উন্নত জীবনের আশায় অনেক মানুষ ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় দেশগুলো থেকে ইতালিতে পৌঁছাতে চান। আর তাই অনেকেই তিউনিশিয়া এবং লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দেন। কিন্তু এই বিপজ্জনক যাত্রায় অভিবাসীদের মূল ভরসা পাচারকারীরা।
‘নিরাপদ যাত্রা’র মিথ্যা আশ্বাস দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি তারা কখনোই পূরণ করে না। ২০১৪ সাল থেকে সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরে কমপক্ষে ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে নারী ও শিশুরাও রয়েছেন।
তাদের অনেকেই পাচারকারীদের কথায় বিশ্বাস করে এই যাত্রা শুরু করেছিলেন। উদ্ধার সংস্থা এসওএস মেডিটারানের মতে, “পাচারকারীরা যে পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দেয় তার সবই মিথ্যা”।
পাচারকারীরা অভিবাসীদের যেসব মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়, তার মধ্যে রয়েছে—
১. ইতালি খুব কাছে
পাচারকারীরা অভিবাসীদের বলেন, ইতালি খুব কাছেই। তারা মাঝরাতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “ওই যে দূরে আলো দেখা যাচ্ছে, ওটাই ইতালি”। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো হয়তো সাগরে তীরে অবস্থিত বিভিন্ন তেল বা গ্যাসের প্ল্যাটফর্ম।
প্রকৃতপক্ষে লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপ প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। তিউনিশিয়ার স্ফাক্স থেকে লাম্পেদুসার দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি।
একজন অভিবাসী বলেন, তারা আমাকে বলেছিল চার ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো, কিন্তু আমি সাগরে ছিলাম প্রায় ১৫ ঘণ্টা।
২. প্যাকেজ যাত্রা
অনেক পাচারকারী এমন প্রস্তাব দেয় “আপনি একবার টাকা দিলে, যদি প্রথমবার না পৌঁছাতে পারেন, দ্বিতীয়বার বিনা খরচে যাবেন”। আইভরিয়ান নাগরিক কাসুম বলেন, “আমি প্রথম যাত্রার জন্য পাঁচশ ইউরো দিয়েছিলাম। যদি আপনি গ্যারান্টি চান, তাহলে সেটা হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার ইউরো পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়”।
কিন্তু এসওএস মেডিটারানে জানায়, এই গ্যারান্টিগুলো শুধু কথার কথা। অনেক সময় ইঞ্জিন কাজ করে না, নৌকা উল্টে যায় বা উপকূলরক্ষীরা ধরে ফেলে। তখন পাচারকারীরা আর ফোনই ধরতে চায় না।
৩. স্যাটেলাইট ফোন
অনেক পাচারকারী যাত্রীদের হাতে স্যাটেলাইট ফোন দেন যাতে বিপদের সময় সাহায্য চাওয়া যায়। কিন্তু এটা কোনো এনজিও সরবরাহ করে না। এসওএস মেডিটারানে স্পষ্টভাবে জানায়, আমরা কখনোই পাচারকারীদের সঙ্গে কাজ করি না।
তারা আরও জানিয়েছে, “আমরা অনেক সময় দেখি, যাত্রীরা ফোন পানিতে ফেলে দিয়েছেন বা ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। ফলে তারা আমাদের ফোন করে খুঁজেও পান না।”
২০২৪ সালের মার্চে এমন এক ট্র্যাজেডিতে ৬০ জনের বেশি মানুষ মারা যান, যদিও তারা স্যাটেলাইট ফোন থেকে একাধিক কল করেছিলেন।
৪. এনজিও উদ্ধার জাহাজের অপেক্ষা
অনেক পাচারকারী অভিবাসীদের বলে থাকে, “একটা এনজিওর জাহাজ অপেক্ষা করছে, ওটা আপনাদের তুলে নেবে”। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসওএস মেডিটারানে জানায়, “আমরা শুধু নির্দিষ্ট সীমানায় পেট্রল করি। সবসময় অভিবাসীদের স্থানে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়।”
খারাপ আবহাওয়া, অবস্থান না জানা অথবা যাত্রার সময় দেরি হলে অনেক সময় উদ্ধার করাও সম্ভব হয় না। ইউনিসেফ জানায়, ২০১৪ সাল থেকে প্রতিদিন গড়ে একজন শিশু সাগরে মারা যাচ্ছে।
৫. লোহার নৌকা
লিবিয়া থেকে ছাড়া নৌকাগুলোর বেশিরভাগই কাঠ, প্লাস্টিক কিংবা টিন দিয়ে তৈরি। এগুলোর নকশা, গুণগত মান কিছুই নিরাপদ নয়। ২০২৩ সাল থেকে তিউনিশিয়ার উপকূলে এক ধরনের নতুন লোহার নৌকা দেখা যাচ্ছে। দেখতে শক্ত মনে হলেও, এসব “লোহার নৌকা” আসলে খুবই দুর্বল, দ্রুত ডুবে যায়।
ইইউ সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স-এর একজন মুখপাত্র বলেন, “এই নৌকাগুলো ভাসমান কফিনের মতো।” ইনফোমাইগ্রেন্টস