আল্লামা ফরিদ আহমদ সাহেব রহমাতুল্লাহি আলাইহি। রুপসা হুজুর নামে যিনি খ্যাত ছিলেন। আমার প্রাণপ্রিয় ওস্তাদ। সুন্নতে নববীর জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি। যার পুরো জীবনে সুন্নত তো দূরের কথা , একটি মুস্তাহাবের খেলাফ কখন হয়নি। আমি দীর্ঘ আট বছর হুজুরের রুমে থেকে প্রত্যেকটি সিগাত বা গুণাবলীর উপরে গবেষণা করার চেষ্টা করেছি। হুজুরের চলাফেরা, মুয়ামেলা-মুয়াশ্যারাত , দরস তাদরিস — জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে হুজুর সবসময় সুন্নতকে ফলো করতেন। সুন্নাতের খেলাপ কোন কাজ করতেন না।
গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় দীর্ঘ ১৩ বছরের অধ্যায়নকালে আমি কখনো হুজুরকে দ্বিতীয় কাতারে নামাজ পড়তে দেখিনি। আজান হয়ে গেলে হুজুরের মনের ভিতর কেমন যেন একটু অস্থির ভাব প্রকাশ পেত ।
হুজুর যখন বাসা থেকে বের হতেন— মাথা নিচের দিকে দিয়ে খুব ধীরে ধীরে আস্তে আস্তে সামনের দিকে অগ্রসর হতেন। তাঁর সামনে অগ্রসর হওয়ার মধ্যেও চিন্তাভাবনার কারজ করত। আমি সামনে যে পা টা রাখবো— যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
হুজুর ছিলেন ফেরেশতাতুল্য একজন মানুষ। হুজুর সব সময় পরিপাটি পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করতেন।
হুজুর কখনো ঢালাওভাবে যেকোনো ছাত্রকে রুমে রাখতেন না। একটা ছাত্রকে রুমে রাখার ব্যাপারে তার আমল আখলাক, ওঠা বসা, চলাফেরা এবং পড়ালেখা— সর্বদিক বিবেচনা করে এরপরে হুজুর রুমের ছিট দিতেন।
হুজুরের দরস ছিল আকর্ষণীয় — যখন দরসে আসতেন এমনভাবে ছাত্রদেরকে পড়াতেন, একটা গভী থেকে গভী ছাত্র হুজুরের পড়া বুঝত। পড়ানোর সময়ও হুজুর খুব ধীরে ধীরে শব্দ শব্দে ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়াতেন । তাড়াহুড়া করে দ্রুত ছাত্রদেরকে অবুঝ রেখে কখনো হুজুর সামনের দিকে অগ্রসর হতেন না।
হুজুরের কাছে তাইসিরুল মুবতাদি, হেকায়েতে লতিফ, তরজমায় কোরআন ১ থেকে ১৫ পারা ও বুখারী সানি পড়ার সৌভাগ্য নসিব হয়েছে। হুজুর মাঝে মাঝে ছাত্রদেরকে বোঝানোর জন্য ছোট ছোট শিক্ষনীয় গল্প বলতেন। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।
২
হুজুরের একটি অভ্যাস ছিল রাতের খানা হুজুর এশারের আগেই সেরে নিতেন। তারপর এশারের নামাজ জামাতের সহিত আদায় করে , কারো সাথে কোন কথা না বলে, সোজা বাসায় গিয়ে বিশ্রামে চলে যেতেন। তাহাজ্জুদের ঠিক সময়ে জেগে যেতেন ।
একবার হুজুর আমাদের রুমের সকলকে বললেন, তোমার আম্মা বাড়িতে নাই । চলো, আমরা সকলেই বাসায় একদিন একটা পার্টি করি। হুজুর এতটাই ছাত্রদের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন যে ছাত্রদেরকে পড়ালেখার পাশাপাশি একটু বাক স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
আমি , আবু হানিফ , মোহাম্মদউল্লাহ, খালিদ, জুবায়ের , আবু সালেহ ও আমিন ভাইকে নিয়ে বাজার করে বাসায় ডেকে নিলেন। আমি ছিলাম পাচক। রান্না শেষে খুব মজা করে হুজুরের বাসায় খেয়েছিলাম।
হুজুরকে নিয়ে আমার মত অধমের লেখার কোন যোগ্যতাই নেই । হুজুরের বাস্তব জীবন যখন আমার সামনে প্রস্ফুটিত হয় — আমি আবেগে আপ্লুত হই। ভাষা হারিয়ে ফেলি, কিছু লিখতে পারি না । মনে হয়, যেন আমার জীবনের কি যেন হারিয়ে গেছে— যা কখনো পূরণীয় নয়।
৩
আজ রাতে স্বপ্নে দেখলাম , রুপসা হুজুর জুমার নামাজের পরে রুমে এসে চেয়ারে বসেছেন। হুজুরের টেবিলের উপরে সব সময় একটা পানির গ্লাস থাকত। রুমে ঢুকেই পানি পান করতেন। স্বপ্নেও তাই করলেন। আমি দেখছিলাম। আমাদের এক ছোট ভাই মাওলানা জাহিদুল ইসলাম, কোদালিয়া বাড়ি — তিনি এখন মাহমুদ কান্দা মাদ্রাসায় খেদমতে আছেন। দেখলাম, হুজুর পানি পান করবেন — জাহিদের কাছে পানি চেয়েছেন তো জাহিদ গ্লাস তালাশ করছে — কিসে পানি দিবে । আমি জাহিদকে বললাম, হুজুরের টেবিলের উপরে সব সময় একটা কাচের মগ থাকে, সেই মগ কোথায় ?
জাহিদ বলল, রুমে এসে মগ পাইনি। জাহিদকে বললাম, তুমি মগ বাজার থেকে একটি কিনে আনবা, যা খরচ হয় সাথে আমি থাকবো ইনশাআল্লাহ। এরপরে দীর্ঘক্ষণ হুজুরের সাথে বিভিন্ন ধরনের কুশলাদি বিনিময় হল। হুজুরের যে ইন্তেকাল হয়েছে— এটা ভাবতেই পারছি না। হুজুর আগের মত স্বাভাবিক অবস্থায় রুমে আসছেন মোতায়ালা দেখার নিয়তে। আরো কিছু কথা হুজুরের সাথে হল — যা এখানে উল্লেখ করলাম না।
তখনই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত তিনটা বাজে। ঘুম ভাঙার পর এতটা খারাপ লাগছিল— যা বলার বাহিরে। শুধু হুজুরের কথা মনে পড়তেছে। হুজুরকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতেই পারছি না।
হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রাণপ্রিয় ওস্তাদকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করো।
লেখকঃ ইমাম ও খতীব, বলাকইড় ট্যাম্পু স্ট্যান্ড জামে মসজিদ, গোপালগঞ্জ