে, ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মসজিদ ও আবাসিক এলাকায় আঘাত লেগেছে, যেখানে ৪০ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। এ ছাড়া ১১ জন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন।
পাকিস্তান আরও দাবি করেছে, তারা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছে। তারা একাধিক ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।
পাকিস্তানের এসব দাবি স্বীকার বা অস্বীকার—কোনোটিই করেনি ভারত। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে তারা দাবি করছে, ভূপাতিত হওয়া যুদ্ধবিমানগুলো শনাক্ত করা গেছে।
ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন, ভারতের অন্তত একটি রাফাল যুদ্ধবিমান এবং রাশিয়ার নির্মিত একটি জেট ভূপাতিত হয়েছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা আল-জাজিরাকে নিশ্চিত করেছেন, অন্তত দুটি যুদ্ধবিমান ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভূখণ্ডে ভূপাতিত হয়েছে। তবে তাঁরা স্পষ্ট করে বলেননি, সেগুলো কোন দেশের বিমান ছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তান উভয় পক্ষই জানিয়েছে, কোনো যুদ্ধবিমান তাদের সীমান্ত পার হয়নি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ভেঙে পড়া বিমানের ধ্বংসাবশেষ থেকে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সেগুলো সম্ভবত ভারতীয় বিমানই ছিল।
ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো আসফান্দিয়ার মির আল-জাজিরাকে বলেন, যুদ্ধবিরতি এ ঘটনার পর হওয়ায় এটি পাকিস্তানের জন্য একধরনের অর্জন বলেই ধরা যেতে পারে।
আসফান্দিয়ার বলেন, বিশেষ করে যেহেতু বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা বিভিন্ন স্বাধীন উৎস থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাই পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিকে তাদের সেই সাফল্যকে সংহত করার সুযোগ হিসেবে দেখতেই পারে।
ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুহাম্মদ শোয়েব ভারতের এ হামলাকে কৌশলগত ভুল হিসেবেই দেখছেন। তিনি বলছেন, পাকিস্তানের পাল্টা জবাব দেওয়ার সক্ষমতা সম্পর্কে ভারতের মূল্যায়ন ভুল ছিল।
অবশ্য ওয়াল্টার ল্যাডউইগ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার মতো ঘটনাকে পাকিস্তানের সম্ভাব্য সাফল্য হিসেবে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এই ধরনের সাফল্যকে সর্বোচ্চ ‘প্রতীকী জয়’ বলা যেতে পারে। এটি কোনো স্পষ্ট বা নিরঙ্কুশ সামরিক সাফল্যকে প্রতিনিধিত্ব করে না।
ভারতের সাফল্য: পাকিস্তানের গভীরে হামলা
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনটা ভারতেরই হয়েছে।
৭ মে পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কোটলি ও মুজাফফরাবাদের পাশাপাশি ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের চারটি জায়গায় আঘাত হানে, যা পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা এবং অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু।
পরবর্তী দুই দিন ধরে ভারত এমন ড্রোন হামলাও চালায়, যেগুলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেক গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এমনকি লাহোর ও করাচির মতো বড় শহরের কাছাকাছিও পৌঁছে যায়।
১০ মে ভারত তিনটি পাকিস্তানি বিমানঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যেগুলো পাকিস্তানের পাঞ্জাবের ভেতরে অনেক গভীরে ছিল। এমন গভীরতায় পাকিস্তান সেদিন ভারতের কোনো ঘাঁটিকে আঘাত করতে পারেনি।
সরাসরি বললে, পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে ভারত। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথম ভারত পাকিস্তানের পাঞ্জাবে হামলা চালাতে সক্ষম হলো।
রামচন্দ্রন বলেন, কেবল নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) পার হয়ে নয়, বরং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গভীরে হামলা চালানোই ছিল ভারতের মূল লক্ষ্য। আর ভারত সেটা অর্জন করেছে।
ওয়াল্টার ল্যাডউইগও বলছিলেন, পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ভারতের এ আঘাত দেশটির প্রতিরক্ষা কাঠামোতে বড়সড় ফাঁক তৈরি করেছে।

পাকিস্তানের লাহোরের কাছে একটি এলাকার সড়কে লরিতে করে ট্যাংক নিয়ে যেতে দেখা যায়। ৭ মে, মারিদকেছবি: রয়টার্স
যুদ্ধবিরতি কি টিকবে
গত সোমবার দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তারা কথা বলেছেন। এ সময় তাঁরা যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার বিষয়ে একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা সীমান্তে মোতায়েন সেনাসংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় দফার আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে দ্বিতীয় দফার আলোচনা হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে গণমাধ্যমে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
স্টিমসন সেন্টারের গবেষক আসফান্দিয়ার মির এরপরও মনে করেন, এই যুদ্ধবিরতি টিকে থাকতে পারে।
আসফান্দিয়ার বলেন, গত এক সপ্তাহে দুই পক্ষের জন্যই যেসব বাধা ও সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা বিবেচনায় নিলে যুদ্ধবিরতিই এখন তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো পথ।
ওয়াল্টার ল্যাডউইগও এর সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, এ যুদ্ধবিরতি দুই দেশের মধ্যেই উত্তেজনা প্রশমনের আগ্রহকে তুলে ধরছে। যদিও এ যুদ্ধবিরতি সংকটের মূল কারণগুলো সমাধান করতে পারেনি।
ওয়াল্টার আরও বলেন, এই পর্বে ভারত কার্যত ‘খেলার নিয়ম’ বদলে দিয়েছে। ভারতীয় সরকার এখন আর সেই কৌশল মেনে চলছে না, যার মাধ্যমে ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি অতীতে ভারতবিরোধী ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’র ব্যাপারে দায় অস্বীকার করতে পারত।
ওয়াল্টার বলেন, পাকিস্তানের সরকার ও সেনাবাহিনী তাদের মাটিতে থাকা ‘সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো’র সঙ্গে কীভাবে আচরণ করছে, সেটাই নির্ধারণ করে দেবে এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে।
কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মুহাম্মদ শোয়েব যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখার জন্য ধারাবাহিক সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
শোয়েব সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপরই শান্তি বজায় রাখা নির্ভর করবে।
ভারত যেভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তসীমান্ত বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ করে থাকে, ঠিক তেমনি ইসলামাবাদও অভিযোগ করে থাকে, বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহকে সহায়তা করে ভারত। অবশ্য ভারত-পাকিস্তান দুই দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
শোয়েব বলেন, পরবর্তী সময়ে যেকোনো সংঘাত আরও রক্তক্ষয়ী এবং বিস্তৃত হতে পারে। যদি দুই পক্ষ দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পথে যায়, তাহলে উভয়েরই জনবহুল শহরাঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, যাতে কোনো পক্ষই প্রকৃত অর্থে লাভবান হবে না।