Home মুক্ত গদ্যস্মৃতিগদ্য । শৈশব একটি রঙিন ঘুড়ি

স্মৃতিগদ্য । শৈশব একটি রঙিন ঘুড়ি

by .
স্মৃতিগদ্য । শৈশব একটি রঙিন ঘুড়ি

শৈশব, ছোট একটি শব্দ। তবে তার সাথে কত শত আবেগ এবং অনুভূতি মেখে আছে! শৈশব শব্দটা শুনলেই বাঁধনহারা এক জীবনের কথা মনে পড়ে। হারিয়ে যাই দূর অতিতে। শহর পাড়ি দিয়ে গ্রামের কোনো এক মেঠো পথে। 

শৈশবের দুরন্তবেলায় কতো রঙে দেখেছি জীবনকে। কত ঢঙে উপভোগ করেছি জীবনকে। রঙধনুর সাত রঙে একেছি জীবনের ছবি। নানা রকমের দিনগুলো। শৈশব মানেই দুরন্তপনা। শৈশব মানেই স্মৃতি ও স্বপ্ন-জাগানিয়া সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাটানো সময়। সেই হারানো ধুলোমাখা দিনগুলো আজো রঙিন হয়ে ভেসে উঠে স্মৃতির  ক্যানভাসে।

আমি শৈশবে পেয়েছিলাম গ্রামীণ আবহে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়ানো নেত্রকোনা জেলার জাগির পাড়া গ্রাম। মেঠো পথ বিশিষ্ট একটি গ্রামীণ পল্লী। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। আমার গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি গাঙ। অপর পাশে রয়েছে একটি বিল। আরেকপাশে দিগন্তজোড়া ফসলি মাঠ। আরেক পাশে বিভিন্ন রঙে মোড়ানো ছোট ছোট ঘর বাড়ি। পুরো গ্রামীণ পরিবেশে কেটেছে আমার শৈশব। 

কতো রঙিন ছিল শৈশবের দিনগুলো। দুরন্তপনায় ভরপুর। পুকুরে গোসল করেছি দলবেঁধে। আবনা বিলে শাপলা তুলেছি মুঠোয় মুঠোয়। আহ, এখনো কল্পনাতেই অন্যরকম একটা তৃপ্তি পাই!

শৈশবের ফেলে আসা কিছু খেলা আজো দোলা দিয়ে যায় মনপ্রাণে। শৈশবের খেলাগুলো যেমন ছিল জনপ্রিয় তেমনি স্মৃতিমধুর। শৈশবের দুরন্তপনায় শারীরিক ও মানসিক বিকাশও হয়েছে। গ্রামীণ খেলা আমাদের আদি ক্রীড়া সংস্কৃতি। একসময় গ্রামীণ খেলাধুলা আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করতো। 

বাড়ির পশ্চিম ও উত্তরে ছিল দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। ছেলে বেলায় ফসলের মাঠকে বন্দ বলতাম। দক্ষিণ বন্দে ঘুড়ি উড়াতাম। মাঠে ফুটবল, মার্বেল ও লাটিম খেলতাম।রাস্তায় সাইকেল কিংবা গাড়ির টায়ারকে লাঠি দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে তার সঙ্গে ছুটে চলতাম দুরন্তগতিতে। চালাতাম সুপারি গাছের পাতার গাড়ি। সুপারি গাছের শুকনা পাতার গাড়িতে বসে থাকতাম, সামনে ধুলো উড়িয়ে সেটা টেনে নিয়ে ছুটতো অন্যজন। 

মনে আছে বিয়ারিং গাড়ির কথা। সাইকেল বা রিকশার বিয়ারিং ও কাঠ দিয়ে বানানো গাড়ির কথা কখনো ভুলার নয়। দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো। গাড়িতে ওঠার জন্য লাইন ধরা। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটে বেড়ানো দিনগুলো এখনো শৈশব মনে করিয়ে দেয়। ইট পাথরের শহরে বসে সেসব দিনের কথা ভাবলে শিহরিত হই। আহা, কত ঝলমলে দিনগুলো! 

খেলেছি অনেক খেলা। শৈশবের জনপ্রিয় সব খেলা। এ খেলায় বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে উঠতাম আমরা। ধম নিয়ে হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্দাও খেলেছি। কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ… এ খেলার নাম শুনে নাই, এমন ছেলে পাওয়া যাবে খুব কম। আমরা ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে এ খেলায় মেতে উঠতাম।

ওপেন-টু-বায়োস্কোপ, নাইন টেন তেইশ কোপ, সুলতানা বিবিয়ানা, সাহেব-বাবুর বৈঠকখানা……………। এ লাইনগুলো মনে হলেই ফেলে আসার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

কখনো খেলেছি চোর-পুলিশ। চার টুকরো কাগজ। একেকটিতে নম্বরসহ লেখা “চোর” “পুলিশ” “ডাকাত” আর “বাবু”। মামুলি সেই কাগজগুলো নিয়েই কেটে যেতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কে চোর হচ্ছে আর কেই-বা বাবু, সেটা নিয়ে অনেক সময় ঝগড়া বেঁধে যেতো। সেই ঝগড়া ছিল কষ্টের মাঝে লুকিয়ে থাকা সুখ। অন্যরকম একটা আনন্দের। 

ছেলেবেলায় আরেকটি মজার খেলা ছিল মুদি দোকান। লাঠি ও নারকেল কিংবা গাছের পাতার ছাউনি দিয়ে বানানো হতো এ দোকান। দাদা বা আব্বার কাছ থেকে লজেস (চকলেট) কেনার জমানো টাকায় পুঁজি ছিল এ ব্যবসার। আব্বার কাছে ভাংতি কোন টাকা থাকলে সব নিয়ে যেতাম। তা দিয়ে ক্রয় করা হতো মুদিপণ্য। পরে নানারকম মুদিপণ্য বন্ধুদের কাছে বিক্রি করাই ছিল এ খেলার মজা।

এছাড়াও আরও নানান রকম খেলা খেলছি। নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের এসব খেলা আজ বড়ই অচেনা। আমাদের গ্রামে একসময় প্রচুর খেলাধুল ছিল। শীতের মৌসুম এলে খুব জমজমাট খেলাধুলা হত। অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। 

স্কুল পালিয়ে ফুটবল, ক্রিকেটবল খেলতে যেতাম। সারাদিন মজে থাকতাম খেলায়। খাওয়া-দাওয়ার কথাও ভুলে যেতাম। গোসল করা তো আরো দূর কি বাত।  

হায়রে কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী দিনগুলো আমার। শৈশবের কথা মনে পড়লে আজো অন্যরকম এক ভাবনায় ভুগি। স্মৃতির ডানায় ভর করে ফিরে যায় বার বার দুরন্ত শৈশবে।

স্কুলের পড়া চাপিয়ে এক সময় মাদরাসায় চলে যাই। নূরানী মক্তবের এক স্বর্ণালী পরিবেশে। শুরু হয় অন্যরকম নতুন এক পথ চলা। তবে খেলাধুলা থেমে থাকেনি। আগের মতই চলতে থাকে। আসরের নামাজ পড়েই খেলাধুলায় মেতে উঠতাম। চলতো একনাগারে সন্ধ্যা পর্যন্ত। 

শীত কিংবা গ্রীষ্মের সকাল মানেই ছিল একরাশ স্বপ্ন রাঙা ভোর। তার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের ছোট ছোট পায়ে ছুটে চলা। মেঠো পথ পেরিয়ে নূরানী মকতবে। স্কুলের পড়ার চাপ তখন কাঁধে ভারী হয়ে থাকলেও, মা-বাবা ও দাদার চোখে স্বপ্ন ছিল আরেক জায়গায়। মাদসায় পড়ানো। সেই স্বপ্নের ভারই হয়তো আমাকে ঠেলে নিয়ে যেতো মকতবের পথ ধরে।

ঘুম ভাঙতো আজান শোনার আগেই। দাদা তাগাদা দিতেন আগে-ভাগে উঠতে। ফজরের নামাজ ধরতে না পারলে ধমক দিতেন। খুব কড়া ভাষায় বকা দিতেন। 

মাথায় টুপি, হাতে কায়দা আর ছোট্ট একটা কুরআন শরীফ নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। কুয়াশা তখনো নামেনি পুরোপুরি; রাস্তায় ঘরের পাশের বাতিগুলো ঝাপসা আলো ছড়িয়ে ছায়া ফেলে রাখতো মাটিতে। আমরা কয়েকজন মিলে একসঙ্গে হাঁটতাম। একেকজন একেক বাড়ির, তবু সেই মকতবের সকাল আমাদের আত্মার বন্ধনে বেঁধে রাখতো।

আজও শীত বা গ্রীস্মের সকালে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে কুয়াশা বা শিশির ছুঁয়ে দেয় সেই ফেলে আসা দিনগুলো। মনে পড়ে যায় হাতের তালুতে জমে থাকা শীত, কায়দার পাতায় আঁকা হরফগুলো। আর হুজুরের বলা সেই চিরচেনা বাণী “এই হরফগুলো তোমাকে পথ দেখাবে, তুমি একদিন বড় হবে, অনেক বড়, এই কুরআন তোমাকে অনেক দামি বানাবে “

ব্যস্ততার শহরে হারিয়ে গেছে সেই সরলতা। সেই কোয়াসা ভেজা ভোর। গ্রীস্মের তাপদাহ সকাল। তবু, কুয়াশা আর শিশির ভেজা কোনো সকালে চোখ বুজলেই দেখতে পাই, আমি সেই ছোট্ট ছেলে, হাতে কুরআন, বুক ভরা প্রশ্ন, আর মনের ভিতর একরাশ শান্তি নিয়ে হাঁটছি মকতবের পথে। সাথে অনেক বন্ধু-বান্ধব। খেলাধুলার ওই সাথীরা। 

সত্যিই, শৈশব একটা রঙিন ঘুড়ি। বাহারি রঙে সাটানো। রংগুলো কখনো মলিন হয় না। সদা থাকে অমলিন। বেঁচে থাকুক শৈশব। শৈশবের রঙিন দিনগুলো। 

লেখক : সহকারী শিক্ষাসচিব, মাদ্রাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও ঢাকা

শেয়ার করুন:

Related Articles

Leave a Comment