তামীমুল ইসলাম ফরিদী
সময়ের স্রোতে দিন, সপ্তাহ, মাস সব হারিয়ে যায় স্মৃতির আড়ালে। কিন্তু কিছু কিছু ‘দিন’ থাকে, যা হৃদয়ের পাতায় চিরকাল অম্লান থেকে যায়— যেন সে দিন-সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল, ঘড়ির কাঁটা হেঁটেছিল এক ভিন্ন ছন্দে, আত্মা হয়েছিল স্পর্শকাতর, মন হয়েছিল জেগে থাকা আকাশ।
ঠিক তেমনই এক দুপুর ছিল সেদিন। হৃদয়ের গভীরে এক ধরনের আকুলতা, আগ্রহ আর শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে পা রেখেছিলাম ঢাকার বারিধারায়। সদ্যই পরলোকগমন করেছেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রিয় মুখ, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রাহিমাহুল্লাহ। তাঁর ইন্তেকালের শোক তখনো বাতাসে ছড়িয়ে ছিল— বারিধারার আকাশ যেন নীরব, জমিন যেন ভারাক্রান্ত।
আসর নামাজ আদায় করে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। মনে মনে একটিই কামনা— যদি দেখা মেলে হাদিসের দীপ্তময় বাতিঘর, শাইখুল হাদিস আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক হাফিজাহুল্লাহর সঙ্গে। ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলাম, “হুজুর কোথায় থাকেন?” একজন শান্ত স্বভাবের ছাত্র মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “চলুন, আমি আপনাকে নিয়ে যাই।” তাঁর হাত ধরে হেঁটে পৌঁছে গেলাম সেই কামরার সামনে— দরজাটি খোলাই ছিল, তবু মন কাঁপছিল। এই যে দরজার ওপারে বসে আছেন ইলমে হাদিসের দিকপাল, তাঁর সামনে দাঁড়ানো তো শুধু সাক্ষাৎ নয়, যেন এক আধ্যাত্মিক যাত্রার সূচনা।
দরজার কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। ভেতর থেকে চোখ তুলে তাকালেন হুজুর। চেহারায় চিন্তার রেখা, চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। “আসেন,” বললেন শান্ত কণ্ঠে। ইশারায় বসতে বললেন। বসেই পরিচয় দিলাম— “আমি শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ হাফিজাহুল্লাহর ছাত্র।” এই কথাটি যেন মুহূর্তেই হুজুরের মুখে প্রশান্তির আলো এনে দিল। চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক, যেন এক পুরনো প্রিয়জনের খবর শুনলেন বহুদিন পর।
“ফরীদ সাহেব কেমন আছেন?” আমি বললাম, বেশ অসুস্থ। তিনি গভীর ভঙ্গিতে বললেন, “ওনার খবর জানি, আল্লাহ শিফায়ে কামিলা দান করুন।” সাথে সাথে দোয়ার ছন্দে ভরে তুললেন নিজের কামরা। কী নিবিষ্ট সেই দোয়া! যেন একজন মুরব্বি তাঁর প্রিয় ভাইয়ের জন্য আকুল হয়ে রবের দরবারে আকুতি জানাচ্ছেন।
এরপর চললো এক দীর্ঘ অথচ মুহূর্তের মতো ক্ষণ— আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত এক হৃদয়গ্রাহী, প্রজ্ঞাভরা আলোচনা। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ফরীদ সাহেব হুজুর— তাঁর প্রতি হুজুরের সম্মান, মহব্বত, আস্থা আমার অন্তরকে আলোড়িত করল।
হুজুর বললেন, “তোমার উস্তাদ এমন একজন দেওবন্দী অনুসারী, যার ভেতরে আকাবিরদের রূহ কাজ করে। উনি কেবল দেওবন্দের নামধারী নন, বরং দেওবন্দের ভাবধারাকে জীবিত রেখেছেন নিজের আমল, আখলাক, চিন্তাচেতনায়। এমন দেওবন্দী হওয়া সহজ কাজ নয়। তুমি গর্ব করতে পারো, তুমি তাঁর ছাত্র।”
এরপর তিনি বললেন কিছু উপদেশ— যেন একজন অভিজ্ঞ দরবেশ তাঁর কুদসীয় বাতাসে আমার মন ছুঁয়ে যাচ্ছেন:
১. ফরীদ সাহেব হুজুরের আদর্শকে লালন করবে। তাঁর চিন্তা ও পথনির্দেশকে জীবনের রাহবার মনে করবে।
২. তাবলীগ জামাতের সঙ্গ নেবে, আলেমদের কাজ মসজিদ-দরসের গণ্ডি পেরিয়ে মেহনতের মাঠে ছড়িয়ে পড়া উচিত।
৩. সেই বাতেল দল ও চিন্তাধারার লোকদের থেকে দূরে থাকবে, যারা আকাবিরের নাম নেয় অথচ তাদের মানহাজ ও আদর্শকে বিকৃত করে।
২
চায়ের কাপ এল। হালকা চুমুকে চললো মজলিসের শেষভাগ পর্যন্ত। আলোচনার মাঝে যেন এক আধ্যাত্মিক প্রশান্তি বিরাজ করছিল। বিদায়ের পূর্ব মুহূর্তে মাথাটা বিনয়ের সাথে এগিয়ে দিলাম, যেন হুজুরের হাতের দোয়ার ছায়া মাথায় পরি। তিনি স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, ঠোঁটে দোয়ার মৃদু ফিসফাস। হাত বাড়ালাম মুসাফাহার জন্য, হুজুর তাঁর স্বভাবের বাইরে গিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিলেন। এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল সারা দেহমনে। সে মুহূর্তে মনে হলো— আমি যেন কোনো আধ্যাত্মিক গাছের ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছি। সে আলিঙ্গনের উষ্ণতা আজো হৃদয়ে রয়ে গেছে, চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করি।
এই সফর থেকে এক মহামূল্যবান শিক্ষা পেয়েছি— আকাবিরদের মাঝে বিভাজন নেই, বরং এক দুর্লভ ঐক্য আছে। বাহিরের চোখে যে দেয়াল দেখা যায়, তা কেবল মানুষের কল্পনা। বাস্তবতা হলো— উবায়দুল্লাহ ফারুক হুজুরের মতো মনীষীরা শাইখুল ইসলাম ফরীদ সাহেব হুজুরদের প্রতি রাখেন অন্তরের মহব্বত, এক নিবিড় সম্মান।
আমরা যারা এই যুগের তালিবে ইলম, আমাদের দায়িত্ব— আকাবিরদের মধ্যকার মহব্বতের বার্তাগুলো পৌঁছে দেওয়া, বিভেদের দেয়াল নয়, ভালোবাসার সেতু নির্মাণ করা।
পরিশেষে একান্তভাবে দোয়া করি— আল্লাহ তাআলা শাইখুল হাদিস আল্লামা উবায়দুল্লাহ ফারুক হাফিজাহুল্লাহ-কে সুদীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন, তাঁর ছায়া আমাদের মাথার ওপর রাখুন, উভয় জগতে সম্মান ও মর্যাদার জীবন দান করুন। আর আমাদের সকলকে আকাবিরদের দেখানো হকপথে অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
লেখক: প্রিন্সিপাল, প্রাবন্ধিক, সংগঠক ও সু-বক্তা।