সময় চলে যায়, আর মানুষ ইতিহাসের অংশ হয়। একদিন সবাই সবাইকে ভুলে যায়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। কিন্তু কিছু মানুষ এমন থাকেন, যাঁদের স্মৃতি কখনো বিস্মৃত হয় না। তাঁরা জাতির বাতিঘর, অন্ধকারে দিশারী। তেমনই এক প্রথিতযশা মনীষী ছিলেন মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.।
তিনি ছিলেন সেই আলোকবর্তিকা, যিনি কওমী মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা—বিশেষ করে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় রেখেছেন অসামান্য অবদান। মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ. ছিলেন একাধারে আলেম, সংগঠক, নীতিনির্ধারক এবং এক দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব।
তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় বেফাক পেয়েছিল এক নতুন দিগন্তের স্বাদ। তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাপন, আন্তরিকতা ও সহজাত স্বাতন্ত্র্যবোধ ছাত্র, শিক্ষক ও সহকর্মীদের হৃদয়ে অমোচনীয় রেখাপাত করতো। স্বজন পরিচয়ে তিনি ছিলেন আমার বড় কাকা। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু দিক আলোচনা করব।
অনাড়ম্বর জীবনযাপন
শ্রদ্ধেয় চাচাজান ছিলেন প্রকৃত অর্থে এক দরবেশপ্রবণ, অনাড়ম্বর জীবনের জীবন্ত উদাহরণ। উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকলেও জীবনে কখনো বাহুল্য, বিলাস কিংবা অর্থবিত্তের মোহ স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে। চাইলেই তিনি বিত্ত-বৈভবের উচ্চশিখরে আরোহন করতে পারতেন, কিন্তু সে লোভাতুর পথে চলার দুর্দমনীয় ব্যধিতে তিনি আক্রান্ত হননি। অথচ তাঁর চেয়ে অনেক কম খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিরাও নিজেদের জন্য ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বরং আখেরাতের অনন্ত জীবনের মূল্যই বুঝেছেন সর্বাধিক।
মেহমান নেওয়াযি ও আপ্যায়ন
মাওলানা আবুল ফাতাহ রহ.-এর আরেকটি স্মরণীয় গুণ ছিল তাঁর অসাধারণ মেহমানদারি। তিনি আলেম-উলামা, ছাত্র-শিক্ষক—সবার আপ্যায়নে ছিলেন সমানভাবে আন্তরিক ও আগ্রহী। অতিথি এলে তিনি নিজেই বাজার করে আনতেন। রান্নার কৌশল বলে দিতেন এবং আপ্যায়নের প্রতিটি ধাপে অংশগ্রহণ করতেন। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও অসুস্থতা সত্ত্বেও মেহমানদের সম্মানে কোনো কমতি রাখতেন না। ধনী-গরিব, বড়-ছোট—সবার প্রতি তাঁর সম্মান ও ভালোবাসা ছিল সমান।
২০১৪ সালের কথা। মধুবাগ নয়াটোলা আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে দুই দিনব্যাপী সীরাত মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রথম দিনের প্রধান বক্তা হিসেবে দাওয়াত করা হল মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.)-কে। তিনি তখন সাহারা কুড়িল কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন এবং মসজিদ লাগোয়া বাসায় থাকতেন।
মাহফিলের দিন আমাকে তাঁকে বাসা থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমি আসরের নামাজ তাঁর মসজিদে পড়লাম এবং নামাজ শেষে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করি। তিনি প্রস্তুত হয়ে আসলেন। আমরা একটি সিএনজি করে প্রথমে চৌধুরীপাড়া মাদরাসায় গেলাম। মাগরিবের পর তাঁর সাথে মাহফিলের স্থানে পৌঁছাই। যেহেতু মাহফিলটি রাসুলের সীরাতের উপর ছিল, তাই তিনি রাসুলের জন্ম থেকে শুরু করে সীরাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে অত্যন্ত চমৎকার আলোচনা করলেন। সহজ-সাবলীল ভাষায় তাঁর বক্তৃতা শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিল।
মাহফিল শেষে ফেরার পথে আমি তাঁর জন্য সিএনজি ভাড়া করতে চাইলে তিনি বারণ করে বললেন, “আমি বাসে করেই যেতে পারবো।” তাঁর কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। তখন তিনি লাঠি হাতে চলাফেরা করতেন এবং লাঠি ছাড়া হাঁটতে কষ্ট হতো। এমন শারীরিক অবস্থা সত্ত্বেও তাঁর এই সহজ-সরল, অনাড়ম্বর জীবনযাপন দেখে আমি হতবাক। আরও অবাক হলাম যখন দেখলাম, তিনি তাঁর প্রাপ্ত হাদিয়ার একটি অংশ আমাকে দিয়ে বাসে উঠতে উঠতে বললেন, “ঠিক আছে মাদরাসায় চলে যাও আর এটা তোমার হাদিয়া।” তিনি কথাগুলো বলতে বলতেই বাস ছেড়ে দিল। আমি সেই মুহূর্তে একজন মহান, দরাজ দিলের ব্যক্তির শূন্যতা অনুভব করলাম।
ছোটদের প্রতি মহানুভবতা
তাঁর মহানুভবতার আরও একটি গল্প মনে পড়ে। ২০০৮ সালের কথা, তখন আমি খিলগাঁও বায়তুত তাকওয়া আনসার কোয়ার্টার জামে মসজিদের অধীনে একটি হিফজ বিভাগে পড়তাম। মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহ.) তখন এই মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন, এবং তাঁর বাসা ছিল মসজিদের পাশেই।
বৃহস্পতিবার মাগরিবের নামাজের পর তিনি মাঝে মাঝে তাঁর ছোট দুই ছেলে জায়েদ, শাকের এবং আমাকে নিয়ে বসতেন। তিনি একে একে সবার পড়া শুনতেন এবং বলতেন, “আজকে তোমার পড়াটা বেশি ভালো হয়েছে।” আরেকদিন হয়তো অন্য কাউকে বলতেন, “আজ তোমার পড়া সুন্দর হয়েছে।” এভাবে তিনি একজনের প্রশংসা করে অন্যদেরকে উৎসাহিত করতেন। এই ধরনের উৎসাহমূলক বৈঠক তিনি নিয়মিত করতেন।
আমাদেরকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন গল্প শোনাতেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেগুলো শুনতাম, অনুভব করতাম এবং হৃদয় দিয়ে ধারণ করতাম। গল্পগুলো বলার সময় আবেগ, আনন্দ ও ভাবের তরঙ্গে তাঁর চোখ দুটি ছলছল করত। তাঁর কথাগুলো শুনে আমার হৃদয়ে নতুন ভাবনার উদয় হতো, মনে হতো আমার স্বপ্ন আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ হেসে বেড়াচ্ছে। ভাব, ভাবনা, আবেগ আর অনুভূতি সব যেন একাকার হয়ে যেত।
তাঁর কথার মধ্যে ছিল হৃদয়ের গভীর স্পর্শ। মুখে লেগে থাকত সুমিষ্ট হাসি, আর চেহারায় ছিল অভিভাবকত্বের এক দরদী ছাপ। যখন তিনি তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো বলতেন, তখন আমরা যেন এক অজানা অচিন দেশে হারিয়ে যেতাম, দূরে, বহু দূরে। অবলোকন করতাম আবেগের তরঙ্গ উচ্ছ্বাস এবং হৃদয় ও আত্মার আলোক উদ্ভাস।
তাঁর লেখা বইগুলো হাতে নিয়ে তিনি আমাদেরকে বলতেন, “তোমাদেরকেও কিন্তু একদিন লিখতে হবে। পথহারা জাতিকে শোধরানোর গুরুদায়িত্ব তোমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে।” তাঁর এই উৎসাহমূলক উপদেশবাণী শুনে আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া সাহস খুঁজে পেতাম। বৈঠক শেষে তিনি আমাদেরকে নিয়ে খেতে বসতেন এবং অনেক সময় নিজেই খাবার পরিবেশন করতেন।
জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখি
মাওলানা আবুল ফাতাহ (রহ.) ছিলেন একজন অসাধারণ চিন্তাশীল ও শক্তিমান লেখক। ধর্ম, সমাজ, আইন, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো বহু জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি তাঁর কলম চালিয়েছেন। তাঁর রচনাগুলো পাঠকের চিন্তাজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করত এবং বাস্তব জীবনের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করত।
তাঁর অনবদ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অবদান
- স্রষ্টা ও তাঁর স্বরূপ সন্ধানে
- ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ণ
- আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইসলাম
- হাদিস অধ্যয়নের মূলনীতি
- ইসলামি আইন ও বিচার ব্যবস্থা
- ইসলাম ও যৌনবিধান
- ইসলাম ও সমাজব্যবস্থা
- জেগে উঠো হে ঘুমন্ত শতাব্দি! (কাব্যগ্রন্থ)
এছাড়াও, তিনি বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ অনুবাদও করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে:
- ব্যবহারিক জীবনে আল-কুরআন
- আল-কুরআনের নিষিদ্ধ বিষয়
- পার্থিব জীবনে ইসলাম
- দৈনন্দিন জীবনে কুরআন-সুন্নাহর দোয়া ও দরুদ
- মহাপ্রলয় ও শেষ বিচার
- আমেরিকায় ইসলামের দাওয়াত
শেষকথা
বহু প্রতিভার অধিকারী এই মহামনীষীর বিদায়ের আট বছর অতিক্রান্ত হলো গতকাল। ২০১৭ সালের ২০ মে, তিনি রফিকুল আ’লা’র ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্তকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পরিশেষে বলবো, আমরা যেন তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, নিষ্ঠা ও কর্মচেতনাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিই। কওমী শিক্ষার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা, ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি অবিচল অঙ্গীকার আমাদের জন্য যুগান্তকারী অনুপ্রেরণা হয়ে থাকুক।
আল্লাহ তাআলা প্রিয় চাচাজিকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।
লেখকঃ ইমাম ও খতীব, সিকদার রিভারভিউ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, পশ্চিম ধানমন্ডি; মুহাদ্দিস , মাদরাসাতুস সাহাবা রা. পশ্চিম ধানমন্ডি ঢাকা