কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিছবি: রয়টার্স
ফিলিস্তিনের গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে সম্প্রতি ইউরোপের দুটি দেশের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে কানাডা। দেশটির এই বিবৃতি ইসরায়েল প্রশ্নে নতুন সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সঙ্গে যৌথ এক বিবৃতিতে কানাডা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছে। গাজাবাসীর দুর্ভোগকে তারা ‘অসহনীয়’ ও ইসরায়েলের দেওয়া সীমিত সহায়তাকে ‘সম্পূর্ণ অপর্যাপ্ত’ বলে উল্লেখ করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামাসের নেতৃত্বে দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার জবাবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়াকে ‘অতিমাত্রায় অসম’ ও ‘জঘন্য’ বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইসরায়েল এখন পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৫৪ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সংখ্যার বাইরে আরও অনেক ফিলিস্তিনি রয়ে গেছেন। সুতরাং গাজায় নিহত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
এই তিন দেশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা গাজা পরিস্থিতি নিয়ে ‘চুপ করে থাকবে না’ এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলি দখলদারদের হামলা ও ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ‘সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞাসহ আরও পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না’।
তিন দেশের এই বিবৃতি নিয়ে হামাস প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা এটিকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের নীতিমালা পুনরুদ্ধারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে। হামাস বলেছে, এই নীতিমালা নেতানিয়াহুর ‘সন্ত্রাসী সরকার’ অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে।
তিন দেশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা গাজা পরিস্থিতি নিয়ে ‘চুপ করে থাকবে না’ এবং পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলি দখলদারদের হামলা ও ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় ‘সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞাসহ আরও পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না’।
গত বুধবার ইউরোপীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চার কানাডীয় কূটনীতিক অধিকৃত পশ্চিম তীর সফরে গেলে ইসরায়েলি সৈন্যরা তাঁদের ওপর গুলি চালান। এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডা ‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত’ ও ‘তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা’ দাবি করেছে। তারা ওই ঘটনাটিকে ‘সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছে। ইসরায়েল শুধু এটুকুই বলেছে, ‘এই ঝামেলা তৈরি হওয়ায় তারা অনুতপ্ত।’
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ অনেক দিন ধরেই ইসরায়েলের সমালোচক। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই সপ্তাহে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছেন এবং ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।
অন্যদিকে কানাডা আগে ইসরায়েলের সমালোচনা করলেও তা সাধারণত খুব সংযত এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে মিল রেখে চলেছে। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
কানাডার আইনের অধ্যাপক ও জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি মাইকেল লিঙ্ক বলেন, স্বীকার করতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যে ‘মধ্য শক্তি’ হিসেবে কাজ করে থাকে কানাডা। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তাঁর দেশ কাজ করে।
মাইকেল লিঙ্ক আরও বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েলের বিষয়ে আমি অনেক দিন ধরে কানাডার কাছ থেকে এ রকম ভাষা শুনিনি। সম্ভবত কখনো না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কানাডার সাবেক এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, এটি এক নতুন সুর, যা আগে দেখা যায়নি।
এখন কেন এই অবস্থান
কানাডার সাবেক ওই কর্মকর্তা বলেন, কানাডা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া ঠিক করার আগে সাধারণত ওয়াশিংটনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুটি কানাডায় তীব্র জনমত তৈরি করে, যার জন্য তাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়।
কিন্তু গাজায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে অবরোধ, অবকাঠামো ধ্বংস এবং কানাডায় নতুন নেতৃত্ব—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বদলে গেছে।
নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি একজন ঝানু অর্থনীতিবিদ এবং তিনি রাজনীতির বাইরের মানুষ ছিলেন। এখন এই সংকটময় মুহূর্তে তিনি অনেক বেশি সরাসরি বক্তব্য দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য যাদের ইসরায়েলের ওপর যথেষ্ট প্রভাব আছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন একধরনের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে চলছে এবং ইসরায়েল থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছে। এককভাবে তারা হামাস, ইয়েমেনের হুতি ও ইরানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
মাইকেল লিঙ্ক বলেন, ‘মানবিক বিপর্যয় এখন এতটাই গভীর ও সংকটপূর্ণ যে সম্ভবত মার্ক কার্নি এই পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছেন এবং সময়ের দাবি মেনে যথাযথভাবে সাড়া দিয়েছেন।’
মাইকেল লিঙ্ক বলেন, কার্নি এর আগে কখনো নির্বাচনে অংশ নেননি। তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এবং ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর ছিলেন। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, তিনি কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপীয় মিত্রদের কাছাকাছি দেখতে চান।
এই অধ্যাপক বলেন, জাস্টিন ট্রুডোর মতো কার্নির কাঁধে ততটা রাজনৈতিক বোঝা নেই, বিশেষ করে প্রধান প্রধান ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় নিয়ে।
লিঙ্ক ব্যাখ্যা করে বলেন, কানাডা কখনো অর্ধেক পদক্ষেপও নেয়নি, তারা তার চেয়েও কম এক–চতুর্থাংশ পদক্ষেপ নিয়েই সন্তুষ্ট থেকেছে। ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে চলতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে কানাডা বরাবরই পিছিয়ে ছিল…আসল পরীক্ষা হবে কতটা শক্তিশালী পদক্ষেপ তারা নেয়, সেটাই।
সরকারের এক কর্মকর্তা মিডল ইস্ট আইকে বলেন, কানাডা যখনই অবস্থান নেয়, সেটা প্রায় সব সময়ই আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়, এটিই তাদের পররাষ্ট্রনীতির সাধারণ নিয়ম। তিনি আরও যোগ করেন, কানাডা যখন কথা বলে, তখন একা দাঁড়ায় না।
মাইকেল লিঙ্ক বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, গত সোমবার দেওয়া বিবৃতিটি আংশিকভাবে এসেছে এই কারণে যে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পাশে থেকে তারা রাজনৈতিকভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চেয়েছে।’

গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলায় প্রায় ৫৪ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে ধুলায় মিশে যাচ্ছে একের পর এক অবকাঠামোছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব-নিকাশ
গাজায় ইসরায়েলের ১৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) সম্ভাব্য গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এটিকে সরাসরি গণহত্যা বলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য যাদের ইসরায়েলের ওপর যথেষ্ট প্রভাব আছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসন একধরনের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে চলছে এবং ইসরায়েল থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছে। এককভাবে তারা হামাস, ইয়েমেনের হুতি ও ইরানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ডেমাক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাউ (ডিএডব্লিউএন) সংস্থার অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর রায়েদ জারার মিডল ইস্ট আইকে বলেন, কানাডার এই জোরালো বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতি একটি বার্তা পাঠায় যে তারা আর শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকবে না।
জারার বলেন, অতীতে অনেক মার্কিন মিত্রদেশ ইসরায়েলের সমালোচনা করতে দ্বিধা করত। কারণ, তারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয় দেশের প্রতিশোধের বিষয়ে ভয় পেত।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েলের বিষয়ে আমি অনেক দিন ধরে কানাডার কাছ থেকে এ রকম ভাষা শুনিনি। সম্ভবত কখনো না
মাইকেল লিঙ্ক, কানাডার আইনের অধ্যাপক
কিন্তু এখন গাজা এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে, যা আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ইসরায়েলপন্থী লবিগুলো কানাডায় প্রভাবশালী হলেও তারা কিন্তু ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় না’।
কানাডার সাবেক কর্মকর্তা বলেন, কানাডার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থ ও অনুদানের বিষয়ে অনেক ভারসাম্য রয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়, যেখানে প্রায় অবারিত স্বাধীনতা রয়েছে।
সবশেষ কথা হচ্ছে, কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে যাঁরা কথা বলেছেন তাঁরা সবাই একমত, এখন শুধু কথা নয়, বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন।
রায়েদ জারার বলেন, গাজায় অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কারণ, এখানে শুধু ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা এবং গাজার মানুষের খাবারের অধিকারের প্রশ্ন নয়। এটি আন্তর্জাতিক আইনশৃঙ্খলারও প্রশ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী যে বিশ্বশান্তি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা আজ হুমকির মুখে পড়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি ছিল জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা, কানাডা শুরু থেকেই যার সদস্য। কানাডা এখনো ফিলিস্তিনিদের সহায়তাকারী জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএকে অর্থায়ন করে যাচ্ছে।