কারোল নাওরোকি। ছবি : এএফপি
ইতিহাসবিদ, সাবেক অপেশাদার বক্সার ও জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত ৪২ বছর বয়সী কারোল নাওরোকি পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। ডানপন্থী ল অ্যান্ড জাস্টিস (পি আই এস) দলের সমর্থনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া নাওরোকি পেয়েছেন ৫০.৮৯ শতাংশ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী, ওয়ারশ শহরের উদারপন্থী মেয়র রাফায়েল ত্রাশকোভস্কি পেয়েছেন ৪৯.১১ শতাংশ। সোমবার চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে জাতীয় নির্বাচন কমিশন।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করেছে পি আই এস এবং এই নির্বাচনে তাদের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নাওরোকির বিজয় পোল্যান্ডের বর্তমান প্রো-ইউরোপীয় সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কের সংস্কার এজেন্ডার জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করা হচ্ছে।
নাওরোকি তার প্রচারাভিযানে বারবার বলেছেন—সমাজকল্যাণ সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা বাসস্থানের ক্ষেত্রে পোল্যান্ডের নাগরিকদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এপ্রিল মাসে এক নির্বাচনি সমাবেশে তিনি বলেন, ‘সামাজিক সুবিধা সর্বাগ্রে পোল্যান্ডবাসীর জন্য হতে হবে।’ এই বক্তব্য থেকেই তার অভিবাসনবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইউক্রেনবিরোধী অবস্থান ও জেলেনস্কিকে ‘দাম্ভিক’ বলা
নাওরোকি মে মাসে ইউক্রেনের প্রতি পোল্যান্ডের সহায়তার জন্য যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করার অভিযোগ তোলেন। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ‘দাম্ভিক’ বলে অভিহিত করেন এবং ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ প্রার্থিতার বিরোধিতা করেন। এসব বক্তব্য তাকে ইউক্রেনবিরোধী হিসেবে পরিচিতি দেয়।
নাওরোকি মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত।
মে মাসে ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় ট্রাম্প তাকে বলেন, ‘তুমি জিতবে।’ এই সাক্ষাৎকারের ছবি প্রকাশ পেলে বিতর্ক শুরু হয়। ছবিতে দুইজনকে থাম্বস আপ দিতে দেখা যায়।
সরকারি জোটের কয়েকজন নেতা এই ঘটনাকে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোয়েম পোল্যান্ড সফরে এসে এক রক্ষণশীল সম্মেলনে বক্তব্য রেখে প্রকাশ্যে নাওরোকির প্রতি সমর্থন জানান এবং বলেন, ‘তারই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়া উচিত।
অভিবাসী রোধ ও যুদ্ধক্ষতিপূরণ দাবি
নাওরোকি জার্মান সীমান্তে অভিবাসী প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানির কাছে পুনরায় ক্ষতিপূরণ দাবি তোলার পক্ষেও জোরাল অবস্থান নিয়েছেন।
প্রচারণার সময় নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নাওরোকি। জানা যায়, তিনি একাধিক ফ্ল্যাটের মালিক, যদিও তিনি দাবি করেছিলেন, তার একটিমাত্র ফ্ল্যাট আছে। অভিযোগ ওঠে, একজন বৃদ্ধের সঙ্গে জটিল চুক্তির মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় ফ্ল্যাটটি অর্জন করেন।
অন্যদিকে, একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, একসময় হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী থাকাকালে তিনি অতিথিদের জন্য যৌনকর্মী জোগাড় করতেন। এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নাওরোকি বলেন, ‘এসব মিথ্যা ও অপপ্রচার এবং তিনি সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন।’
একাডেমিক পটভূমি ও পেশাগত জীবন
বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত গদানস্ক শহরে জন্ম নেওয়া নাওরোকি ছোটবেলায় বক্সিং ও ফুটবলের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পরে ইতিহাসে পিএইচডি এবং এমবিএ করেন। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি গদানস্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক ছিলেন। এরপর ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল রিমেমব্রান্স’-এর নেতৃত্বে আছেন। তার গবেষণার বিষয় কমিউনিস্ট আমলের অপরাধ, পোল্যান্ডের প্রতিরোধ আন্দোলন ও ক্রীড়া ইতিহাস। ২০২৪ সালে পোল্যান্ডে সোভিয়েত-যুগের একটি স্মৃতিস্তম্ভ অপসারণের পর রাশিয়া তাকে তাদের ‘ওয়ান্টেড লিস্টে’ যুক্ত করে। এরপর নাওরোকি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স গ্রহণ করেন।
বই লেখা ও ছদ্মনাম বিতর্ক
২০১৮ সালে কমিউনিস্ট আমলের অপরাধজগতের কুখ্যাত চরিত্র নিকোডেম স্কোতারচাককে নিয়ে তিনি ছদ্মনাম ‘তাদেউস বাতির’ নামে একটি বই লেখেন। ওই বছর রাষ্ট্রীয় টিভিতে একজন ‘বাতির’ নামে ব্যক্তিকে দেখানো হয়, যিনি দাবি করেন, নাওরোকির অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছেন। পরে জানা যায়, বাতির ও নাওরোকি আসলে একই ব্যক্তি। বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করে এবং এটি আত্মপ্রকাশের কৌশল বলে অভিযোগ তোলে।
নাওরোকি ইংরেজি বলতে পারেন, এখনও অবসর সময়ে বক্সিং করেন এবং নিজেকে ‘এই কঠিন সময়ে পোল্যান্ডের জন্য দরকারি একজন শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট’ বলে দাবি করেন। তিনি তার স্ত্রী মার্তা, দুই সন্তান এবং এক সৎপুত্রকে নিয়ে বসবাস করেন।